ভাস্কো ডা গামা যেভাবে ভারতে পৌঁছেছিলেন
কলম্বাস যখন ভারতের খোঁজে বেরিয়ে আমেরিকায় পৌঁছে গেলেন, তখন পর্তুগালের রাজা জন ভারতে পৌঁছানোর জন্য নতুন সমুদ্রপথ খুঁজতে শুরু করেছিলেন। একই সঙ্গে তিনি তিনটি বড় জাহাজ তৈরিরও নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই সময়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন রাজা জন।
ভারতে পৌঁছানোর সে ইচ্ছা পূরণ হওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়। তবে তার উত্তরাধিকারী এমানুয়েলের মনেও ভারতে পৌঁছানোর দৃঢ় সংকল্প ছিল। সেই যাত্রার কমান্ডার হিসাবে তিনি ভাস্কো ডা গামাকে বেছে নিয়েছিলেন।
যাত্রাপথে সঙ্গী হওয়ার জন্য অন্য দুটি জাহাজের কমান্ডার হিসাবে নিজের ভাই পাওলো ও বন্ধু নিকোলাস কোয়েলোকে নিযুক্ত করেন।
২৫ মার্চ ১৪৯৭ সাল, রবিবার সকালবেলায় লিসবঁর রাস্তা লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। সবাই বুঝতে পারছিলেন সেদিন একটা বড় ঘটনা হতে চলেছে।
এক চৌমাথার মোড়ে গির্জায় নিজের মন্ত্রীদের সঙ্গে সিংহাসনে বসেছিলেন পর্তুগালের রাজা আর রাণী। তাদের সামনে ঝুলছিল একটা পর্দা।
গির্জার বিশপ ভাস্কো ডা গামার অভিযানের জন্য বিশেষ প্রার্থনা করছিলেন তখন।
প্রার্থনা শেষ হতেই পর্দার বাইরে এলেন পর্তুগালের রাজা এমানুয়েল। তিনটি জাহাজের তিন কমান্ডার হাঁটু মুড়ে বসে অভিবাদন জানালেন রাজাকে।
যাত্রার শুরুতেই ভয়ানক ঝড়
রাজার হাতে চুম্বন করে ভাস্কো ডা গামা একটা আরবি ঘোড়ার পিঠে চেপে বসলেন। শোভাযাত্রা শুরু হল।
একেবারে সামনে চলছিল ভাস্কো ডা গামার ঘোড়াটি। তার পিছনেই ছিল ভাই পাওলো আর বন্ধু নিকোলাসের ঘোড়া দুটি। তাদের পিছনে ঝাঁ চকচকে পোশাক পরে পায়ে পা মিলিয়ে মার্চ করতে করতে যাচ্ছিলেন জাহাজের নাবিক দল।
ভাস্কো ডা গামাদের মিছিলটা বন্দরে পৌঁছাতেই তাদের স্বাগত জানাতে শুরু হল তোপধ্বনি। ভাস্কো ডা গামা ঘোড়া থেকে নেমে নিজের জাহাজ ‘সৈন রাফেল’-এ উঠে গেলেন।
জাহাজটা যখন ধীরে ধীরে বন্দর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেখানে হাজির হাজার হাজার মানুষ হাত নেড়ে বিদায় জানালেন ভাস্কো ডা গামাকে।
ভাস্কো ডা গামাও হাত নেড়ে অভিবাদন করলেন জনতাকে।
তবে প্রথম দিনেই এত প্রবল হাওয়া বইছিল যে ভাস্কো ডা গামার জাহাজটি খুব বেশি এগোতে পারে নি।
তৃতীয় দিন আবহাওয়া কিছুটা বদলালো। ভাস্কো ডা গামা রওনা হলেন তার জাহাজ নিয়ে।
ইতিহাসবিদ জর্জ এম টোলে তার বই ‘দ্য ভয়েজেস অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার্স অফ ভাস্কো ডা গামা’তে লিখেছেন, “তিনটি জাহাজই একসঙ্গেই এগোচ্ছিল। এতটাই কাছাকাছি ছিল জাহাজগুলো যে কমান্ডারেরা ডেকের ওপরে দাঁড়িয়েই একে অপরের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন।
জাহাজগুলো যখন কনারি দ্বীপ ছাড়ালো, তারপরেই শুরু হয় এক ভয়াবহ ঝড়।
ঢেউ শান্ত হওয়ার পরে ভাস্কো ডা গামার জাহাজ ‘সৈন রাফেল’কে আর কোথাও দেখা গেল না। কিন্তু পাওলো আর কোয়েলোরা তাদের নিজেদের জাহাজ নিয়ে কেপ ওয়ার্ডের দিকে এগোতে লাগলেন।
জর্জ এম টোলে লিখেছেন, তারা যখন কেপ ওয়ার্ডে পৌঁছলেন, সেখানে ভাস্কো ডা গামার জাহাজ আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল। জাহাজের ডেকে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধরে যেন প্রাণ এল পাওলো আর কোয়েলোর।
তারা বিউগল বাজিয়ে আর তোপ দেগে সেই পুনর্মিলন উদযাপন করলেন।
মি. টোলে আরও লিখেছেন, “বেশ কয়েক মাস ধরে চলার পরে ভাস্কো ডা গামা আর তার সহযাত্রীরা সেন্ট হেলেনায় পৌঁছলেন। সেখানকার কিছু বাসিন্দা ভাস্কো ডা গামার দলবলের ওপরে হামলা করে। ভাস্কো ডা গামার গায়েও তীর লেগেছিল, যদিও কারও মৃত্যু হয় নি।”
জাহাজে শুরু হল বিদ্রোহ
ভাস্কো ডা গামার দল তিনটি জাহাজে আরও বেশ কিছুদিন যাত্রা করার পরে আরও একটা বড় ঝড়ের সম্মুখীন হল।
সেটা এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল যে জাহাজের ডেক পুরো জলে ডুবে গিয়েছিল। হাওয়ার বেগ এতটাই ছিল যে নাবিকরা যাতে উড়ে না যান, সেজন্য নিজেদের দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন।
হাওয়া আর জলের স্রোতে মনে হচ্ছিল যেন জাহাজটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। নাবিকরাও ঘাবড়িয়ে গিয়ে ভাস্কো ডা গামার কাছে পর্তুগালে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করতে থাকলেন।
কিন্তু নাবিকদের কথা মানতে চান নি ভাস্কো ডা গামা। তার স্পষ্ট কথা ছিল, “হয় আমরা ভারতে যাব, নাহলে এখানেই মরব।”
আরেকজন ইতিহাসবিদ সঞ্জয় সুব্রহ্মনিয়াম “দ্য কেরিয়ার অ্যান্ড লিজেন্ড অফ ভাস্কো ডা গামা’ বইতে লিখেছেন, “যখন ঝড় কিছুটা কমল তখন তিনটে জাহাজ ধীরে ধীরে কিন্তু একসঙ্গেই চলতে শুরু করে।
‘সৈন রাফেল’এর নাবিকরা অন্য দুটি জাহাজ – ‘সৈন গ্যাব্রিয়েল’ আর ‘সৈন মিগুয়েল’এর নাবিকদের উস্কানি দিতে লাগল যাতে তারা ক্যাপ্টেনদের আদেশ পালন না করেন।”
“এই বিদ্রোহ থামাতে ভাস্কো ডা গামা সব নাবিককে আটক করে দেন আর তাদের বলা হয় যে যতক্ষণ পর্তুগালে ফিরে না যাওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ সবাইকে বেড়ি পড়িয়ে বেঁধে রাখা হবে।
ভাস্কো ডা গামার এই পদক্ষেপ বিদ্রোহ সম্পূর্ণভাবে থামিয়ে দেয়,” লিখেছেন মি. সুব্রহ্মনিয়াম।
মালিন্ডির রাজা স্বাগত জানালেন ভাস্কো ডা গামাকে
প্রবল ঝড়ে তিনটে জাহাজেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। বেশ কিছু জায়গায় জাহাজ ফুটোও হয়ে গিয়েছিল।
খাবার জলেরও অভাব দেখা দিচ্ছিল জাহাজে। রান্নার জন্য সমুদ্রের জল ব্যবহার করতে হচ্ছিল।
দিন দশেক পরে ভাস্কো ডা গামার দল তিনটে জাহাজ নিয়ে একটা বড় নদীর মোহনায় পৌঁছান। সেখানেই তিনি নোঙ্গর করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনটে জাহাজই ভালো করে পরীক্ষা করা হল। দেখা গেল ‘সৈন মিগুয়েল’ আর এগিয়ে যাওয়ার অবস্থায় নেই।
তাই সেটিকে সেখানেই ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। ওই নাবিকদের বাকি দুটি জাহাজে তুলে নেওয়া হল।
মার্চ মাসের শেষ নাগাদ ভাস্কো ডা গামা আফ্রিকার মোজাম্বিক বন্দরে পৌঁছান। কিন্তু সেখানকার শেখের বিরূপ মনোভাব দেখে তারা এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
সমুদ্র তীর ধরে চলতে চলতে ভাস্কো ডা গামা পৌঁছান কাছেই মালিন্ডির উপকূলে। সেখানকার রাজা ভাস্কো ডা গামাকে স্বাগত জানান।
রাজা নিজেই এসেছিলেন ভাস্কো ডা গামার জাহাজে। একটা চেয়ার দিয়ে ভাস্কো ডা গামা রাজাকে বসতে বলেন। এক আফ্রিকান ক্রীতদাস দোভাষীর কাজ করছিলেন।
রাজার কাছে যখন ভাস্কো ডা গামা এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইলেন, তখন রাজা বললেন পরের তিন মাস তার ওখানেই অপেক্ষা করা উচিত, তারপরে সমুদ্রের হাওয়া অনুকূল হবে যাতে তিনি ভারতের দিকে এগোতে পারবেন।
ভাস্কো ডা গামা ওই সময়টা জাহাজের মেরামতির জন্য ব্যবহার করলেন। জাহাজে খাওয়ার জল ভরা হল, মাংস, সবজি আর ফল ভরা হল যা পরবর্তী সফরে কাজে লাগে।
দেখা গেল ভারতের তটরেখা
অগাস্টের ছয় তারিখ ভাস্কো ডা গামা মালিন্ডি থেকে রওনা হয়েছিলেন। ততদিন পর্যন্ত তিনি তীর ধরেই এগোচ্ছিলেন।
কিন্তু এবার তাকে প্রথমবারের মতো গভীর সমুদ্রে পড়তে হল। এর মধ্যেই তিনি মালিন্ডি থেকে সঙ্গে নেওয়া কয়েকজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের কাছ থেকে দোভাষীর মাধ্যমে ভারত সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করতে লাগলেন।
প্রায় ১৯ দিন পরে মালিন্ডি থেকে জাহাজে ওঠা এক পাইলট ভাস্কো ডা গামার সামনে এসে বললেন, “ক্যাপ্টেন, আমার মনে হচ্ছে ভারতের তট বেশ কাছেই এসে গেছে। হয়তো আমরা কাল সকালেই তটরেখা দেখতে পাব।“
সেই রাতে ভাস্কো ডা গামা ঠিকমতো ঘুমোতে পারেন নি।
ঐতিহাসিক জর্জ এম টোলে লিখছেন, “সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে খুব সকালেই ভাস্কো ডা গামা জাহাজের ডেকে চলে এসেছিলেন। তার দৃষ্টি ছিল পুব দিকে, যাতে তটরেখাটা তার চোখেই পড়ে।
তখনই নাবিকদের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল, ‘তট দেখা যাচ্ছে, তট দেখা যাচ্ছে’ বলে।
কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই জাহাজের পাইলট ভাস্কো ডা গামার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে পূর্বদিকে আঙ্গুল তুলে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ক্যাপ্টেন, ওই যে ভারতের তটরেখা।
সেখানে হাজির সব নাবিকদের চোখে মুখে তখন আনন্দ, অনেকেই কাঁদছেন।
ভাস্কো ডা গামা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। তার সঙ্গীরাও তাকে অনুসরণ করল।“
জাহাজ ঘিরে ফেলল স্থানীয়দের নৈাকা
উপকূলের বাসিন্দারা যখন দেখল যে একটা জাহাজ নোঙর করেছে, তখন জেলেরা তাদের নৌকা নিয়ে জাহাজের কাছে চলে এল।
তারাই জানিয়েছিল যে সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে আরও ১২ মাইল দূরে কালিকট।
ভাস্কো ডা গামা দূর থেকেই কালিকটের গম্বুজ আর মিনারগুলো দেখতে পাচ্ছিলেন।
পরের দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ কিছু নৌকা ভাস্কো ডা গামার জাহাজ দুটো ঘিরে ফেলল।
সেই নৌকাগুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ ভারতীয়রা সওয়ার ছিল। তারা খালি গায়ে থাকলেও শরীরের নিম্নাংশ নানা রঙের কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল।
তারা এটা জানতে চাইছিল যে কারা এসেছে জাহাজে চেপে, আর কেনই বা এসেছে। ওই নৌকাগুলির মধ্যে কিছু নৌকা ছিল জেলেদের।
ভাস্কো ডা গামা তাদের দেখতে পেয়েই নৌকায় থাকা মাছ কিনে নিতে চাইলেন। কিছু লোক ততক্ষণে কালিকটে গিয়ে সেখানকার রাজা জমোরিনকে জানিয়েছে যে, কিছু অজানা লোক এসে পৌঁছেছে কূলে।
রাজা তাদের আদেশ দিলেন যে কিছু ডুমুর, নারকেল আর মুর্গি নিয়ে ওই জাহাজে ফিরে যেতে। আগন্তুকদের ব্যাপারে যতটা যা জানা যায়, সেই চেষ্টা করতে বললেন রাজা।
রাজার জন্য উপহার নিয়ে হাজির হলেন ভাস্কো ডা গামা
বেশ কয়েক দিন শলা পরামর্শ করার পরে ভাস্কো ডা গামা ঠিক করলেন যে তিনি রাজা জমোরিনের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন।
উপহার দেওয়ার জন্য সঙ্গে করে লাল কাপড়, মখমল, হলুদ সাটিনের কাপড়, ৫০টি টুপি, ৫০ টা হাতির দাঁতের তৈরি চাকু আর দামী কাপড় দিয়ে মোড়া একটা চেয়ার নিলেন ভাস্কো ডা গামা।
ইতিহাসবিদ সঞ্জয় সুব্রহ্মনিয়াম লিখছেন, “ভাস্কো ডা গামা নীল সাটিনের কাপড়ের একটা গাউন পরেছিলেন। তার কোমরে বেল্টে বাঁধা ছিল সোনার হাতল লাগানো একটা ছোরা।
মাথায় পরেছিলেন নীল মখমলের টুপি, যার ওপরে সাদা পালক ছিল। পায়ে ছিল সাদা রঙের জুতো। সামনে ১২ জন রক্ষী চলছিল। তাদের হাতে ছিল রাজার জন্য নানা উপহার। তাদেরও সামনে কয়েকজন নাবিক বিউগল বাজিয়ে চলেছিলেন।“
চারদিকে এত ভিড় জমেছিল আগন্তুকদের দেখার জন্য যে ভাস্কো ডা গামাকে কোনওরকমে পদপিষ্ট হওয়া থেকে বাঁচানো গিয়েছিল।
তখন ভাস্কো ডা গামার মনে হচ্ছিল, “ইশ, যদি পর্তুগালের মানুষ দেখতে পেত যে কীভাবে তাকে ভারতে স্বাগত জানানো হচ্ছে!”
রাজা জমোরিনের মুখোমুখি ভাস্কো ডা গামা
ভাস্কো ডা গামা রাজা জমোরিনের সামনে পৌঁছে তিনবার মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন।
রাজা তার পাশে রাখা চেয়ারের দিকে দেখিয়ে ভাস্কো ডা গামাকে ইশারায় সেখানে বসতে বললেন। অতিথির সামনে রাখা হল ডুমুর, কলা আর কাঁঠাল। ফল খাওয়ার পরে পর্তুগালের মানুষদের তৃষ্ণা পেল।
জর্জ এম টোলে লিখেছেন, “তাদের বলা হল যে ঠোঁট না লাগিয়ে পাত্র থেকে জল খেতে হবে। তাদের হাতের তালুতে জল ঢেলে দেওয়া হয়, সেখান থেকেই তারা জল পান করেন।
পর্তুগালের মানুষরা যখন ওইভাবে জল পান করছিলেন, কয়েকজন গলায় জল আটকে বিষম খেলেন। কয়েকজনের পোশাকেও জল পড়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে জমোরিন হাসতে থাকেন।”
মি. টোলে আরও লিখেছেন, “ভাস্কো ডা গামা জমোরিনকে উদ্দেশ্য করে বলেন ‘আপনি মহান, সবথেকে শক্তিশালী রাজাদের একজন আপনি। সবাই আপনার পায়ের তলায়। পর্তুগালের রাজা আপনার মহান কীর্তির কথা শুনেছেন।
আপনার বন্ধুত্ব পাওয়ার জন্য আমার মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি। আপনি যদি চান তাহলে আরও জাহাজ আসবে সেখান থেকে আর আপনার মহত্বের কাহিনী জেনে তারা দেশে ফিরে যাবে। আমাদের সম্পর্কের ফলে কালিকটের বাণিজ্যও বাড়বে।“
রাজা জমোরিন এর জবাবে বলেন, “আপনি এখান থেকে যা নিতে চান সবই নিয়ে যেতে পারেন। আপনার সঙ্গে আসা মানুষরা শহরে গিয়ে মনোরঞ্জনও করতে পারেন। কেউ তাদের বিরক্ত করবে না।
কয়েক মাস পর পর্তুগালে ফেরেন ভাস্কো ডা গামা
রাজা জমোরিন ভাস্কো ডা গামাকে বেশ কিছু প্রশ্ন করেন, যেমন পর্তুগাল কত দূরে? ওই দেশটি কত বড়? সেখানে কি কি ফসল হয়? তাদের কাছে কতগুলো জাহাজ আছে? সেখানকার সেনাবাহিনী কত বড়?
ভাস্কো ডা গামা সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন।
রাজপ্রাসাদ থেকে যখন বাইরে বেরোলেন ভাস্কো ডা গামা, তখন তুমুল বৃষ্টি নামল। কোনও মতে একটা ঘোড়া যোগাড় করা হল, কিন্তু সেটার ওপরে কোনও গদি বা জিন কিছুই ছিল না।
তাই ভাস্কো ডা গামা ঘোড়ায় না চেপে বৃষ্টিতে ভিজেই হেঁটে হেঁটে ফেরার পথ ধরলেন।
কালিকটে কয়েক মাস কাটিয়ে ১৪৯৮ সালের নভেম্বর মাসে পর্তুগালে ফেরার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ততদিনে ১৯ মাস কেটে গেছে।
কালিকট থেকে ভাস্কো ডা গামা গোয়া গেলেন।
সেখানে রাত্রিবেলার ভাস্কো ডা গামার জাহাজেও ওপরে হামলা চালানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু ভাস্কো ডা গামা আর তার সঙ্গীরা সেই হামলা প্রতিহত করেন।
পর্তুগালের ফেরার পথে ভাস্কো ডা গামা আবারও মালিন্ডিতে থেমেছিলেন।
রাজা আবারও তার জন্য জাঁকজমকের মাধ্যমে স্বাগত জানান ভাস্কো ডা গামাকে।
সেখানে ১২ দিন কাটিয়ে পর্তুগালের দিকে রওনা হন ভাস্কো ডা গামা। যখন তার জাহাজ কেপ ওয়ার্ডে পৌঁছাল তখনই অসুস্থ হয়ে পড়লেন তার ভাই পাওলো।
পরের দিন মারা গেলেন পাওলো। সেখানই ভাস্কো ডা গামা ভাইয়ের অন্তিম সংস্কার করেন।
লিসবঁতে অভূতপূর্ব অভ্যর্থনা
ভাস্কো ডা গামা পর্তুগালে পৌঁছানোর আগেই তার সফল অভিযানের খবর সেখানে পৌঁছে গিয়েছিল।
যখন ভাস্কো ডা গামার জাহাজ বন্দরে পৌঁছল, তখন গোটা শহর তাকে সম্মান জানাতে সেখানে হাজির ছিল।
দূর থেকেই তিনি শুনতে পেলেন দুবার তোপ দাগার আওয়াজ। জাহাজ আরও কাছে আসতেই বন্দর থেকে বারে বারে তোপ দেগে স্বাগত জানানো হল তাকে।
জাহাজ থেকে ভাস্কো ডা গামা নামতেই সবার চোখে পড়ল যে তার দাড়ি খুব বড় হয়ে গেছে, চেহারাতেও বিষণ্ণতার ছাপ। তিনি রাজপ্রাসাদে পৌঁছানোর পরে রাজা এমানুয়েল সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানালেন।
ভাস্কো হাঁটু মুড়ে বসে রাজার হাত চুম্বন করলেন, কিন্তু রাজা এমানুয়েল তাকে উঠিয়ে নিয়ে আলিঙ্গন করলেন।
ভাস্কো ডা গামার অভিযান প্রায় আড়াই বছর চলেছিল। যখন তিনি যাত্রা শুরু করেছিলেন, তখন তার দলে ছিল ১০০ জন নাবিক, কিন্তু ফেরার সময়ে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছিল জনা তিরিশেকে।
তিনি যখন যাত্রা শুরু করেছিলেন, তখন তার জাহাজটা ছিল আনকোড়া নতুন, কিন্তু ফেরার পরে সেটা খুব পুরণো হয়ে গিয়েছিল।
এত বড় সামুদ্রিক অভিযানে রওনা হওয়ার অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল জাহাজটা।
তৃতীয়বার ভারতে এসে মৃত্যু হয় ভাস্কো ডা গামার
ভাস্কো ডা গামার দলের সঙ্গী সাথীদের পুরস্কার স্বরূপ প্রচুর ধনরত্ন দেওয়া হয়েছিল, তাদের পত্নীদের প্রত্যেককে পাঁচ কেজি করে মশলা দেওয়া হয়েছিল।
মৃত নাবিকদের পরিবারকে পুরো বেতন আর ভারত থেকে নিয়ে আসা নানা দ্রব্য দেওয়া হয়।
ভাস্কো ডা গামাকে রাজা এমানুয়েল ‘ডন’ উপাধি দিয়েছিলেন এবং তার জন্য পেনশনেরও ব্যবস্থা হয়েছিল।
তাকে সাইনিস গ্রামের ‘লর্ড’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ওই গ্রামেই ভাস্কো ডা গামার জন্ম হয়েছিল।
ধীরে ধীরে তার সুনাম গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। তাকে কলম্বাসের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখা হতে থাকে তাকে।
এরপর ১৫০২ সালে ভাস্কো ডা গামা আরও একবার কালিকটে এসেছিলেন।
এরপর আবার ১৫২৪ সালে তাকে ‘ভাইসরয়’ পদ দিয়ে তাকে কালিকটে পাঠানো হয়।
সেবছরই কোচিনে তার মৃত্যু হয়।
তার ১৪ বছর পরে তার পার্থিব শরীর পর্তুগালে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে রাজকীয় সম্মান নিয়ে তাকে দাফন করা হয়।