বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশ

Spread the love

বাংলা সাংলাপ ডেস্কঃ১৯৭৫ সালে প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক ছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু বিশ্বকাপের সপ্তম আসরে ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে। ১৯৯৭ সালে আকরাম খানের নেতৃত্বে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েই বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। সে সময়ে ওই টুর্নামেন্ট না জিতলে আজকে ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই অবস্থানে আসা হতো না, সেটা দৃঢ়ভাবেই বলা যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের উত্থানে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৯৯ থেকে ২০১৫, বাংলাদেশ খেলে ফেলেছে ৫টি বিশ্বকাপ। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপ ছাড়া অন্য সবগুলো আসরেই বাংলাদেশ ভালোই করেছে। ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোনো ম্যাচই জিততে পারেনি।

বাকি সবগুলো আসরে বাংলাদেশ কমবেশি ম্যাচ জিতেছে। বিগত ৫টি বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করে টিম টাইগার্স মোট ৩৩টি ম্যাচ খেলেছে। এরমধ্যে জয় পেয়েছে ১১ ম্যাচে, হেরেছে ২০টিতে, বাকি ২টি ম্যাচ পরিত্যক্ত। ২০১১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের যৌথ আয়োজক হয়ে অংশগ্রহণ করে।
বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পারফর্মেন্স কেমন ছিল, দেখে নেয়া যাক…

১৯৯৯, সপ্তম ওয়ার্ল্ড কাপ
আইসিসির পূর্ব ঘোষণা অনুসারে সপ্তম বিশ্বকাপ আসরে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অভিষেক ম্যাচে নিউজিল্যান্ড ছিল বিপক্ষে (১৭ মে ১৯৯৯, চেমসফোর্ডে)। তৃতীয় ম্যাচে স্কটল্যান্ডকে ২২ রানে হারিয়ে প্রথম জয়লাভ করে। ওই আসরেই শক্তিশালী পাকিস্তানকে ৬২ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে আইসিসির কাছে পূর্ণ সদস্যপদ লাভের শক্তিশালী ভিত রচনা করে বাংলাদেশ। এর ভিত্তিতে ২০০০ সালের ২৬শে জুন আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে পাঁচটি ম্যাচ খেলে দুটিতে জয় ও তিনটিতে পরাজিত হয়। ওই আসরে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, কোচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের গর্ডন গ্রিনিজ।

২০০৩, ৮ম ওয়ার্ল্ড কাপ
প্রথম বিশ্বকাপের মঞ্চে খেলতে নেমে হইচই ফেলে দেয়া ক্রিকেটের নবাগত টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ আসর ছিল আফ্রিকা, কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে অনুষ্ঠিত হওয়া ওই বিশ্বকাপ আসর। ৬ ম্যাচ খেলে ৫টি-ই হেরেছে বাংলাদেশ, অন্যটি পরিত্যক্ত হয়েছে। প্রাপ্তির খাতা শূন্য থাকা এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ১৪ দলের মধ্যে ১৩তম হয়েই টুর্নামেন্ট শেষ করেছে। এ বিশ্বকাপে দলের অধিনায়ক ছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট, কোচ পাকিস্তানের মহসিন কামাল।

২০০৭, ৯ম বিশ্বকাপ
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সফল বিশ্বকাপ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে অনুষ্ঠিত হওয়া এই বিশ্বকাপ। এখন পর্যন্ত ক্রিকেট বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচাইতে বেশি দল অংশগ্রহণ করে ওই বিশ্বকাপে। ১৬ দলের টুর্নামেন্টে ৪টি করে দল ৪ ভাগে ভাগ হয়ে অংশ নেয় বিশ্বকাপ ক্রিকেটের নবম আসরে। বাংলাদেশ প্রথম রাউন্ডে ভারতকে হারিয়ে দেয়, ওই হারে বিশ্বকাপ আসর থেকে ছিটকে যায় ভারত। তখনকার ভারতীয় দল ছিল বিশ্বসেরা। অভিজ্ঞ শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী, ভিভিএস লক্ষণ, যুবরাজ সিং, অনীল কুম্বলের পাশাপাশি ধোনি, গম্ভীর জহির খানের মতো তারকা ছিল তৎকালীন ভারতীয় দলে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের রানার্স আপও ছিল। তারুণ্যের বাংলাদেশ, বিশ্বকাপে তাদের হারিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ড তথা সুপার এইট নিশ্চিত করে। আর এই বিশ্বকাপ আসরেই আবির্ভাব ঘটে মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক তামিমদের। ফলে সুপার এইট-এ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। এ পর্বে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৬৭ রানে হারায়। এ আসরে দলের অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন, কোচ অস্ট্রেলিয়ার ডেভ হোয়াটমোর।

২০১১, ১০তম ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ
বাংলাদেশ চতুর্থবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করে ২০১১ সালে। প্রথমবারের মতো ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজক দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়েছিল বাংলাদেশে। এ আসরে বাংলাদেশ আয়ারল্যান্ডকে ২৭ রানে পরাজিত করে প্রথম বিজয়ের হাসি হাসে। পরে ইংল্যান্ডকে দুই উইকেটে ও নেদারল্যান্ডসকে ছয় উইকেটে হারায়। দলের অধিনায়ক ছিলেন সাকিব আল হাসান, কোচ অস্ট্রেলিয়ার জেমি সিডন্স।

২০১৫, ১১তম বিশ্বকাপ
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা আসর ছিল বিশ্বকাপের এই আসরটি। বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ টানা অনেকগুলো সিরিজ হারতে থাকে। তখন নতুন কোচ নিয়োগ দেয়া হয়, এবং অধিনায়ক এর গুরুদায়িত্ব তুলে দেয়া হয় বাংলাদেশ ক্রিকেটের লিজেন্ডারি ক্রিকেটার মাশরাফির হাতে। মাশরাফির যাদুর ছোঁয়ায় বদলে যায় বাংলাদেশ দল। উদ্যমী, লড়াকু এক বাংলাদেশের জন্ম হয়, যারা শেষ পর্যন্ত না খেলে প্রতিপক্ষকে ছাড় দিতে রাজি নয়। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধ কন্ডিশনেও দারুণ ক্রিকেট খেলে বাংলাদেশ। রুবেলের স্বপ্নিল বোলিং আর ম্যাশের ক্যারিশম্যাটিক অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করে। প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশ দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বিতর্কিত আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই বাদ পড়ে যায় ম্যাশ বাহিনী। তবুও এই আসরটি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা আসর হিসেবে বিবেচিত। ৭ ম্যাচ খেলে ৩টি ম্যাচে জয়লাভ করে টিম টাইগার্স। ৩ ম্যাচে হেরে যায় আর অন্যটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এ আসরে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা, কোচ শ্রীলঙ্কান চন্দ্রিকা হাথুরাসিংহে।

২০১৫ বিশ্বকাপের পরেই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের উদ্ভব হয়। ঘরের মাঠে যারা অপ্রতিরোধ্য। বিশ্বকাপের পরপরই বাংলাদেশ ঘরের মাঠে সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে। একই বছরে ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গেও সিরিজ জিতে বাংলাদেশ। এরপর থেকেই একের পর এক সিরিজ জিততে থাকে ম্যাশ বাহিনী। ঘরের মাঠে জেতাটা হয়ে উঠে হরহামেশা ব্যাপার। বিদেশের মাটিতেও বাংলাদেশের পারফর্মেন্সের ধাপ বাড়তে থাকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কার মাটিতে সিরিজ জয় সেটাই প্রমাণ করে।

সামপ্রতিক বছরে বাংলাদেশ বিদেশের মাটিতে দুটি টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেললেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। ২০১৮ সালে আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। সাকিব তামিম বিহীন বাংলাদেশের সঙ্গে ফাইনাল জিততে ভারতকে শেষ বল পর্যন্ত খেলতে হয়েছিল। বাংলাদেশের সামপ্রতিক পারফর্মেন্স বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ভালো করতে আত্মবিশ্বাস জোগাবে।

আর মাত্র কয়েক দিন পরই ইংল্যান্ডের ওয়েলসে বসবে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ১২তম আসর। বিশ্বকাপে কেমন করবে বাংলাদেশ সেটা এখন সকল ক্রিকেটপ্রেমীর জল্পনা কল্পনা। ইংল্যান্ডের কন্ডিশন বোঝা বড় দায়। কখন যে বৃষ্টি আর কখন যে রোদ কিছুই বুঝার উপায় নেই। কন্ডিশনই বাংলাদেশ দলকে বেশি ভোগাবে।
তবে এবারের বিশ্বকাপে অন্য দলগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ দল অনেক বেশি অভিজ্ঞ। অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকবে টাইগাররা। বাংলাদেশের ৪ জন ক্রিকেটারের এটি চতুর্থ বিশ্বকাপ। এছাড়াও বেশ কয়েক জনের ৩টি বিশ্বকাপ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অভিজ্ঞ আর তারুণ্য দুই মিলে স্কোয়াড খারাপ বলা যাবে না। তার ওপরে আয়ারল্যান্ডের মাটিতে প্রথম ট্রফি জয়ের টাটকা স্মৃতি নিয়ে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ দল। তাছাড়া বিশ্বকাপ যেহেতু ইংল্যান্ডে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা আশান্বিত হতে পারে। কেননা, এই ইংল্যান্ডেই যে ২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে প্রথম বারের মতো বাংলাদেশ সেমিফাইনাল খেলেছিল। সেই সুখস্মৃতি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাবে। ইংল্যান্ডের মাটিই হোক বাংলাদেশের বিশ্বজয়ের সাজানো মঞ্চ। সেটাই চাওয়া পাওয়া বাংলার ১৭ কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর।

প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ : ৩১শে মার্চ ১৯৮৬ (পাকিস্তানের বিপক্ষে)
ওয়ানডে স্ট্যাটাস লাভ : ১৫ই জুন ১৯৯৭
বিশ্বকাপে প্রথম অংশগ্রহণ : ১৯৯৯, ইংল্যান্ড
প্রথম প্রতিপক্ষ : নিউজিল্যান্ড (১৯৯৯)
প্রথম জয়লাভ : স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ২২ রানে (১৯৯৯)
প্রথম হাফ সেঞ্চুরি : মেহরাব হোসেন অপি (ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে, ১৯৯৯)
প্রথম ম্যান অব দ্য ম্যাচ : মিনহাজুল আবেদিন নান্নু (১৯৯৯)
টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ : ২৬শে জুন ২০০০
প্রথম সেঞ্চুরি : মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে, ২০১৫)
দ্বিতীয় সেঞ্চুরি : মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ (নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ২০১৫)


Spread the love

Leave a Reply