মহান মে দিবসের আহ্বান – দুনিয়ার মজদুর এক হও
এম, এ, আজিজঃ
আজ মহান মে দিবস । ১লা মে দিবসটির আবেদন ও তাৎপর্য্য সম্পর্কে আজকের তরুণ সমাজ এবং রাজনীতির হাইব্রিড ক্যাডারদের অনেকেরই হয়তো বা সৈম্ম্যক কোন ধারনা নেই । বছর ঘুরে দিবসটি যখন এসে হাজির হয় তখনই দেখা যায় দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে, রাজধানীতে এমনকি জেলা, উপজেলায় লাল-নীল ব্যানারের পিছনে পালের গোদার মত এসে লাইন দিয়ে গগণবিধারী আওয়াজ তুলে দুনিয়ার মজদুর এক হও । মিছিল-মিটিং সফল করতে তথাকথিত ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা তাদের রাজনৈতিক প্রভূদের সন্তুষ্ট করার জন্য দেশের টুকাই থেকে শুরু করে বস্তিবাসী বেকার, ভিক্ষুকদেরকে অর্থের বিনিময়ে ক্রাউড সাপ্লাই করে । সফলভাবে দিবসটি পালন করতে পারলেই রাজনৈতিক গুরু সন্তুষ্টির জন্য দালাল নেতাদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফূটে ।মজুররা যে তিমিরে ছিল অর্থাৎ তাদের বস্তিতে ফিরে যায় । আসলে কি দিবসটি সে জন্যই পালন করা হয় ?
মূলতঃ পুজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের স্হাপিত কল-কারখানার উদপাদনের মূল চালিকা শক্তি গরীব শ্রমিকদের সাথে মালিক গোষ্ঠী দাসের মত আচরন করতো । শ্রমিকদেরকে অত্যান্ত নিম্নতম মজুরীতে ১২ থেকে ১৪ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা হতো । কর্মক্ষেত্রে তাদের ছিলনা কোন অধিকার ।ছিলনা তাদের স্ব্যাস্হ্য ও বাসস্হানের কোন সুবিধা । যখন যাকে খুশী তখন তাকে হায়ার ও ফায়ার করতে পারতো মালিক গোষ্ঠী । শ্রমিকদের সাথে মালিকদের এই অমানবিক আচরনের প্রতিবাদে এবং আট ঘন্টা কর্ম দিবস ও নূন্যতম মজুরী নির্ধারনের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালে গর্জে উঠেছিল অধিকার বঞ্চিত শ্রমজিবী মানুষ । কল-কারখানার পুজিপতি মালিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে সরকার ১লা মে তারিখে শিকাগো শহরে সমবেত বিক্ষুব্দ শ্রমিকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে ১১ জন প্রতিবাদী শ্রমিককে নিহত ও অসংখ্য শ্রমিককে আহত করেছিল । পরবর্তিকালে নের্তৃত্বদানকারী ৬ জন শ্রমিককে ফাসিতে ঝুলানো হয়েছিল । কিন্তু অত্যাচার, নির্য্যাতন, জেল-জুলুম ও বুলেট ব্যাবহার করেও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শ্রমজীবি মানুষের এই আন্দোলন থামাতে পারেনি । অবশেষে ১৯৮৯ সালে ফ্রান্সে আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে আট ঘন্টা কর্ম দিবস ও নূন্যতম মজুরী নির্ধারনের দাবী মেনে ১লা মে দিবসটিকে আর্ন্তজাতিক শ্রম দিবস হিসাবে ঘোষনা করা হয় । পরবর্তিকালে জাতিসংঘের এজেন্সী ILO বা আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্হার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য চার্টার প্রনয়ন করা হয় । জাতিসংঘের সদস্য প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে এই চার্টার মেনে চলার জন্য কনভেনশন প্রদান করা হয় । সেই থেকে মে মাসের প্রথম তারিখে বিশ্বব্যাপী মহান মে দিবস পালন করা হয় । অর্থাৎ শ্রম বাজারে দাসত্ব থেকে মুক্তি এবং শ্রমজীবি মানুষের ন্যায্য অধিকার আট ঘন্টা কার্য্য দিবসের দাবী আদায়ের লক্ষ্যে আত্মাহুতি দেওয়ার দিবস হল ‘ মে দিবস’ । ন্যায্য অধিকার আদায়ে অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার শিক্ষা দিয়েছে মহান মে দিবস ।
বর্তমানে অনারম্ভর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় মহান মে দিবস । বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয় । কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক সমাজ মহান মে দিবস থেকে কি শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করা যাক । রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য দেশ হিসাবে আইএলওর প্রনীত চার্টার মেনে চলার বাধ্যবাদকতা থাকলেও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র সমূহ ও পুজিবাদী গোষ্ঠি অনেক ক্ষেত্রেই তা অবমাননা করে শ্রমজিবী মানুষের রক্ত চুষে খাচ্ছে । মুনাফার লোভে শিল্পোন্নত রাষ্ট্র এমনকি তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্র সমূহ নির্বিশেষে এখনো জবরদস্তি মূলক শিশু শ্রমিক, যৌন কর্মী, কর্ম ঘন্টা নির্ধারণ, নিম্নতম মজুরী প্রদান সহ শ্রমজিবী মানুষের স্ব্যাস্হ্য সেবা, বাসস্থান ও অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে । পশ্চিমা রাষ্ট্রসমূহে শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন থাকার কারনে সরকার ও পুঁজিপতিরা শ্রমজিবী মানুষের অধিকার নিয়ে ছলচাতুরী করার তেমন সুযোগ পায়না । তাই সকল সাম্রাজ্যবাদী দেশ সমূহ সস্তা শ্রমের বিনিময়ে অধিক মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে তৃতীয় বিশ্ব তথা আমাদের দেশে হানা দিয়েছে । এই সুযোগে বাংলাদেশের তথাকথিত শ্রমিক নেতারা প্রশাসন ও পুজিবাদী বিনিয়োগকারীদের সাথে যোগসাজস করে শ্রমজিবী মানুষের অধিকার আদায়ের পরিবর্তে নিজেরাই কোটিপতিতে পরিনত হয়েছেন । এমনও অনেক শ্রমিক নেতা রয়েছেন যারা কেরানী/পিয়ন/ আর্ধালী/ মিটার রিডার হয়ে অসুদোপায়ে অর্থ উপার্জন করে একাধারে শ্রমিক নেতা ও শিল্পপতি হয়েছেন। অবৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদের পাহাড় গড়েছেন । এমন দূর্নীতিবাজ নেতাও রয়েছে যারা একাধারে, মালিক সাংসদ ও রাষ্ট্রের উজিরের দায়ীত্ব পালন করছেন এবং ভূঁইফোড় শ্রমিক নেতা সেজে শ্রমজিবী মানুষের সাথে প্রতারনা করে চলেছেন । তিনি শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থকে জলান্জলি দিয়ে মধ্যসত্বভোগী টাউট পরজীবী হিসাবে আর্বিভূত হয়েছেন । ১/১১ এর সময় এদের অনেকেরই চেহেরা দেশ ও জাতির সামনে উন্মোচিত হয়েছিল । পরবর্তীকালে মুখোশ পরিবর্তন করে শাসক দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থে এরাই এখন আবার লুটপাঠের সম্রাট হয়েছেন । মেহনতি শ্রমজিবীরা যেন তাদের হাতে জিম্মী হয়ে আছেন । শ্রমিক নেতা নামে এই সকল মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা শাসক গোষ্ঠীর মিছিল সমাবেশে জিম্মী শ্রমজীবী মানুষ, টোকাই, বস্তিবাসী অসহায় মানুষকে নগদ নারায়ণের বিনিময়ে মহান মে দিবসের মিছিলে, সমাবেশে ক্রাউড সাপ্লাই করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে । শাসকগোষ্ঠী ও দূনীতিবাজ পূজীবাদীদের স্বার্থে এহেন কোন কাজ বা অপরাধ নেই যে এই সকল মধ্যস্বভোগী দালাল শ্রমিক নেতারা করতে পারেনা । উল্ল্যেখ্য যে ৭৩ সালে বাংলাদেশে যখন দূর্ভিক্ষের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল তখন বিদেশ থেকে প্রাপ্ত রিলিফ সামগ্রী মঙ্গলা বন্দর দিয়ে রাষ্ট্রের এক মহা ক্ষমতাশালী নেতার অনুজের চোরাচালানের ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী পনের জন নিরীহ শ্রমিককে বস্তা বন্দি করে রুপসা নদীতে ফেলে দিয়ে ডুবিয়ে মারা হয়েছিল । রাষ্ট্রের কর্ণধারের কাছে এই নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাওয়ার অপরাধে এক শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে অমানবিক ভাবে নির্যাতন ও কারাবন্দী করা হয়েছিল । কিন্তু এই সাহসী শ্রমিক নেতা অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি ।
জনবর্ধিষ্ণু বাংলাদেশের বেকার পুরুষ ও নারীদেরকে শোষন ও অধিক খাটাইয়া অল্প মজুরিদানের লক্ষ্য নিয়ে আষির দশকের শেষার্ধ থেকে আন্তর্জাতিক পুজিবাদী কর্পোরেট কোম্পানী সমূহের সহায়তায় শুরু হয় গার্মেন্ট শিল্প । দূর্নীতিবাজ মন্ত্রী, আমলা ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজসে রাজনীতিক ও মতলববাজ ব্যাবসায়ীরা জনগণের গচ্ছিত আমানত, প্রবাসীদের প্রেরিত বৈদেশিক মূদ্রা ঋণের নামে লুটপাট করার মাধ্যমে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে তোলা হয় গার্মেন্ট শিল্প । যে শিল্পে প্রায় চল্লিশ লক্ষেরও বেশী শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে । যাদের ৬০% শতাংশ নানা বয়সের নারী শ্রমিক । এদের ভাগ্যে এখনো মহান মে দিবসে শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত আট ঘন্টা কার্য্য দিবস বাস্তবায়ীত হয়নি । বর্তমান দ্রব্যমূল্য অনুপাতে মজুরি নির্ধারন, ছুটি, বোনাস, ভাতা, স্বাস্হ্যসম্মত নিরাপদ কর্ম পরিবেশ, উপযুক্ত স্বাস্হ্য সেবা কোন কিছুই নিশ্চিত করা হয়নি । ভবন ধ্বসে বা আগুনে পুড়ে মারা গেলেও সরকার বা মালিক পক্ষ ILO এর বিঘোষিত শ্রমনীতি বাস্তবায়নে কারো কোন গরজ নেই । ন্যায় সঙ্গত দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট করার অধিকার থেকে ওরা বঞ্চিত । অথচ হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমকারী এই শ্রমিকগণই উৎপাদনের মূল চালিকা শক্তি।
মূলতঃ বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন অর্থ লোভীর দল ও দুষ্ট রাজনীতির গর্ভে পতিত । স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই । শ্রমিক আন্দোলন বা রাজনীতিতে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে কোন শ্রমিক সংগঠনই বাস্তবে কাজ করছে না । শ্রমিক সংগঠন গুলোর নিচু স্তরের নেতৃত্ব , দূর্নীতি ও লুন্ঠনস্পৃহা নেতাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রাস করে ফেলেছে । বর্তমান অবস্হা থেকে পরিত্রান পেতে হলে শ্রমজীবি মানুষের কল্যাণ তথা মুক্তির স্বার্থে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা ও সফল করতে হলে কার্ল মার্ক্স, এঙ্গেলসের নির্দেশিত পথেই শ্রমজীবি মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে । সে লক্ষ্যেই শ্রমিকদের মাঝ থেকে শ্রেনীসচেতন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে । রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধভাবে মেহনতী শ্রমিক শ্রেনীর নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেই শ্রমিক আন্দোলন সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠবে শ্রমিক স্বার্থমুখী । তাহলেই সমাজের অন্যান্য সব পশ্চাৎপদ শ্রেণীসমূহের মুক্তি অর্জন করা সম্ভব হবে । এবারের মহান মে দিবসে দূর্নীতিবাজ কারখানার মালিক ও বিদেশী কর্পোরেট কোম্পানীর মধ্যসত্ব ভোগী সরকারের দালাল শ্রমিক নেতাদের সকল চক্রান্ত ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করে অধিকার আদায়র লক্ষ্যে প্রকৃত শ্রমজীবি মানুষের রাজনীতি সচেতন নেতৃত্ব গড়ে তোলাই হউক এবারের মহান মে দিবসের সংকল্প ।
উপসংহারে মহান মে দিবসে যে সকল শ্রমজিবী মানুষের রক্তের বিনিময়ে ৮ ঘন্টা কর্মদিবস এবং নিম্নতম মজুরী নির্ধারিত হয়েছিল তাদের সকলের প্রতি লাল সালাম, গভীর শ্রদ্ধা ও তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। একইসাথে দেশ ও প্রবাসে সকল শ্রেনীর শ্রমজিবী মানুষকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও লাল সালাম । অমর হউক মহান মে দিবস ।
লেখকঃ এম, এ, আজিজ , সমাজ সেবক । ( সাবেক ট্রেড ইউনিয়ন এ্যাক্টিভিষ্ট ) হক কথা ( The Truth ) প্রকাশনী , লন্ডনঃ ১লা মে ২০১৮ইং ।