ব্রিটেনে ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন আজ

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন এমন নির্বাচনের মুখোমুখি আর হয়নি বলে বলা হচ্ছে। এর কারণ বৃহস্পতিবারের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর দেশটির ভবিষ্যতের অনেক কিছু নির্ভর করছে।

ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের প্রশ্নে প্রায় তিন বছর ধরে পার্লামেন্টে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে গত দু’বছরের মধ্যে এটি দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন।

প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনসারভেটিভ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে ফিরবে বলে আশা করছে, অন্যদিকে জেরেমি করবিনের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ব্রেক্সিটের পরিবর্তে তাদের নানা ধরণের রাষ্ট্রীয় কল্যাণমূলক কর্মসূচিকেই তাদের প্রচারণায় প্রাধান্য দিচ্ছে।

কেন এ নির্বাচন?

ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ২০১৬র গণভোটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে রায় দেয়।

তার আগের কয়েক দশক ধরে ব্রিটেন এবং ইইউর অর্থনীতি এবং বাণিজ্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল।

তাই গণভোটের পরই কথা ওঠে যে ইইউ ত্যাগ করার ফলে যাতে অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কোন ক্ষতি না হয়, দু-অংশের জনগণ চাকরিবাকরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা ভোগ করতেন সেগুলোতে কোন ছেদ যেন না পড়ে – তাই ব্রেক্সিট কীভাবে হবে তা আগে থেকেই একটা চুক্তির ভিত্তিতে স্থির করে নিতে হবে।

নির্বাচনী প্রচারে বরিস জনসন
নির্বাচনী প্রচারে বরিস জনসন

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং তার আগে প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে এরকম চুক্তি করে এসেছিলেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে । কিন্তু তা তারা পার্লামেন্টে পাস করাতে পারেন নি। কারণ কনসারভেটিভ পার্টির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না, তাদের কোয়ালিশন অংশীদার ওই চুক্তিকে সমর্থন করে নি, এবং চুক্তিটি যে লেবার পার্টি সহ অন্য বিরোধীদলগুলোর সমর্থন পাবে – তাও হয়নি।

ফলে টেরিজা মে তিন বার এবং বরিস জনসন একবার পার্লামেন্টে তুলেও তাদের ব্রেক্সিট চুক্তি পাস করাতে পারেননি।

পার্লামেন্টে সৃষ্টি হয় ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন তিক্ততা ও বিভক্তি, এবং অচলাবস্থা। ব্রেক্সিট হবে কি হবে না – এই অনিশ্চয়তায় ব্যবসাবাণিজ্যে তৈরি হয়েছে স্থবিরতা ।

লেবার পার্টির প্রচারাভিযানে জেরেমি করবিন
লেবার পার্টির প্রচারাভিযানে জেরেমি করবিন

অনেকে বলছেন, ব্রিটেনে রাজনীতিবিদদের ওপর জনগণের আস্থাই কমে যাচ্ছে। কনসারভেটিভ এবং লেবার দু দলই ব্রেক্সিট চাইছে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ।

এ অবস্থার সমাধানের জন্যই নতুন এই নির্বাচন দেয়া হয়েছে – যাতে কোন একটি দল সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসে ব্যাপারটাকে সামনে এগিয়ে নিতে পারে।

কেন এ নির্বাচনকে ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’ বলা হচ্ছে?

এর একটি কারণ ব্রেক্সিট, অপরটি হলো এ নির্বাচনের পটভূমি – যে নজিরবিহীন তিক্ততা, বৈরিতা এবং বিভক্তির প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচন হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, ব্রেক্সিট হবে কিনা বা কীভাবে হবে তা নির্ধারিত হবে এ নির্বাচনে।

ব্রেক্সিট যদি হয়, তাহলে তা ব্রিটেনের সমাজ ও অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসবে ।

কিন্তু যারা ব্রেক্সিটের বিরোধী তারা বলছেন, এর পরিণতিতে যুক্তরাজ্য ভেঙে যেতে পারে – কারণ স্কটল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে জোর জনমত আছে।

অন্য দিকে ব্রেক্সিটের প্রতিক্রিয়া পড়বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওপরও – অনেকের মতে ইইউর ঐক্যও হুমকির মুখে পড়তে পারে। এক কথায় গোটা ইউরোপেই অনেক সুদূর প্রসারী পরিবর্তন আসতে পারে, এবং এগুলো সবই ঘটতে পারে ব্রেক্সিটের কারণে ।

আর এ নির্বাচনের পরিণতিতে ব্রেক্সিট যদি না হয় – তাহলে অনেকের মতে ব্রিটেনে এক গভীর রাজনৈতিক সংকট দেখা দেবে।

ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে নাগরিক বিক্ষোভ
ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে নাগরিক বিক্ষোভ

জনগণের একাংশের মধ্যে গুরুতর বিভক্তি ও অবিশ্বাস সৃষ্টি হবে, রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাজনীতিবিদদের প্রতি সৃষ্টি হবে জনগণের গভীর অনাস্থা। অনেকে সামাজিক সংঘাতের আশংকাও প্রকাশ করছেন।

তাই বলা হচ্ছে এটা যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন।

ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনের ঘটনাবলীকে ‘নজিরবিহীন’ বলা হচ্ছে কেন?

ব্রেক্সিটকে নিয়ে সমাজে এবং রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে তীব্র মতবিরোধ, তিক্ততা এবং বিভক্তি। ঘটেছে এমন সব ঘটনা যা ব্রিটেনে নিকট অতীতে দেখা যায় নি – বলেছেন অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক।

ব্রেক্সিটকে কেন্দ্র করে আদালতে মামলা হয়েছে। একটি দল ব্রেক্সিট বাতিল করাকে তাদের প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার বানিয়েছে।

পার্লামেন্টে বার বার ভোট করেও ব্রেক্সিট প্রস্তাব পাস করাতে না পেরে পদত্যাগ করেছেন পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে।

বরিস জনসনও তার প্রস্তাব পাস করাতে পারেন নি। এর পর তিনি পার্লামেন্ট স্থগিত করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আদালতের রায়ে তার সে পদক্ষেপ খারিজ হয়ে পার্লামেন্ট আবার বসে।

লেবার ও কনসারভেটিভ উভয় দলেরই বেশ কিছু এমপি দল ছেড়েছেন। কেউ নতুন দল করেছেন, কয়েকজন প্রথম সারির রাজনীতিক রাজনীতি থেকে কার্যত বিদায় নিয়েছেন।

কয়েকজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ প্রকাশ্যেই জানিয়েছেন, তারা এবার তাদের নিজস্ব দলকে ভোট দেবেন না – তারা ভোটারদেরকে অন্য দলের পক্ষে ভোট দেবার আহ্বান জানিয়েছেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট নিয়ে তৈরি হয়েছিল অচলাবস্থা
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রেক্সিট নিয়ে তৈরি হয়েছিল অচলাবস্থা

বহু এমপি বলছেন, তারা হত্যার হুমকি পেয়েছেন, সন্দেহ করা হয় যে ২০১৬ সালে জো কক্স নামে একজন এমপি খুন হবার পেছনেও কারণ ছিল ব্রেক্সিট।

এরকম নানা নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে গত তিন বছরে। এতে ব্রিটেনের রাজনীতিতে যে তিক্ততা এবং বিভক্তি তৈরি হয়েছে – তাও নজিরবিহীন।

জনমত জরিপ কী বলছে, কারা যাবে ক্ষমতায়

নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই জনমত জরিপগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কনসারভেটিভ পার্টি এগিয়ে আছে। তারা প্রধান বিরোধী দল জেরেমি করবিনের লেবার পার্টির চাইতে বিভিন্ন সময় অন্তত ৬ থেকে ১৫ পয়েন্টের বেশি ব্যবধানে এগিয়ে ছিল।

কিন্তু একেবারে সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে এই ব্যবধান কিছুটা কমে এসেছে।

সবশেষ জরিপে দেখা যাচ্ছে কনসারভেটিভ পার্টিকে ৪৩ শতাংশ এবং লেবার পার্টিকে ৩৩ শতাংশ ভোটার সমর্থন করছে বলে বলা হচ্ছে।

তবে এসব জনমত জরিপ কতটা নির্ভরযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্রিটেনের ইতিহাসে এসব জনমত জরিপের ভবিষ্যদ্বাণী কখনো সঠিক হয়েছে, কখনো ভুলও হয়েছে।

নির্বাচনী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবধান কমে আসার ফলে কনসারভেটিভ পার্টি সবচেয়ে বেশি আসনে জিতলেও সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাবার সম্ভাবনা এখন আগের চাইতে বেড়ে যাচ্ছে।

টিভিতে মুখোমুখি বিতর্কে বরিস জনসন ও জেরেমি করবিন
টিভিতে মুখোমুখি বিতর্কে বরিস জনসন ও জেরেমি করবিন

যদি ঝুলন্ত পার্লামেন্ট হয়, তাহলে যে অনিশ্চিত অবস্থা থেকে বেরুনোর জন্য এ নির্বাচন হচ্ছে – সেই একই অবস্থা ব্রিটেন আবার ফিরে আসতে পারে।

ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষে আসন সংখ্যা ৬৫০টি। স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হলে কোন একটি দলকে ৩২৬টি আসন পেতে হবে। তাই বরিস জনসন বা জেরেমি করবিন – দুজনেরই আসল লক্ষ্য হচ্ছে শুধু সবচেয়ে বেশি আসনে জেতা নয় – একটা স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া।

তাই জনমত জরিপ যাই বলুক – আসলে কি হবে তা বোঝা যাবে বৃহস্পতিবার ভোটের ফল আসতে শুরু করার পরই।

এক গভীর অনিশ্চিত, বৈরী এবং তিক্ত পরিস্থিতির মধ্যে ব্রিটেনের নির্বাচন হচ্ছে
এক গভীর অনিশ্চিত, বৈরী এবং তিক্ত পরিস্থিতির মধ্যে ব্রিটেনের নির্বাচন হচ্ছে

ভোটারদের কাছে মূল ইস্যু কী?

বিবিসির জরিপ বলছে, ৬০ ভাগেরও বেশি উত্তরদাতার কাছে ব্রেক্সিট প্রধান ইস্যু।

বেশ কিছুটা পেছনে দ্বিতীয় স্থানে আছে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা অর্থাৎ এনএইচএসের উন্নয়ন।

এর পরে আছে অপরাধ দমন, অর্থনীতি, অভিবাসন ইত্যাদি।

তাই জনমত জরিপ অনুযায়ী ব্রেক্সিটই আসল ইস্যু। কনসারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলছেন ‘গেট ব্রেক্সিট ডান’ – এটাই তার প্রধান এজেন্ডা।

অন্যদিকে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন – ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা, কর্মসংস্থান, দরিদ্রদের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা – এগুলোকেই মূল ইস্যু করে তুলতে চাইছেন।

দু দলের দিক থেকেই এজন্য নানা রকম আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে ভোটারদের কাছে।


Spread the love

Leave a Reply