বিশ্বমঞ্চে গৌরবের আসনে বাংলাদেশ, বাইডেন থেকে ক্লিন্টন ইউনূসকে আলিঙ্গন
ডেস্ক রিপোর্টঃ জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনকে ঘিরে নিউ ইয়র্কে বসেছে বিশ্বনেতাদের মিলনমেলা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে কে নেই সেখানে? ১৯১ সদস্য-রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা তো বটেই, সেই মেলায় জড়ো হয়েছেন আন্তর্জাতিক সংস্থা-সংগঠনের পদস্থ কর্মকর্তারাও। জাতিসংঘ আসরকে ফলো করছে বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা, ভয়েস অব আমেরিকাসহ পাঠকনন্দিত দুনিয়ার প্রায় সব মিডিয়া। ওয়ার্ল্ড ক্যাপিটাল খ্যাত নিউ ইয়র্কের সেই মঞ্চে নতুন এক পরিচয়ে উপস্থিত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘে তার পদচারণা বহু বছরের। কিন্তু এবারে বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসাবে অভিষেক হয়েছে তার। ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। অবশ্য বিশ্বমঞ্চে বিরল সম্মাননাও পাচ্ছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশি কূটনীতিকদের ভাষ্যমতে, এবারের জাতিসংঘ অধিবেশন ইউনূসময়। সেইসঙ্গে গৌরবের আসনে বাংলাদেশ। ৫৪ বছরের ইতিহাসে যা ঘটেনি এবার এমন সব ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশকে ঘিরে। আরও খোলাসা করে বলছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ঘিরে। বিশ্ব রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছেন তিনি। মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কে একাধিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন ড. ইউনূস। সবখানেই তার সঙ্গে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে। অনেককেই লাইন ধরে তার সঙ্গে ছবি তুলতে দেখা যায়। যার মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুল আলোচিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্। ড. ইউনূসকে কাছে পেয়ে আলিঙ্গন করেন তিনি। সেইসঙ্গে আপ্লুত পিটার হাস্ হাসিমুখে ছবিও তোলেন। স্মরণ করা যায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালেই বাংলাদেশ মিশন সম্পন্ন হয় পিটার হাসের। তার পূর্ব-নির্ধারিত ফ্লাইটের দু’দিন আগে অর্থাৎ ২১শে জুলাই ছিল কূটনৈতিক ব্রিফিং। যেখানে তিনি ছাত্র-জনতার ওপর শেখ হাসিনা সরকারের দমন-পীড়নে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। জাতিসংঘের লোগোযুক্ত এপিসি থেকে নিরীহ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ নিয়ে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে তিনিও প্রশ্ন তুলেছিলেন।
নতুন বাংলাদেশ গড়তে বিদেশি বন্ধুদের সহযোগিতা চাইলেন ড. ইউনূস
যুবসমাজের জীবন উৎসর্গ এবং অদম্য নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বলেন, একটি বৈষম্যহীন সমাজ ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যে তারা জীবন দিয়েছে। তরুণদের এই স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বিদেশি বন্ধুদের সহযোগিতা চাই। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ সহায়তা চান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তরুণদের আত্মত্যাগ আমাদের সামনে বড় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আমরা এই সুযোগ হারাতে চাই না। বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে তরুণরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়। এটি বাস্তবায়নে আপনাদের সবার সমর্থন প্রয়োজন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তির ৫০তম বছর উদ্যাপন উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ, মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু-সহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ই সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আবদুল মুহিত, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম প্রমুখ। প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে আলোকচিত্রী ও লেখক শহিদুল আলম শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের ঘটনাগুলো নিয়ে লেখা দু’টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে ড. ইউনূস বলেন, গোটা জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। যারা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল আমরা তাদের হতাশ করতে চাই না। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে একটি নতুন নির্বাচনী ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার সরকার কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। বলেন, যুবসমাজের সামনে কোনো স্বপ্ন ছিল না। স্বৈরাচার তাদের স্বপ্ন ও ভবিষ্যতকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তাই তারা স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে বুলেটের সামনে দাঁড়াতে পিছপা হয়নি। বিদেশি বন্ধুদের উদ্দেশ্যে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা যে সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে, তা আমাদেরকে অভিভূত করেছে। বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে তারা জীবন দিয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। তিনি বলেন, তরুণদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ গড়তে আমরা আপনাদের পাশে চাই। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে ২৩শে সেপ্টেম্বর থেকে নিউ ইয়র্কে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে তিনি ব্যস্ত সময় পার করছেন। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাইড ইভেন্ট রয়েছে তার। আগামী ২৭শে সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘে ভাষণ দেবেন। ওই রাতেই তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে নিউ ইয়র্ক ছাড়বেন।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে, বললেন ড. ইউনূস: রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমাদের সতর্ক হতে হবে, এই সংকটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশেনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক আলোচনায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি, আইসিসি প্রসিকিউটর করিম এএ খান, আইওএম মহাপরিচালক অ্যামি পোপ প্রমুখ বক্তব্য দেন। প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন। বলেন- প্রথমত, আমরা চাই জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সকল পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুক।
সম্মেলনে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা পূর্বক নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রফেসর ড. ইউনূস বলেন, দ্বিতীয়ত জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’ কার্যক্রমে নতুন করে প্রাণশক্তি যোগ করার প্রয়োজন। যেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করার মতো তহবিলের অভাব রয়েছে, তাই রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করতে হবে। তৃতীয় প্রস্তাবে ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে অবশ্যই আন্তরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দ্বারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এ সময় শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। প্রতি বছরের ন্যায় এবারো অনুষ্ঠান হচ্ছে তবে ড. ইউনুসের উপস্থিতি ও তার দৃষ্টিভঙ্গি এবারের আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বৈষম্য, রাষ্ট্রহীনতা এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত বন্ধ করতে আমাদের অবশ্যই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বৈঠকের পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এবারের বৈঠকটি অত্যন্ত সফল ছিল। সবাই বাংলাদেশের প্রচেষ্টার প্রশংসা এবং তাদের অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আইওএম মহাপরিচালক অ্যামি পোপ বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এই সংকট সমাধানে আমাদের আরও কাজ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এই আলোচনায় অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী এবং বাংলাদেশ ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ১৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের নতুন সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেন। এদিকে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী বিশ্বনেতাদের উদ্দেশ্যে ‘আমাদের হতাশ করবেন না’ মর্মে একটি বার্তা পাঠিয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা ওই ভিডিও বার্তায় বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া যাবে না।
বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগে সহায়তার প্রতিশ্রুতি আইএমএফ প্রধানের: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছেন, ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ঋণদাতা বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করতে ঢাকায় একটি দল পাঠিয়েছি। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের ফাঁকে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার এ সমর্থন ব্যক্ত করেন। প্রধান উপদেষ্টা ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে বাংলাদেশের পূর্ববর্তী স্বৈরশাসন উৎখাত করা ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং করেন। তখন ক্রিস্টালিনা তাকে বলেন, এটি একটি ভিন্ন দেশ। এটি বাংলাদেশ ২.০। বৈঠকে প্রফেসর ড. ইউনূস নির্বাচন, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য তার অন্তর্বর্তী সরকার যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে সে সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি বলেন, কমিশনের সুপারিশ নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত এবং ভোটার তালিকা তৈরি হলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আইএমএফের প্রধান নির্বাহী এসব উদ্যোগে তার সমর্থন জানিয়ে বলেন, আইএমএফ বাংলাদেশ সরকারের জন্য আর্থিক সহায়তা দ্রুততর করবে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও পরিবহন উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান আইএমএফ প্রধানকে বলেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র এক সপ্তাহ সময়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অপরাধের ‘দুর্গ’ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ড. দেবপ্রিয় দেশের অর্থ প্রদানের ভারসাম্য বাড়াতে আইএমএফের সহায়তার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতি: এদিকে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের (ইউএনজিএ) ফাঁকে দুই নেতার সাক্ষাতের পর হোয়াইট হাউস একটি বিবৃতি দিয়েছে। যেখানে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ওয়াশিংটন ও ঢাকার মধ্যকার ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এটি অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং দুই দেশের জনগণের সম্পর্কের গভীরে প্রোথিত রয়েছে। এতে আরও বলা হয়, প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই সরকারের মধ্যে আরও সম্পৃক্ততাকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং বাংলাদেশকে তার নতুন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে মার্কিন সহায়তা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইউনূসকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে সামপ্রতিক নিয়োগে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ঢাকা-রোম সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় দেখতে চান ইতালির প্রধানমন্ত্রী: ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি ইতালীয়রা বাংলাদেশের বন্ধু উল্লেখ করে রোম ও ঢাকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘নতুন অধ্যায়’ সূচনার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনের ফাঁকে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ইতালির প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। বৈঠকে ড. ইউনূস ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থানের একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরে বলেন, তারা সমগ্র জাতির জন্য ‘রিসেট বোতাম’ টিপে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। মেলোনি বলেন, ইতালি গুরুত্বপূর্ণ খাতে সংস্কারের পদক্ষেপে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করবে। তিনি বলেন- অবশ্যই, আপনি আমাদের ওপর নির্ভর করতে পারেন। আসুন আমাদের সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায় সূচনার চেষ্টা করি। প্রধান উপদেষ্টা ইতালির নেতাকে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনকে বিধিবদ্ধ করার অনুরোধ করে বলেন, আইনি চ্যানেলের মাধ্যমে ইতালিতে আরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের প্রবেশের পথ সুগম করা হলে ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ অভিবাসন হ্রাস পাবে। মেলোনি এ কথায় সম্মতি প্রকাশ করে বলেন, উভয় দেশেরই অনিয়মিত অভিবাসন বন্ধ করা এবং ইতালিতে কাজ করতে আগ্রহীদের প্রশিক্ষণের জন্য একসঙ্গে কাজ করা উচিত।
‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজঃ যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রতিষ্ঠান ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের গল্প তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে মঙ্গলবার নিউইয়র্কে ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডারস স্টেজ’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তিনি।বাংলাদেশের তরুণরাই নতুন বাংলাদেশ গড়বেন বলে আশা প্রকাশ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এ আন্দোলন খুব পরিকল্পিতভাবে চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিছুই হঠাৎ করে হয়নি।জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছেন ড. ইউনূস। মঙ্গলবার নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে আয়োজিত ওই অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই বিপ্লব ও এরপরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আঁকা দেয়ালচিত্রের ছবি সংবলিত ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’ শীর্ষক আর্টবুক বিল ক্লিনটনকে উপহার দেন।অনুষ্ঠানে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিল ক্লিনটনের সঙ্গে তার পরিচয় ও সম্পর্কের প্রথম দিনের গল্প, যুক্তরাষ্ট্রে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের গল্প তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন অধ্যাপক ইউনূসকে বাংলাদেশের তরুণ নাগরিকদের ডাকে সাড়া দিয়ে দায়িত্বগ্রহণকারী নেতা বলে পরিচয় করিয়ে দেন।বিল ক্লিনটনের সঙ্গে নিজের প্রথম যোগাযোগের ঘটনা উল্লেখ করে ড. ইউনূস তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে একটি চিঠি পেয়েছিলেন (১৯৮৬ সালে), যা তাকে অবাক করেছিল। আরকানসাসের একজন গভর্নর (সে সময় ক্লিনটন এ অঙ্গরাজ্যের গভর্নর ছিলেন) ওই চিঠি পাঠান। চিঠিতে তার সঙ্গে দ্রুত দেখা করতে চান বলে তিনি লিখেছিলেন।এ প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘আমি জানতাম না, তিনি দ্রুত বলতে ঠিক কতটা দ্রুত বোঝাতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম, এরপর আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে আসব, আমি অবশ্যই যাব এবং আপনার সঙ্গে দেখা করব।’’ড. ইউনূস বলেন, ‘‘তিনি আমাকে বলেছিলেন, এটা (দেখা করা) খুবই জরুরি।’ উত্তরে আমি বলি, ‘আমি দেখছি, কীভাবে দ্রুত আসা যায়। আমি আসব, (তবে) আগেই আসতে পারব না। পরে আমি তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। এভাবেই আমাদের যোগাযোগের সূচনা হয়।’’অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘শিকাগোতে একটি প্রকল্প শুরু হয়েছিল। এখন এটি বড় আকারে গ্রামীণ প্রকল্প হয়ে আসছে। আমেরিকায় গ্রামীণ আমেরিকা শুরু হয়েছে। এখানে নিউইয়র্ক সিটিতে, জ্যাকসন হাইটসে। এটি খুবই ছোট এক প্রকল্প ছিল এবং পরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এখন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে গ্রামীণ আমেরিকার ৩৫টি শাখা রয়েছে। প্রতিটি বড় শহরে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা আছে। এখানে গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রাহক প্রায় দুই লাখ এবং ঋণগ্রহীতাদের শতভাগ নারী।’’‘এটা তার (বিল) স্বপ্ন ছিল। এখন এসব ব্যাংক থেকে বছরে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়া হয়। আমরা (গ্রামীণ ব্যাংক, আমেরিকা) এখন এ পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। আমরা বছরে ১৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিই, কোনো জামানত ছাড়া, কোনো কিছু ছাড়া এবং সবাই সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন।’’তিনি বলেন, ‘‘আগামী ১০ বছরে আমাদের (গ্রামীণ ব্যাংক, আমেরিকা) এই ঋণদানের পরিমাণ বছরে ৪০০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এটা দারুণ এক গল্প, যেটা তিনি (বিল) শুরু করেছিলেন। আমরা (বাংলাদেশে) সবে একটি ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছি। ১৯৮৩ সালে আমরা ব্যাংক হিসেবে নিবন্ধিত হই।’’দেশে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া কয়েকজন শিক্ষার্থীও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ড. ইউনূস তাদের কথাও বলেন। তিনি তাদের মঞ্চে ডেকে নিয়ে আসেন। এ সময় মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘দেশ গড়তে, নিজেদের গড়তে যে শব্দে, যে ভাষায় তারা (আন্দোলনকারীরা) কথা বলেছে, তা অসাধারণ। আমি আগে কখনো এভাবে কাউকে কথা বলতে শুনিনি। তারা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ করতে প্রস্তুত। দয়া করে তাদের সাহায্য করুন, সমর্থন করুন। তাদের স্বপ্ন যেন সত্য হয়। আমরা একসঙ্গে এ দায়িত্ব নিতে পারি। এ স্বপ্ন পূরণে আপনি (ক্লিনটন) আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’’