কপ-২৬: বিশ্ববাসীর দৃষ্টি এখন গ্লাসগোর দিকে, ১৪০ দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ ৩০হাজার প্রতিনিধি যোগ দিচ্ছেন
আহমেদ শামীম:
যুক্তরাজ্যের চতুর্থ বৃহৎ এবং স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর গ্লাসগো। আগামী ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ১৪০টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ প্রায় ৩০হাজার প্রতিনিধি যোগ দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে গ্লাসগোতে। জাতিসংঘের ‘কপ-২৬’ ( কনফারেন্স অব দ্যা পার্টিজ) নামক জলবায়ু সম্মেলনে তারা যোগ দেবেন।
উল্লেখ্য,জাতিসংঘের উদ্যোগে গঠিত কপের প্রথম সম্মেলন হয় ১৯৯৫ সালে। এবার হচ্ছে এর ২৬তম আয়োজন।প্রায় দু’সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠেয় এ সম্মেলনের সফলতা-ব্যর্থতার দিকে নজর রাখবেন পুরো বিশ্ববাসী। যে কারণে সবার চোখ এখন গ্লাসগো’র দিকে।এদিকে সম্মেলনের পূর্বে বেশ ক’টি ধনী দেশ তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য তদবির চালাচ্ছে বলে এক নথি ফাঁস করেছে বিবিসি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩১ অক্টোবর থেকে গ্লাসগোয় শুরু হতে যাওয়া কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনে ১২০ জনের বেশি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং প্রায় ৩০ হাজার জলবায়ু বিশেষজ্ঞ, উন্নয়নকর্মী, সাংবাদিক এবারের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে। এই সম্মেলনে বিশ্বের দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের লাগাম টানতে কার্যকর একটি চুক্তিতে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই চুক্তিতে পৌঁছানোকে কপ-২৬-এর সফলতা বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কপ-২৬-এর আগে ইতালির রাজধানী রোমে বৈঠকে বসছেন ধনী ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট জি-২০-এর নেতারাও।
আসন্ন কপ-২৬ সামনে রেখে জাতিসংঘের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-বিষয়ক এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি প্যাট্রিসিয়া এসপিনোসা সতর্ক করে বলেছেন, এই সম্মেলনের ব্যর্থতা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। ভেঙে পড়তে পারে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা। দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমাতে সফল না হলে ক্রমবর্ধমান অভিবাসন ও খাদ্যসংকট বিশ্বজুড়ে সংঘাত ও বিশৃঙ্খলার কারণ হতে পারে।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যোগ দিচ্ছেন। তবে গ্লাসগোয় যাচ্ছেন না চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। চিন পিং ও পুতিনের অনুপস্থিতি সম্মেলনে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন প্যাট্রিসিয়া এসপিনোসা। তিনি বলেন, সব দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধানেরা সম্মেলনে যোগ দেবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এসব দেশের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
কপ-২৬-এ দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের হার ২০১০ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি প্রদানে একমত হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের। একই সঙ্গে বিশ্বের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানোর বিষয়ে ২০৩০ সালের সময়সীমা বেঁধে দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। ২০১৬ সালে সই হওয়া প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়ে বলা হয়েছিল।
এবারের কপ -২৬ সম্মেলনে যে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হতে পারে এবং সম্মেলন সফল বা ব্যর্থ হলে মানুষের উপর তার কী কী প্রভাব পড়তে পারে, সে বিষয়ে এক প্রতিবেদনে বিষদ বিবরণ তুলে ধরেছে বিবিসি।
বিবিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মানুষের কারণে যে বিপুল পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি নির্গত হচ্ছে, তা বিশ্বকে ক্রমাগত আরও উষ্ণ করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে দাবদাহ, বন্যা ও দাবানলের মতো ঘটনা বাড়ছে,এবং এগুলোর মাত্রা দিন দিন আরও তীব্রতর হচ্ছে।
গত দশক ছিল রেকর্ড অনুযায়ী এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উষ্ণ। এই পরিস্থিতি বদলাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার বিষযে একমত হয়েছে।
এবারের কপ সম্মেলনে ২০০ দেশের কাছে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে তাদের পরিকল্পনা কী তা জানতে চাওয়া হবে।
২০১৫ সালে এই দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি যেন না বাড়ে, যেন এর চেয়ে ‘অনেক কম’ সম্ভব হলে প্রাক শিল্পায়ন যুগের তাপমাত্রার চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশির মধ্যে রাখা যায়, তা নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে রাজি হয়েছিল। এটাই প্যারিস চুক্তি নামে পরিচিত; এই চুক্তির ফলে কার্বন নিঃসরণ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্যত শূন্যে নামিয়ে আনতে বিভিন্ন দেশকে এখন কার্বন নিঃসরণ ব্যাপক হারে কমাতে হবে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সম্মেলন শুরুর আগেই বেশিরভাগ দেশ কার্বন নিঃসরণ কমানো বিষয়ক তাদের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলবে; ফলে আগেভাগেই বোঝা যাবে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বিশ্ব থাকছে কি না।
দুই সপ্তাহের এই সম্মেলনে নতুন নতুন অনেক ঘোষণাও আসতে পারে। এসব ঘোষণার বেশিরভাগই হতে পারে ‘খুবই টেকনিক্যাল’; যেমন হতে পারে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে আরও যেসব নিয়মকানুন থাকা দরকার, সেগুলো যোগ করা।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন ঘোষণা প্রসঙ্গে বলা হয়, এবারের কপ সম্মেলনে জ্বালানিনির্ভর গাড়ি থেকে দ্রুত বৈদ্যুতিক গাড়িতে চলে যাওয়া, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের পথ থেকে সরে আসার গতি বাড়ানো, গাছ কাটা কমানো, উপকূলীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অর্থায়নসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আরও বেশি মানুষকে রক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া।
সম্মেলন শেষে একটি ঘোষণা আসার কথা, যেখানে সবগুলো দেশের স্বাক্ষর থাকবে এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি থাকবে।
গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে বাদানুবাদ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অর্থ এবং জলবায়ু বিষয়ক ন্যায়বিচার নিয়ে অনেক কথা হবে বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণ উন্নত দেশগুলোর চেয়ে কম; অতীতে বিপুল পরিমাণ কার্বন নিঃসরণের দায়ভারও তাদের নয়। অথচ তাদেরকেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হচ্ছে।নিজেদের কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ দরকার। কয়লার ওপর নির্ভরশীল দেশগুলোতে আরও সোলার প্যানেল দরকার, দরকার বন্যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কী পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত তা নিয়েও বিতর্কে জড়াতে পারে বিভিন্ন পক্ষ।
ধনী দেশগুলো এর আগে দরিদ্র দেশগুলোকে এ খাতে ১০ হাজার কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে না বলে গত বছর এক মূল্যায়নে জানিয়েছিল জাতিসংঘ। যে কারণে এবার ধনী দেশগুলোর কাছে আরও অর্থ চাওয়া হতে পারে।
চীন প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয় কপ ২৬-এ চীনের প্রতিশ্রুতিও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। বিশ্বজুড়ে কয়লাবিদ্যুতে বিনিয়োগ করা দেশটি বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশও। চীন ও অন্যান্য বড় জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদকরা কত দ্রুত এ ধরনের জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমাতে আগ্রহ দেখায় পর্যবেক্ষকদের নজর থাকবে সেখানেও।
দৈনন্দিন জীবনে কি কি প্রভাব পড়তে পারে এ সম্পর্কে বলা হয়, গ্লাসগো সম্মেলনে এমন অনেক প্রতিশ্রুতি আসতে পারে যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
পেট্রলচালিত গাড়ি ব্যবহার করা যাবে কি না, গ্যাস বয়লার দিয়ে ঘর গরম করতে কিংবা ঘন ঘন বিমানে চড়া যাবে কি না, কপ-২৬ এর সিদ্ধান্ত এ সবকিছুর উপরই প্রভাব ফেলতে পারে।
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি মোকাবেলা ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে প্রথমবারের মতো বিশ্বের দেশগুলো ২০১৫ সালে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়, এটিই প্যারিস চুক্তি নামে পরিচিত।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়কর প্রভাব থেকে বাঁচা যাবে।
আয়োজক দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের চাওয়া থাকবে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কার্যত শূন্যে নিয়ে আসার যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সব দেশ যেন তার সমর্থনে ও ২০৩০ সালের মধ্যে নিঃসরণ ব্যাপক হারে কমানোর প্রতিশ্রুতি সম্বলিত দৃঢ় বার্তা দেয়।
কয়লা ও পেট্রলচালিত গাড়ি বন্ধ এবং পরিবেশ সুরক্ষায় বিভিন্ন দেশ সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেবে, এমনটাও প্রত্যাশা করবে তারা। উন্নয়নশীল দেশগুলো তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়ক হয় এমন মোটা অংকের অর্থ চাইবে।
এর যে কোনো একটাও যদি অর্জিত না হয়, তাহলেই কপ-২৬ এর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে; কেননা, তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে সর্বোচ্চ দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেশি রাখার লক্ষ্যমাত্রাকে জীবিত রাখতে হাতে যে খুব বেশি সময় নেই।
অবশ্য কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন, বিশ্বনেতারা অনেক দেরি করে ফেলেছেন। এখন তারা কপ-২৬-এ যা নিয়েই একমত হন না কেন, কোনো লাভ নেই, দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
*ধনী দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার তদবির
এদিকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদন পরিবর্তনে বিভিন্ন দেশের চেষ্টাসংবলিত একটি নথি ফাঁস হয়েছে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি নিউজ সম্প্রতি ওই নথি জনসমক্ষে আনে। ফাঁস হওয়া নথিতে উল্লেখ রয়েছে, সৌদি আরব, জাপান, অস্ট্রেলিয়ার মতো বিভিন্ন দেশ জাতিসংঘ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর যে লক্ষ্য দিয়েছে, তা থেকে সরে আসতে তদবির চালাচ্ছে।ধনী দেশগুলো সবুজায়ন ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোকে দেওয়া অনুদান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে।
ধনী দেশগুলোর এমন ‘তদবির’ কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
ফাঁস হওয়া নথি থেকে আরও জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখতে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কয়েক দিন আগেই জাতিসংঘের সুপারিশ প্রত্যাহার করে উল্টো জীবাশ্ম জ্বালানি বহাল রাখার মতো প্রস্তাব করবে দেশগুলো।
বিবিসি জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বের করতে জাতিসংঘের একদল বিজ্ঞানী একটি প্রতিবেদন তৈরি করছেন। সরকার, কোম্পানি এবং অন্য আগ্রহী অংশীদারেরা এসব নথি জাতিসংঘের একটি বৈজ্ঞানিক প্যানেলের কাছে উপস্থাপন করেছে।
জাতিসংঘ গঠিত ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) প্রতি ছয় থেকে সাত বছরে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদন ব্যবহার করেই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার নীতি নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার।সর্বশেষ প্রতিবেদনটি গ্লাসগো সম্মেলনে আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি দেশ এবং সংস্থা যুক্তি দিচ্ছে যে প্রতিবেদনের বর্তমান খসড়ায় যত দ্রুত সুপারিশ করা হয়েছে, তত দ্রুত বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর প্রয়োজন নেই। সৌদি তেল মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা দাবি করেছেন, ‘সব পর্যায়ে জরুরি এবং ত্বরিত প্রশমন কার্যক্রমের প্রয়োজনের’ মতো বাক্যগুলো প্রতিবেদন থেকে বাদ দিতে হবে।
এবারের জলবায়ু সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা। আগেই তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও অস্ট্রেলিয়া সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা প্রয়োজন এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী এবং অস্ট্রেলিয়া প্রধান কয়লা রপ্তানিকারক দেশ।
ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব মাইনিং অ্যান্ড ফুয়েল রিসার্চের একজন জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী সতর্ক করে বলেছেন, কয়লা কয়েক দশক ধরে জ্বালানি উৎপাদনের প্রধান ভিত্তি হিসেবে থাকতে পারে। কারণ, সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কয়লা আমদানিকারক দেশ ভারত।
বেশ কয়েকটি দেশ মাটির নিচে কার্বন ডাই–অক্সাইড ধরে রাখা এবং স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য নকশা করা নতুন এবং বর্তমানে ব্যয়বহুল প্রযুক্তির পক্ষে যুক্তি দিয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি প্রস্তুতকারী বা ব্যবহারকারী বড় দেশ সৌদি আরব, চীন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংস্থা ওপেক কার্বন ধারণ ও সংরক্ষণ (সিএসএস) প্রযুক্তিকে সমর্থন করেছে।
আর্জেন্টিনা, নরওয়ে এবং ওপেকেরও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো নিয়ে আপত্তি রয়েছে। নরওয়ে বলেছে, জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গমন কমানোর সম্ভাব্য হাতিয়ার হিসেবে সিএসএসের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা উচিত।
অস্ট্রেলিয়া আইপিসিসি বিজ্ঞানীদের অস্ট্রেলিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জলবায়ুর ওপর প্রভাব ফেলতে জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের ভূমিকা বিশ্লেষণের একটি রেফারেন্স মুছে ফেলতে বলেছে। আইপিসিসি বলেছে, বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা প্রক্রিয়ার জন্য সরকারের মন্তব্য মূল বিষয় হলেও লেখকদের প্রতিবেদনে তা যুক্ত করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
জলবায়ুবিজ্ঞান নিয়ে আইপিসিসির কাজ এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য জাতিসংঘ ২০০৭ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিল।
ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার আপত্তির বিষয়টিও জানা গেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমাতে মাংস খাওয়া কমানোর কথা খসড়া প্রতিবেদনে রয়েছে। এর বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছে দুটি দেশ। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা বিশ্বে গরুর মাংসের পণ্য এবং পশুখাদ্য ফসলের সবচেয়ে বড় উৎপাদক।
খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিমা খাদ্যের তুলনায় উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্য গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে ৫০ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে। ব্রাজিল বলছে, এটা ভুল। ব্রাজিলের সঙ্গে আর্জেন্টিনাও ‘উদ্ভিদভিত্তিক খাদ্য’ বাক্যটিতে পরিবর্তন আনতে বলেছে।
প্রতিবেদনে সুইজারল্যান্ডের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মন্তব্য সংশোধন করতে বলা হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর কার্বন নির্গমন কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য ধনী দেশগুলোর সহায়তার বিষয়টিতে আপত্তি তুলেছে সুইজারল্যান্ড।
খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশির ভাগ পূর্ব ইউরোপীয় দেশ যুক্তি দিয়েছে, প্রতিবেদনটিতে জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পারমাণবিক শক্তির ভূমিকা বিষয়ে ইতিবাচক হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে ভারত আরও এক ধাপ এগিয়ে। তাদের যুক্তি, প্রায় সব চ্যাপ্টারের পারমাণবিক শক্তির বিরুদ্ধে পক্ষপাত রয়েছে। এ ছাড়া এটি প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি, যা কিছু দেশ ছাড়া রাজনৈতিকভাবেও সমর্থিত।