ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে নাভালনির মরদেহ ‘লুকানোর’ অভিযোগ
ডেস্ক রিপোর্টঃ হত্যার অভিযোগের পর এবার পুতিনের বিরুদ্ধে আলেক্সেই নাভালনির মরদেহ লুকানোর অভিযোগ উঠেছে।
নাভালনির একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী কিরা ইয়ারমিশ বলেছেন, আর্কটিক কারাগারে মৃত্যুর একদিন পরেও ছেলের মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারেননি মা লিউডমিলা নাভালনায়া।
তিনি বলেন, নাভালনির মাকে বলা হয়েছিল যে, ময়নাতদন্ত শেষ হলেই মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।
অ্যালেক্সেই নাভালনিকে রাশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী বিরোধী নেতা এবং প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সবচেয়ে কট্টর সমালোচক হিসেবে দেখা হতো। রাশিয়ার আদালত তাকে ত্রিশ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল।
বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর কারাগার হিসেবে পরিচিত আর্কটিক পেনাল কলোনিগুলোর একটিতে বন্দী থাকা অবস্থায় গত শুক্রবার তার মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়।
সেদিন হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে নাভালনি মারা যান বলে জানিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
তবে নাভালনির দলের অভিযোগ, তাদের নেতাকে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে হত্যা করা হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলোও ৪৭ বছর বয়সী ওই নেতার আকস্মিক মৃত্যুর জন্য রুশ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছে।
প্রকৃত ঘটনা “জরুরীভিত্তিতে স্পষ্ট” করার জন্যও আহ্বান জানিয়েছেন ধনী দেশগুলোর সংগঠন জি-৭ এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা।
সাহস প্রদর্শনের জন্য নাভালনিকে জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়েছে বলে মন্তব্য করেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ।
তবে রুশ সরকার অবশ্য পশ্চিমের এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে।
নাভালনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে পশ্চিমাদের মূল্যায়ন “পক্ষপাতমূলক এবং অবাস্তব” বলে মন্তব্য করেছেন জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
শনিবার ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকের সময়েও বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
এদিকে, মৃত্যুর পর নাভালনির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাশিয়ার তিনশ নাগরিককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে একটি অধিকার গোষ্ঠী।
নাভালনির ঘনিষ্ঠ সহযোগী মিজ ইয়ারমিশ বলছেন, গত শুক্রবার কারাগারে হাঁটাহাঁটি করার সময় নাভালনি হঠাৎ-ই অজ্ঞান হয়ে পড়ে মারা যান বলে জানানো হয়েছে।
মরদেহের বিষয়ে খোঁজ নিতে শনিবার নাভালনির মা লিউডমিলা নাভালনায়া কারা কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়েছিলেন বলেও জানান তিনি।
সেসময় ছেলের মৃত্যুর সময় উল্লেখ করে তার কাছে একটি কাগজ দেওয়া হয়।
মিজ ইয়ারমিশ জানান, ওই কাগজে বলা হয়েছে স্থানীয় সময় ১৪:১৭ মিনিটে (জিএমটি ০৯:১৭ মিনিট) নাভালনির মৃত্যুর হয়েছে।
নাভালনির আরেক সহযোগী ইভান ঝদানভ বলছেন, নাভালনি “হঠাৎ-ই” মারা গেছেন বলা হলেও মৃত্যুর সঠিক কারণ স্পষ্ট করা হয়নি।
নাভালনির দল জানিয়েছে যে, মা নাভালনায়াকে বলা হয়েছিল যে তার মৃতদেহ জেল কমপ্লেক্সের কাছে সালেখার্ড শহরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন মর্গটি বন্ধ।
কারা কর্তৃপক্ষ নাভালনির মাকে বলেছে যে, প্রাথমিক ময়নাতদন্ত পরীক্ষা এখনও শেষ হয়নি। তাছাড়া একটি দ্বিতীয় পরীক্ষাও করতে হবে বলে জানানো হয়েছে।
নাভালনির সহযোগীরা দাবি করে যে মৃতদেহ ইচ্ছাকৃতভাবেই আটকে রাখা হয়েছে। মূলত: মৃতের শরীরে থাকা “চিহ্নগুলো মুছে” ফেলার জন্যই এটি করা হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
নাভালনির মৃতদেহকে “অবিলম্বে” তার পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
কে এই অ্যালেক্সেই নাভালনি?
প্রেসিডেন্ট পুতিনের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত আলেক্সেই নাভালনি।
সরকারের দুর্নীতি প্রকাশ করে দেবার মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে তার নাম উঠে আসে। তিনি মি. পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া দলকে উল্লেখ করেছিলেন “অসৎ ও চোরেদের দল” বলে। এজন্য বেশ কয়েকবার তাকে জেলে যেতে হয়েছে।
মি. পুতিনের ইউনাইটেড রাশিয়া সংসদীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপি করেছে বলে প্রতিবাদ করার পর তাকে ২০১১ সালে ১৫ দিনের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়।
মি. নাভালনিকে ২০১৩র জুলাইয়ে তছরূপের অভিযোগে অল্পদিনের জন্য জেলে পাঠানো হয়, তবে তিনি বলেন, এই দণ্ডাদেশ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
তিনি ২০১৮র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু প্রতারণার দায়ে তিনি আগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এই কারণ দেখিয়ে তাকে প্রার্থিতা দেয়া হয়নি।
মি. নাভালনির মতে, এটাও ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
এরপর ২০১৯ জুলাইতে মি. নাভালনিকে আবার কারাগারে পাঠানো হয় অনুমোদন না থাকার পরও প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠনের জন্য। সেসময় তিনি কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
চিকিৎসকরা বলেন তার “কোন কিছুর স্পর্শ থেকে চামড়ার প্রদাহ” হয়েছে। কিন্তু মি. নাভালনি বলেন, তার কোনদিন কোন কিছু থেকে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া আগে হয়নি।
তার নিজের চিকিৎসক বলেন তিনি “কোন বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে” এসেছিলেন। মি. নাভালনিও বলেছিলেন তার ধারণা তাকে বিষ দেয়া হয়েছে।
মি. নাভালনির ওপর ২০১৭ সালে অ্যান্টিসেপটিক রং দিয়ে হামলা চালানো হলে তার ডান চোখ রাসায়নিকে গুরুতরভাবে পুড়ে যায়।
গত বছর মানে ২০২২ সালে তার দুর্নীতি বিরোধী ফাউন্ডেশনকে সরকারিভাবে “বিদেশি গুপ্তচর সংস্থা” বলে ঘোষণা করা হয়। ফলে এই সংস্থার কর্মকাণ্ডের ওপর সরকার কঠোর নজরদারি শুরু করে।
আগেও হত্যা চেষ্টা হয়েছে
২০২০ সালে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল নাভালনিকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেঁচে যান তিনি।
চিকিৎসা নিতে যান জার্মানিতে। পাঁচ মাস জার্মানিতে কাটিয়ে ২০২১ সালে জানুয়ারিতে মস্কো ফেরার সাথে সাথেই তাকে আটক করা হয়।
তাকে অভ্যর্থনা জানাতে মস্কো বিমানবন্দরে হাজার হাজার সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন।
কিন্তু বিমানবন্দরে নামার আগেই তাকে বহনকারী বিমানটির পথ পরিবর্তন করে নিয়ে যাওয়া হয় শেরেমেতেইয়েভো বিমানবন্দরে।
সেখানে ইমিগ্রেশনে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় এই আন্দোলনকারীকে।
মি. নাভালনি তাকে হত্যাচেষ্টার জন্য রুশ কর্তৃপক্ষকে সবসময় দায়ী করে এলেও ক্রেমলিন বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের তদন্তে অবশ্য নাভালনির দাবিই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে।