ব্রিটেনে সিলেটি কন্যার রাজকীয় বাঙালি বিয়ে
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ রানির দেশে রাজকীয় বিয়ে তো হতেই পারে। গত মাসে যুক্তরাজ্যের লন্ডনে একটি বিয়ের আয়োজন হয়ে গেল। রাজ–রাজড়াদের না হলেও সেই বিয়ের আয়োজন রীতিমতো এক এলাহি ব্যাপার। তবে এই বিয়ের আয়োজনে ছিল বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। শখ আর সামর্থ্যের মিলন ঘটেছিল পুরোমাত্রায়। অভিজাত এক আয়োজনের মাধ্যমে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শরিফ আহমদ। খোদ বাংলাদেশেও বিলুপ্তপ্রায় সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ঘাইল-সিয়া, শিল-পাটা, কুলা, পালকির সঙ্গে পশ্চিমা প্রাচুর্যের এই ‘ফিউশন’ ছিল তাক লাগানো।সোয়ারীর বেশে হারিকেন হাতে কনের ভাইআবাসন ব্যবসায়ী শরিফ আহমদের বড় মেয়ে সাবরিনা নাশিমুন আহমদের বিয়ে হয় ১৯ আগস্ট। ২২ বছর বয়সী সাবরিনা পেশায় একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। বর আবদুল বাছিত যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা (এনএইচএস) বিভাগের সাউথ উডফোর্ড শাখার নিয়োগ পরামর্শক। বর-কনে দুজনের আদি বাড়ি সিলেট জেলায়। বিয়ের চার দিন আগে রং খেলা দিয়ে শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। পূর্ব লন্ডনের একটি গার্ডেন ও সুইমিংপুল ভাড়া করে চলে রং মাখামাখি। পরের দিনই ছিল মেয়ের গায়েহলুদ। আপমিনস্টার পার্কে চলে আয়োজন। কনে এতে হাজির হন ভিন্ন কায়দায়। কাছের মানুষদের নিয়ে নৌকায় করে ফেয়ারলোপ নদী পার হয়ে কনে পৌঁছান আপমিনস্টারে। সেখান থেকে পালকিতে করে পান পাতায় মুখ ঢাকা কনেকে নেওয়া হয় গায়েহলুেদর মঞ্চে। সিলেট থেকে নেওয়া ঘাইল–সিয়ায় ধান ভানছেন কনের দুই বোন। মাঝে শিল–পাটায় হলুদ বাটছেন কনেপালকির পাশে পাশে হারিকেন হাতে কনের ছোট ভাই আবতাহি। বাবা-মা মঞ্চে গিয়ে উঠে পান পাতা সরিয়ে কনের মুখে আলতো করে হলুদ লাগালেন। চলতে থাকে হলুদ ছোঁয়ানো পর্ব। এরপর শুরু হয় গানের পালা। লোকগানের মূর্ছনায় অতিথিদের মাতিয়ে রাখেন স্থানীয় বাঙালি সংগীতশিল্পীরা। গায়েহলুদের পরদিন হলো ব্রাইডাল শাওয়ার অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের ধারায় রীতিমতো শিল-পাটায় পেষা হয় কাঁচা হলুদ আর মেহেদিপাতা। সিলেট অঞ্চলের ঘাইল-সিয়াতে চলে ধান ভানা, সঙ্গে ধামাইল গান। কনেকে গোসল করানো হয় দুধ দিয়ে। বিয়ের পোশাকে হেলিকপ্টারে চড়ে কনে যান বিয়ের অনুষ্ঠানেবিয়ের ঠিক আগের সন্ধ্যায় বাড়ির বাগানে মেহেদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্ট্রবেরি, কমলার মতো ফল দিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন জিনিস। এ কদিনের আয়োজনে প্রতিটিতেই কাছের আত্মীয় ও বন্ধুরা ছিলেন আমন্ত্রিতের তালিকায়। সংখ্যাটা ৫০ জনের বেশি করেই ছিল। প্রত্যেক অতিথিকে অনুষ্ঠানের আবহের সঙ্গে মিলিয়ে উপহার দেওয়া হয়েছিল পোশাকও। গত ১৯ আগস্ট হয় সাবরিনা-বাছিতের বিয়ের মূল অনুষ্ঠান। এটির আয়োজন হয় পূর্ব লন্ডনের হ্যানল্টের দ্য উইলোস ব্যাংকোয়েটিং হলে। বর-কনের জন্য সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো হয় বিরাট মঞ্চ। অতিথিদের জন্যও ছিল চোখধাঁধানো আয়োজন। ১ হাজার ১০০ অতিথির প্রত্যেকের জন্য ছিল নাম লেখা সুনির্দিষ্ট চেয়ার। প্রতিটি টেবিলে অতিথিদের জন্য ছিল উপহারও। বিয়ের আসরে সাবরিনা নাশিমুন আহমদ ও আবদুল বাছিতসাবরিনা নিজেই তাঁর বিয়ের পোশাক ডিজাইন করেন। গোলাপি সে পোশাক সোনা-হীরাখচিত। বিয়ের পোশাকে হেলিকপ্টারে চড়ে কনে যান বিয়ের অনুষ্ঠানে। অন্যদিকে সোনালি শেরওয়ানি-পাগড়ি পরে বর আসেন গাড়ির বহর নিয়ে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে কনে বিদায়ের আগেই লন্ডনের আকাশে ডুবে গেছে সূর্য। আঁধার নামা আকাশে আতশবাজির ঝলকানি দিয়ে শেষ হয় বাঙালি বিয়ের এই ম্যারাথন আয়োজন। এর আগে ৩ মে টেমস নদীতে রিভার প্রিন্সেস জাহাজে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই বিয়ের বাগদান। কনে ঘোড়ার গাড়িতে করে গিয়েছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। চলন্ত জাহাজে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চলে আয়োজন। এই বিয়ের আয়োজনে প্রাচুর্যও কম ছিল না। তবে বাঙালি সংস্কৃতির উপস্থাপন নজর কেড়েছে অতিথিদের। শরিফ আহমদ জানালেন উপলক্ষ উদ্যাপন করতে তিনি পছন্দ করেন। ‘এই কারণে মেয়ের বিয়েতে ভিন্ন মাত্রার এমন আয়োজন করেছি।’ যুক্তরাজ্যে লাখ লাখ পাউন্ড খরচ করে আয়োজন অনেক হয়। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে শিল-পাটা, ঘাইল-সিয়া, ধান, কাঁচা হলুদ, মেহেদিপাতা আনার কথা কে-ই বা ভাবেন? ভিন্ন সংস্কৃতির বিলেতে তাই সাবরিনা-বাছিতের বিয়ের আয়োজন ব্যতিক্রমীই বটে।