ভূমিমাইনের বিরুদ্ধে প্রচারণা সমর্থন করে ব্রিটিশ রাজনীতিকদের রোষের মুখে পড়েন প্রিন্সেস ডায়ানা

Spread the love

diana-7বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ  বিশ বছর আগে সক্রিয় মাইনক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে হেঁটে অবিস্ফোরিত ভূমি-মাইনের বিপদ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করেছিলেন সেসময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা প্রিন্সেস ডায়ানা।

ভূমিমাইনের বিপদ দেখতে দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ অ্যাঙ্গোলায় গিয়েছিলেন ডায়ানা- প্রিন্সেস অফ ওয়েলস ১৯৯৭ সালে।

তাঁর সেই ঐতিহাসিক সফর আয়োজনে সহায়তা করেছিলেন মাইন প্রতিরোধে সক্রিয় ব্রিটিশ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হেলো ট্রাস্টের পল হেসলপ। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি অ্যাঙ্গোলায় ট্রাস্টের প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ওই সফরে প্রিন্সেস ডায়ানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। ।

তিনি বলছিলেন হঠাৎ করেই তিনি জানতে পারেন প্রিন্সেস ডায়ানা ট্রাস্টের মাইন সরানোর কাজ দেখতে অ্যাঙ্গোলা যাচ্ছেন। হঠাৎ করে এত উচ্চ পর্যায়ের নামীদামী একজন তারকা ব্যক্তিত্বের সফরের খবরে তিনি দারুণ অবাক হয়েছিলেন।

”জানুয়ারির ৩ বা ৪ তারিখে খুব সকালে আমার মা ফোন করে বললেন প্রিন্সেস ডায়ানা হেলো ট্রাস্টের কাজ দেখতে অ্যাঙ্গোলা যাচ্ছেন। আমি মাকে বললাম আমি এখানে হেলোর কর্মসূচি ব্যবস্থাপক। প্রিন্সেস ডায়ানা এখানে এলে আমি নিশ্চয়ই জানতাম। এক ঘন্টা পর মা আবার ফোন করলেন- বললেন – খবরটা কিন্তু ঠিক- বিবিসিতে বলেছে ডায়ানা যাচ্ছেন হেলোর কাজ দেখতে।”

পল হেসলপ বলছিলেন মার কথা তিনি প্রথমে উড়িয়েই দিয়েছিলেন।

”আমি আবার বললাম- মা আমি প্রোগ্রাম ম্যানেজার- তিনি আসলে আমি জানতাম না? এরপর আমি হেলোর সদর দপ্তরে ফোন করলাম। ওরাও বলল- না না – উনি আসছেন -আর আমরা জানব না? আবার মায়ের ফোন এল- মা বললেন -তুমি জান না- এখন সব সংবাদমাধ্যমে খবর দিচ্ছে ডায়ানা হেলো আর আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের কাজ দেখতে যাচ্ছেন। এরপর আমি রেড ক্রসের জনসংযোগ বিভাগে ফোন করে জানতে চাইলাম- কী হচ্ছে? ওরা তখন বলল- ও হ্যাঁ তোমাদের বলতে ভুলে গেছি – দু সপ্তাহ পর প্রিন্সেস ডায়ানা অ্যাঙ্গোলা যাচ্ছেন।”

প্রিন্সেস ডায়ানার লুয়ান্ডা সফরের সময় বিভিন্ন ধরনের মাইন পরিদর্শন করেন প্রিন্সেস ডায়ানা 
প্রিন্সেস ডায়ানার লুয়ান্ডা সফরের সময় বিভিন্ন ধরনের মাইন পরিদর্শন করেন প্রিন্সেস ডায়ানা

পল বলছিলেন খবরটা শুনে তিনি দারুণ উৎসাহিত বোধ করেছিলেন; তার মনে হয়েছিল তারা সেখানে কী করছেন, কীভাবে করছেন, তা ”বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত নারীকে দেখানোর এটা বিরাট একটা সুযোগ”। আর যেহেতু তার এই সফর নিয়ে সংবাদমাধ্যমেরও খুবই উৎসাহ থাকবে, তাই তাদের কাজ বিশ্বের জনগণের সামনে উঠে আসবে বলেও তার মনে হয়েছিল।

১১ঘন্টার বিমানযাত্রার পর প্রিন্সেস ডায়ানা পৌঁছেছিলেন গরম আর ধুলায় ভরা লুয়ান্ডা শহরে। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী তিনি গিয়েছিলেন কাজের উপযোগী পোশাক – নীল জিনস আর জ্যাকেট পরে।

বিশ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশ অ্যাঙ্গোলা। সেখানে তখন মাত্র বিশ মাস আগে যুদ্ধ থেমেছে ভঙ্গুর একটা চুক্তির মধ্যে দিয়ে। শহরতলীর সর্বত্র তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পোঁতা রয়েছে দেড় কোটির বেশি মাইন।

বিমানবন্দরে নেমেই বিশ্বের সর্বত্র মাইন নিষিদ্ধ করার জন্য রেডক্রসের প্রচারণার সমর্থনে প্রকাশ্য বক্তৃতা দিলেন প্রিন্সেস ডায়ানা ।

তিনি বলেছিলেন, ”এই প্রচারণা শুরু করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত দেশ অ্যাঙ্গোলা। কারণ বিশ্বে জনগোষ্ঠীর হিসাবে মাইনের আঘাতে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানো মানুষের সংখ্যা অ্যাঙ্গোলাতেই সবচেয়ে বেশি।”

ডায়ানা যেসময় অ্যাঙ্গোলায় যান, সেসময় সেখানে প্রতি ৩৩০জনের মধ্যে একজনই ভূমিমাইন বিস্ফোরণে হাত পা হারিয়েছেন।

তাই বিশ্বব্যাপী মাইনের বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ করার জন্য ডায়ানার মর্মস্পর্শী আবেদন ছিল খুবই সময়োপযোগী।

কিন্তু ব্রিটেনের সরকারি নীতিকে অগ্রাহ্য করে তার এই আবেদন উস্কে দিয়েছিল বড়ধরনের বিতর্ক।

অ্যাঙ্গোলাতে ডায়ানার সফর নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ছিল চরম আগ্রহ। যেহেতু তিনি যেখানেই গেছেন, মিডিয়া তার পেছন পেছন গেছে, তাই ডায়ানা ঠিক করলেন এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তিনি বিষয়টি বিশ্বের সামনে নিয়ে আসবেন।

অ্যাঙ্গোলার রাজধানী লুয়ান্ডা থেকে ডায়ানা গেলেন অ্যাঙ্গোলার মধ্যাঞ্চলে কুইটো শহরে।

পল বলছিলেন প্রথমদিকে ডায়ানাকে একটু আড়ষ্ট বা নার্ভাস মনে হলেও পরে মাইন সরানোর কাজ নিয়ে প্রিন্সেস দারুণ আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন।

”যখন অন্য বিমানে আসা সাংবাদিকরা ঝাঁকে ঝাঁকে নামতে শুরু করলেন, তখন বুঝলাম কেন প্রিন্সেস নার্ভাস হয়ে আছেন। কারণ তিনি এমন জায়গায় পা রাখতে যাচ্ছেন, যেখান অসংখ্য মাইন পোঁতা আছে – বিশাল বিপদের ঝুঁকি রয়েছে। ঝুঁকির ব্যাপারটা মাথায় রেখেই তাকে সেখানে যেতে হচ্ছে অসংখ্য সাংবাদিকের ক্যামেরার সামনে দিয়ে। কোটি কোটি মানুষ সরাসরি দেখবে তার ঝুঁকিপূর্ণ মাইন এলাকায় যাওয়ার খবর।”

কাজেই মাইন নিয়ে তাঁর অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টিও তখন প্রিন্সেস ডায়ানাকে সম্ভবত ভাবাচ্ছিল বলে মনে হয়েছিল পলের।

” তবে প্রিন্সেসের নিরাপত্তার বিষয়টিই তখন আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল,” বলছিলেন হেলো ট্রাস্টের অ্যাঙ্গোলা প্রধান পল হেসলপ।

মাইনক্ষেত্রে প্রিন্সেস ডায়ানা অ্যাঙ্গোলার মাইনক্ষেত্রে প্রিন্সেস ডায়ানা

অ্যাঙ্গোলার গৃহযুদ্ধের সময় তুমুল লড়াই হয়েছিল কুইটোতে। প্রিন্সেস যুদ্ধ বিধ্বস্ত শহরে দুই ঘন্টা ধরে ঘুরে বেড়ান পলের সঙ্গে। তাদের সাথে ছিলেন আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের একজন প্রতিনিধিও।

পরের দিন তারা যান ওয়াম্বো শহরে- বিমানে কুইটো থেকে কয়েক ঘন্টার পথ।

সেখানে পৌঁছনর পর বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ব্যাপক উপস্থিতির মধ্যে ডায়ানা মাথায় বড় ও ভারী সুরক্ষা হেলমেট পরেন এবং গায়ে দেন বুলেট প্রুফ জ্যাকেট। এবং পলকে পাশে নিয়ে অল্প পথ পায়ে হেঁটে উন্মুক্ত মাইনক্ষেত্রে যান।

ট্রা‌স্টের পরিকল্পনা ছিল প্রিন্সেস ডায়ানা যখন মাইন পুঁতে রাখা এলাকা দিয়ে অল্প সময়ের জন্য হেঁটে যাবেন তখন প্রতীকীভাবে একটা ছোটখাট মাইনের উপর দিয়ে হাঁটার সময় সেটার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সেটি নিষ্ক্রিয় করা হবে। পল বলছিলেন তার দলের লোকেরা চেষ্টা করেছিল যাতে সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক হয়।

”আমরা এমনকী প্রিন্সেস আসার আগে একটা নকল মাইন ফাটিয়ে পরীক্ষাও করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আসল দিনে দেখা গেল, যে বোতাম তিনি পা দিয়ে টিপলে মাইনটা ফেটে নিষ্ক্রিয় হবে, সেটা ভেঙে গেছে। ফলে আমরা বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য গাড়ির ব্যাটারি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিলাম। ব্যাটারিটা গাড়ির পেছনে লুকানো থাকবে – ঠিক হল কাউন্টডাউন হবে- ৩-২-১ -ব্যাং- তখন মাইন বিস্ফোরিত হবে।”

পল বলেন এই পরিকল্পনার কথা শুনে প্রিন্সেস ডায়ানা বলেছিলেন ”১টা ধ্বংস হবে- কিন্তু আরও ১৭মিলিয়ন বাকি থাকবে।”

তবে প্রিন্সেসের নিরাপত্তা কর্মীরা প্রথমদিকে প্রিন্সেসের মাইনক্ষেত্রে যাওয়া নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন থাকলেও পরে তারা পলের কাছে স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন।

”সফর শেষে তারা যখন বিমানে উঠছেন – নিরাপত্তা দলের প্রধান আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলেন তাদের সফরের এই দুঘন্টা প্রিন্সেসের নিরাপত্তা নিয়ে তাদের সবচেয়ে কম মাথা ঘামাতে হয়েছে।”

কিন্তু ওই সফরে বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিমাইন নিষিদ্ধ করার জন্য ডায়ানার অনুমোদন শুধু বিতর্কেরই সৃষ্টি করেনি, ব্রিটেনের কিছু রাজনীতিককে তার এই পদক্ষেপ ক্রুদ্ধ করেছিল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডায়ানা ফিরে এলে বিষয়টি নিয়ে তারা তার সঙ্গে কথা বলবেন।

ঐ সফরে সাংবাদিকরা প্রিন্সেস ডায়ানাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন আপনি এই প্রচারে সমর্থন জানিয়ে “হঠকারিতার” পরিচয় দিয়েছেন। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

উত্তরে ডায়ানা বলেছিলেন, ”বিশ্বব্যাপী একটা সমস্যার কথা আমি শুধু তুলে ধরতে চেয়েছি। এটুকুই।”

“আমি রাজনীতিক নই- তা হতেও চাই না। আমি এসেছি অন্তরের টানে। আমি মানুষের দুঃখদুর্দশা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে চাই- সে অ্যাঙ্গোলার মানুষ হোক বা পৃথিবীর যে কোনো দেশের মানুষ হোক। আমি মানুষের জন্য কাজ করি- অতীতেও সবসময় করেছি- ভবিষ্যতেও করব,” বলেছিলেন প্রিন্সেস ডায়ানা।

বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পল হেসলপ বলেছিলেন ওই সফরে তার জন্য সবচেয়ে হতাশাজনক মুহূর্ত ছিল সাংবাদিকদের ওই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া।

অ্যাঙ্গোলায় মাইনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের দেখতে যান প্রিন্সেস ডায়ানাঅ্যাঙ্গোলায় মাইনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের দেখতে যান প্রিন্সেস ডায়ানা

”ওই প্রশ্নে তিনি খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন- খুবই অবাক হয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছিল তিনি বড় একটা সমস্যার বিষয় আন্তরিকভাবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়ত খানিকটা অনভিজ্ঞতার কারণেই রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝতে পারেননি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করার রাজনৈতিক তাৎপর্য কী হতে পারে তা আঁচ করতে পারেন নি।”

১৯৯৭ সালের ৩১শে অগাস্ট প্রিন্সেস ডায়ানা মারা যান প্যারিসে এক দুর্ভাগ্যজনক গাড়ি দুর্ঘটনায়। এর অল্পদিন পর ল্যান্ডমাইন নিষিদ্ধ করে ক্যানাডার ওটাওয়াতে গৃহীত আন্তর্জাতিক প্রস্তাব অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি দেন ব্রিটেনের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার । তিনি জানান ডায়ানার মৃত্যুর প্রথম বার্ষিকী আসার আগেই ব্রিটেন এই চুক্তিতে সই করবে।

১৯৯৭-র ডিসেম্বরে ১২২টি দেশের সরকার ভূমিমাইন নিষিদ্ধ করার চুক্তিতে সই করে। তবে এখনও বেশ কিছু বড় দেশ এই চুক্তি সই করতে রাজি হয়নি, যাদের মধ্যে রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া এবং চীন।

তবে পল মনে করেন প্রিন্সেসের ওই সফরের কারণেই শেষ পর্যন্ত ওই চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। এবং যে জোট ওই প্রস্তাব এনেছিল, সম্ভবত প্রিন্সেসের সফরের কারণেই তারা নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিল। অ্যাঙ্গোলাতে তার সফর দেখিয়েছিল সেই সময়কার বড় একটা মানবিক ইস্যু নিয়ে তিনি কতটা ভাবছেন এবং এর সঙ্গে তিনি কতটা একাত্ম।

পল বলেছেন দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন বিশ বছর পরে এসেও সমস্যাটা পুরোপুরি সমাধান হয়নি। “ডায়ানা এতই জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে অনেকের ধারণা তার জড়িত থাকার কারণে এই সমস্যার পুরো সমাধান হয়ে গেছে। আসলে তা নয়- এখনও অনেক কাজি বাকি।”

ইতিহাসের সাক্ষীর এই পর্ব পরিবেশন করেছেন মানসী বড়ুয়া।


Spread the love

Leave a Reply