মঙ্গলবার সারা দেশে সংঘর্ষ ও গুলিতে নিহত ১১২
সোমবারও দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়েছে। এ ছাড়া দুপুরের পর বিক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সারা দেশে গতকাল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ও জনতার গণপিটুনিতে ১১২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতে ৪৯ জন ও বিভিন্ন জেলায় ৬৩ জন রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে হবিগঞ্জে ৬, রাজশাহীতে ৬, কুষ্টিয়ায় ৭, চুয়াডাঙ্গায় ৪, যশোরে ৮, মানিকগঞ্জে ২, শ্রীপুরে ৬, সাভারে ৯, বরিশালে ৩, কুমিল্লায় ২, লোহাগড়ায় ২, ঝিনাইদহে ৪, চাঁদপুরে ২, কয়রাতে ১ ও সুনামগঞ্জে ১ জন রয়েছেন। এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে গতকাল দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর শনিরআখড়া, কাজলা, রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী, শহীদ মিনার, চানখাঁরপুলসহ বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় অন্তত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের ৪০ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেলে ছিল। উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৯ জনের লাশ ছিল।
একদফা দাবিকে ঘিরে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানী জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল।
ঢাকার প্রতিটি রাস্তা ছিল সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দখলে। নিজেদের দাবি আদায় ও অসহযোগ আন্দোলন পালনে সেই কারফিউ’র মধ্যেই গতকাল সকাল দশটার পর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও সাধারণ জনগণ। আন্দোলনকারীরা এসময় রাস্তায় একত্রিত হয়ে স্লোগান দিয়ে সামনে এগুতে শুরু করলে তাদেরকে লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আন্দোলনকারীরা এসময় দৌড়ে আশপাশের গলি ও রাস্তায় ঢুকে পড়ে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এসময় আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে একের পর এক গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সকাল থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে এলাকাটিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ জন নিহতসহ অর্ধশত মানুষ আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- যাত্রাবাড়ী এলাকায় রাসেল (২৮), সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন (২৪), তুলারাম কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান (২২), সাইফুল ইসলাম তন্ময় (২২), প্রবাসী আবু ইসহাক (৫২) ও আজমত মিয়া (৪০)। বাকি ২৭ বছর বয়সী এক যুবকের পরিচয় জানা যায়নি।
এদিকে নিজেদের কর্মসূচি পালনে গতকাল সকাল দশটার দিকে শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু সদস্য। এসময় পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এ সময় শিক্ষার্থীরাও পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। দু’পক্ষের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে দিয়ে চানখাঁরপুল এলাকায় অবস্থান নেয়। ঘণ্টা তিনেক চলা সংঘর্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। এসময় ঢামেকের নতুন বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে যমুনা ব্যাংকের স্টাফ মানিক মিয়া (২৭) ও অজ্ঞাত এক যুবক (২৫)-এর মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত আরও অনেকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া জানান, হাসপাতালে গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ৪০ জন মারা গেছেন। এ ছাড়াও মো. রেজাউল তালুকদার (৩৬) নামের যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ একজন ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া ২৫২ জন আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এদের মধ্যে ৭৪ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে আরও ৯ জনের লাশ রয়েছে।
এদিকে আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে কুষ্টিয়ায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ৭ জন নিহত এবং অনেক মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত শতাধিক যুবক। রাজশাহীতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গুলি চালিয়েছে পুলিশ ও ছাত্রলীগ। এ সময় ৬ জন নিহত হন। সাভারে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ গুলি করলে ৯ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সাংবাদিকসহ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অর্ধশতাধিক লোক বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গাজীপুরের শ্রীপুরে বিজিবির গুলিতে ৬ জন নিহত হয়েছেন। যশোরে হোটেল জাবের ইন্টারন্যাশনালের অগ্নিকাণ্ডে এ পর্যন্ত ৮ জন পুড়ে মারা গেছে। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানায় হামলা চালিয়েছে ছাত্র-জনতা। এসময় দুজন পুলিশ সদস্য মারা যান। কুমিল্লা নগরীতে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় নাফিজুল আলম সামি নামের এক কলেজছাত্র সহ ২ জন নিহত হয়েছেন। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় পোড়াহাটী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরণ (৭৫) নিহত হয়েছেন। এ সময় জনতার গণপিটুনিতে হিরণের গাড়িচালক আক্তার হোসেন বিকালে নিহত হন। পুলিশের গুলিতে বৈষ্যমবিরোধী আন্দোলনককরী যুবক রফিকুল ইসলাম চঞ্চল (২৪) মারা গেছেন। এ ছাড়া গুরুতর আহত মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তায়েবুর রহমান টিপু মারা গেছেন। চুয়াডাঙ্গা শহরের সিনেমা হল পাড়ায় জেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক আরেফিন আলমের বাড়িতে দেওয়া আগুনে অন্তত চারজন নিহত হয়েছেন। চাঁদপুরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন শাপলা মিডিয়ার কর্ণধার-প্রযোজক সেলিম খান ও তার ছেলে নায়ক শান্ত খান। এদিকে শ্রীমঙ্গলে ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলে পুলিশের ছোড়া গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে কিশোরসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।