ভাষা আন্দোলনে সিলেট: এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ( ১ম পর্ব )
পুলিশের গুলিতে ছাত্র, জনতা হত্যার প্রতিবাদে সিলেটের নারী সমাজ আবারো প্রতিবাদে ফেটে পড়েন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে ঢাকায় পুলিসের গুলিতে নিহত ভাষা শহীদরের প্রতি শ্রদ্ধা জনান। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিছিলে সিলেটের মহিলারা স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়ে বেলা ১১টায় শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করেন। মিছিলটি গোবিন্দ চরণ পার্কে এসে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তৃতা করেন সিলেচের মাহিলা ও ছাত্রী নেত্রীবৃন্দ। পর দিন’ই মুসলিম সাহিত্য সংসদ হলে (বর্তমানে শহীদ সুলেমান হল) এক মহিলা সমাবেশ করেন এবং বিকালে গোবিন্দচরণ পার্কে সিলেট মহিলা কলেজের ছাত্রী-শিক্ষকদের আয়োজনে কলেজের অধ্যাপক আবদুল মালেকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা ভাষার দাবিতে বিরাট জনসভা।
ভাষা আন্দোলনে মহিলাদের মধ্যে সিলেটে আরো ভূমিকা রাখেন যারা তারা হচ্ছেন বেগম রাবেয়া আলী, ছালেহা বেগম, লুৎফুন্নেছা বেগম। নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদ আলীর স্ত্রী হাজেরা মাহমুদ, সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর স্ত্রী মিসেস রাবেয়া আলী, অধ্যাপক শাহেদ আলীর স্ত্রী বেগম চমন আরা, সরকারি চাকুরে হয়েও স্বামীর মতো ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে তিনিও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। মিসেস লুৎফুন্নেছা বেগমের স্বামী সেনা বিভাগের কর্মকর্তা হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
সিলেটের কুলাউড়ার মেয়ে সালেহা বেগম ময়মনসিংহ মুসলিম গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী থাকাকালীন ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী স্কুলের সামনে কালো পতাকা উত্তোলণ করেন। ছাত্রী সালেহা বেগমের এই সাহসী উদ্যোগকে রাষ্ট্রীয় অপরাধ আখ্যা দিয়ে পাকিস্থান কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ময়মনসিংহের ডিসি ডি কে পাওয়ারের আদেশে স্কুল থেকে তাঁকে তিন বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। সালেহা বেগমের পক্ষে আর পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তিনি হচ্ছেন ভাষা আন্দোলনের ‘শিক্ষাজীবন’ শাহাদতকারী একমাত্র ছাত্রী।
সিলেটের আরেক ভাষা সৈনিক কন্যা রওশন আরা বাচ্চু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকা কালে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করা ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলের ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সুসংগঠিত করেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী প্রথম ছাত্রীদলের অন্যতম অদমনীয় নেত্রী ছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। তিনি ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটের কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা এএম আরেফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্ট’ এ যোগ দিয়ে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইম্যান স্টুডেন্টস্ রেসিডেন্স এর সদস্য নির্বাচিত হন।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ২০ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হলে সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। এ সময় যেসব ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করাই আন্দোলনের জন্য প্রয়োজন বলে মনে করেন রওশন আরা বাচ্চু তাদের অগ্রভাগে ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় আহূত ছাত্রজনতার সমাবেশে ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয় সহ অন্যান্য স্থান থেকে ছাত্রীদের সংগঠিত করে সমাবেশস্থলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যারা কাজ করেছেন রওশন আরা বাচ্চু ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। ।
রওশন আরা বাচ্চু সাহসী নেতৃত্বে এখান থেকেই ছাত্রনেতারা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেন। তারা পুলিশের কাটাতারের ব্যারিকেড টপকিয়ে মিছিল নিয়ে এগুনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশের বাধার মুখে কাটাতারের ব্যরিকেড টপকানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সংকটময় সময়ে বজ্রকণ্ঠে স্বপথ নিয়ে রওশন আরা বাচ্চু তার দলের সবাইকে নিয়ে পুলিশের তৈরি এই অতিক্রম-অসাধ্য ব্যারিকেড ভেঙ্গে ফেলে এগিয়ে যেতে থাকেন।। এরপর পুলিশ প্রথমে লাঠিচার্জ ও পরে গুলি বর্ষণ শুরু করে দেয়। এতে আব্দুস সালাম, আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমদ, আব্দুল জব্বার ও শফিউর রহমান শাহাদাত বরণ করেন এবং রওশন আরা বাচ্চু সহ অনেক ছাত্রী গুরুতর আহত হন।
সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে একটি স্মৃতিচারণে সিলেটের এই ভাষাসৈনিক নারী নেত্রী রওশন আরা বাচ্চু বলেন, “সকাল দশটার দিকে দেখি একটি জিপ এবং ৩/৪টি ট্রাক এসে দাড়ালো এবং পুলিশ বাহিনী ইউনিভার্সিটির গেটটা ঘেরাও করলো। পুলিশ আমাদের মিছিলে লাঠিচার্জ করলো। অনেক মেয়ে আঘাত পেলো, আমিও আঘাত পেয়েছিলাম। আমরা দৌড়ে যাচ্ছিলাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো স্মারকলিপি পৌছে দেয়া। কিন্তু আমাদের পথে মেডিকেলের মোড়েই তখন শেল পড়ছে, চারদিক কাদুনে গ্যাসে অন্ধকার। তখন আবার গুলির শব্দ পেলাম। এরপর তার কাটার বেড়া পার হয়ে ওসমান গনি সাহেবের বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখি সারা তৈফুর, সুফিয়া ইব্রাহিম, বোরখা শামসুন। তারা আমার এ রক্তাক্ত অবস্থা দেখে এগিয়ে এল। ”
সিলেটের সুনাম গঞ্জের অধ্যাপক শাহেদ আলীর সহধর্মীনি বেগম চেমন আরা প্রথম সারির একজন মহিলা ভাষা সৈনিক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী থাকাবস্থায় স্বামী অধ্যাপক শাহেদ আলীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫২ এর ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা শহীদ বরকতের রক্তাক্ত শার্ট নিয়ে যে মিছিল বের করে ছিলেন তাতে তিনিও সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
এভাবে অন্যান্য জেলার তুলনায় সিলেট শহরে এবং ঢাকায় অবস্থানরত সিলেটের নারীরা ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ছিলেন, যা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল মাইলফলক।