বৃটিশ সরকারের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্ট-২০১৬ঃ বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি
(বাকস্বাধীনতার উপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। এবং ধর্মীয় ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে উগ্রপন্থিদের আক্রমণ এবং জাতিগত সহিংসতা চলমান রয়েছে।আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সম্পৃক্ততায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং গুম সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নারী এবং তরুণীদের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ আগের মতই বহাল রয়েছে।)
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নতুন মানবাধিকার রিপোর্টে ‘সামনের দিকে তাকানোর’ নীতি অনুসরণের আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। নতুন রিপোর্ট বলেছে, ‘আমরা গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতাকে এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের সামর্থ্যকে শক্তিশালী করতে সকল বাংলাদেশি রাজনৈতিক দল এবং আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে আমরা গঠনমূলকভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখব।’ রিপোর্টে এরপর আরো বলা হয়েছে, ‘পরবর্তী নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া যে অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে সেই লক্ষ্যে আস্থা বৃদ্ধিতে একটি উল্লেখযোগ্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা ‘ডিউ প্রসেস’ বা যথা প্রক্রিয়ার কোনো সম্ভাব্য অপব্যবহার এবং অমানবিক আচরণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণে গুরুত্বারোপ করব। এবং আমরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মান, যা বজায় রাখতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে এবং বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ গ্রহণের জায়গা ও পরিবেশ উন্মুক্ত রাখতে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহ যোগাব। মিডিয়া এবং সিভিল সোসাইটির প্রতি আমাদের সমর্থনের মধ্য দিয়েও আমরা তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাব। বৃটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বাকস্বাধীনতার উপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। এবং ধর্মীয় ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে উগ্রপন্থিদের আক্রমণ এবং জাতিগত সহিংসতা চলমান রয়েছে। ২০১৭ সালে ২০শে জুলাই প্রকাশিত এই মানবাধিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ১লা জুলাই হোলি আর্টিজানে আক্রমণের ঘটনা- যাতে কুড়ি জন মানুষ নিহত হয়েছিল। সেটিসহ ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকার সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে একটি কঠোর জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের চেষ্টা করছে। তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসমূহের সম্পৃক্ততায় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্বিচার গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং গুম সংঘটিত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। নারী এবং তরুণীদের নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ আগের মতই বহাল রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধের কারণে আইনগত শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড এখনো বহাল রয়েছে। নতুন যেসব আইন জারি করা হয়েছে তাতে বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের উপাদান রয়েছে। সিভিল সোসাইটির গ্রুপগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে, ২০১৬ সালে বিদেশি অনুদান (স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম) সংক্রান্ত যে আইন পাস করেছে, তাতে বাংলাদেশে এনজিওগুলোর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে তাদের সামর্থ্য বিঘ্নিত হতে পারে। একই সঙ্গে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও ওই আইন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। বৃটিশ মানবাধিকার রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশি আইন এবং আন্তর্জাতিক মানের আলোকে গ্রেপ্তারকৃত সকল ব্যক্তির সঙ্গে ন্যায্য আচরণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাজ্য একই সঙ্গে স্পষ্ট জানিয়েছে যে, ভুক্তভোগী কিংবা কথিত দুষ্কৃতকারীর পরিচয় ও তার সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে অপরাধের প্রেক্ষিতে কাউকে কোনোভাবেই দায়মুক্তি দেয়া চলবে না। আমরা পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড সংক্রান্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের দেয়া নির্দেশনাবলী সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ সরকারকে উৎসাহিত করছি। রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিৃটিশ হাইকমিশন বাংলাদেশে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো বক্তৃতা বিবৃতি বা হেট স্পিচ বন্ধে বাকস্বাধীনতার উপর যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ আরোপ এবং এ বিষয়ের রাবাত নীতিমালার বাস্তবায়নে সমর্থন দিয়েছে। বৃটেন একই সঙ্গে যেসব সংগঠন চরমপন্থিদের দ্বারা হুমকির শিকার হওয়া ব্লগারদের সহায়তা প্রদান এবং মানবাধিকার কর্মীদের সমর্থন করছে, সেসব আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ম্যাগনাকার্টা ফান্ডের মাধ্যমে বিচারকদের জন্য একটি স্পষ্ট দণ্ড প্রদানের নীতিমালা প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে আমরা সমর্থন দিয়েছি। যেসব ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড সমুন্নত রাখা হবে, সেক্ষেত্রে এটা বজায় রাখতে সাহায্য করবে যে, মৃত্যুদণ্ড যদি বহাল রাখতেই হয়, তাহলে সেটা এমন প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে যাতে আন্তর্জাতিক মানের শর্তাবলী পূরণ করে। আর এটা হলো এমনি একটি পদক্ষেপ যা কালক্রমে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের দিকে নিয়ে যাবে।
উল্লেখ্য যে, বৃটিশ মানবাধিকার রিপোর্টে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণের বিষয়সহ লিঙ্গ সমতা অর্জন এবং দেশটিকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার প্রচেষ্টার প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘মধ্য আয়ের মর্যাদা অর্জন এবং লিঙ্গ সমতা অর্জনে প্রশংসনীয় অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ অব্যাহতভাবে কতিপয় সূচকে বেশ নাজুক অবস্থানে রয়েছে। যেমন, ২০১৬ সালের গ্লোবাল স্লোভারি বা বৈশ্বিক দাসত্ব সূচকে ১৬৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২১তম। ওই সূচকের আওতায় গ্লোবাল স্লোভারি ইনডেক্স জনগণের জীবনযাপনকে এমনভাবে নির্ধারণ করেছে, যা আসলে আধুনিক দাস প্রথার সমতুল্য। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর ২০১৫ সালের বৃটিশ মডার্ন স্লোভারি অ্যাক্টের অধীনে বাংলাদেশে বৃটিশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে তা অনুসরণ করে, সেজন্য তাদের প্রতি সমর্থন ও সম্মতি জ্ঞাপন করেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অংশীদারিত্বে এবং বিচার বিভাগের নানা প্রকল্প সমূহে যুক্তরাজ্য নারী ও কিশোরীদের ক্ষমতায়নের যাতে আরো বিকাশ ঘটে সেই লক্ষ্যে উন্নত নীতি অনুসরণে যুক্তরাজ্য গুরুত্বারোপ করেছে।