মাদার অব ওয়ার্ল্ড

Spread the love

maxresdefaultবাংলা সংলাপ ডেস্কঃজার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। মুখাবয়ব, প্রাণখোলা হাসি তার ক্যারিয়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে  যোগ করেছে মানবীয় গুণ। এ জন্যই তাকে বলা হয় ‘গার্ডিয়ান মাদার অব জার্মানি’ অর্থাৎ জার্মানির অভিভাবক মা। ইউরোপে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, তিনি শুধু জার্মানির মা নন। তিনি এখন মুক্ত দুনিয়ার মা। টানা চারবার তাকে ও তার দলকে নির্বাচিত করে এক নতুন রেকর্ড তৈরি করেছেন জার্মানরা। একে তো প্রথম নারী চ্যান্সেলর তিনি, তার ওপর টানা চার দফা। এ এক নতুন রেকর্ড। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিধর নেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। রোববারের নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থি, ইসলামবিরোধী অলটারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) উত্থান ঘটলেও অ্যাঙ্গেলা মার্কেলকে তার ক্ষমতা থেকে টলাতে পারে নি কেউ। তিনিই নতুন সরকারের দায়িত্বে থেকে পরবর্তী মেয়াদ পূর্ণ করবেন। ব্রেক্সিট ভোটের মাধ্যমে বৃটেন যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তখন অনেক রাজনৈতিক বক্তা পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, ভেঙে যাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ভেঙে দেয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থি নেত্রী ম্যারি লা পেন। কিন্তু পারেন নি। শক্ত হাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য ধরে রেখেছেন অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। তাছাড়া বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক শক্তিশালী, জনপ্রিয় নেত্রী হিসেবে। এরই স্বীকৃতি আরো একবার মিলেছে তার ভাগ্যে। জার্মানরা তাকেই সমর্থন দিয়ে সামনে এগিয়ে দিয়েছেন। তার হাসিমাখা মুখের সঙ্গে সঙ্গে তারাও এগিয়ে যেতে চান আগামীর সমৃদ্ধির দিকে। ইসলাম বিরোধিতা নয়, শরণার্থী বা অভিবাসন বিরোধী নয়, মানবিক গুণ নিয়ে তারা নতুন উদ্যমে চলার অঙ্গীকারের কথা জানিয়ে দিলেন রোববারের ভোটে। সরকারি ফল ঘোষণা না হলেও বুথ ফেরত জরিপ বলে দিয়েছে, চতুর্থ বারের মতো চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি সাবেক চ্যান্সেলর কনরাড আদেনাউয়ার এবং হেলমুট কোহলের সমকক্ষীয় হয়ে গেলেন। অর্থাৎ তারা একই র‌্যাঙ্কভুক্ত হলেন। এই দুই নেতাও চারবার জার্মান চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের মতো তারা টানা চারবার নির্বাচিত হয়েছিলেন কিনা তা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা যায় নি। নিউ ইয়র্ক টাইমস তার সংবাদ শিরোনামে লিখেছে, অ্যাঙ্গেলা মার্কেল জার্মানিতে জাতীয় নির্বাচনে নতুন ইতিহাস গড়েছেন। মার্কেল বাজিমাত করলেও সেখানে অভাবনীয়ভাবে উত্থান ঘটেছে উগ্র ডানপন্থি, ইসলামের কঠোর বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’র (এএফডি)। দ্বিতীয় বিশ্বযুুদ্ধের পর এটাই কঠোর জাতীয়তাবাদী এই দলটির সবচেয়ে ভালো পারফরমেন্স এবং এর মধ্য দিয়ে তারা প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে প্রবেশের টিকিট নিশ্চিত করেছে। একদিকে দলটি উগ্রপন্থি, ইসলাম বিরোধী, ঠিক একই তালে তারা অভিবাসনবিরোধী। অন্যদিকে অ্যাঙ্গেলা মার্কেল অভিবাসন-বান্ধব। তার কারণে জার্মানিতে সাম্প্রতিক সময়ে ঠাঁই পেয়েছে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী। এ ইস্যুকে পুঁজি করে এএফডি তার সামনে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই বিজয়ী হলেও মার্কেলকে পার্লামেন্টে কঠিন চ্যালেঞ্জে থাকতে হবে। এমনটা বলছেন বিশ্লেষকরা। নির্বাচনে বিজয়ী হলেও অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের মাঝে তাই একরকম হতাশা, দীর্ঘশ্বাস থাকতেই পারে। তারই হয়তো বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। তিনি স্বীকার করেছেন তার দলের টার্গেট ছিল শতকরা ৪০ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী হওয়া। কিন্তু তা হয় নি। বার্তা সংস্থা এএফপি লিখেছে, শেষ পর্যন্ত শেষ হাসিটা অ্যাঙ্গেলা মার্কেলেরই রয়ে গেল। তিনি রোববারের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে চতুর্থ দফায় জার্মানির নেতৃত্ব ধরে রাখলেন। কিন্তু উগ্র ডানপন্থি এএফডি দলের পার্লামেন্টে প্রবেশের মাধ্যমে তার সেই বিজয়ে একরকম কালোমেঘের ছায়া ফেলেছে। গত ১২ বছর অর্থাৎ টানা তিন মেয়াদে জার্মানিতে ক্ষমতায় অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। এক্সিট পোল বা বুথ ফেরত জরিপ বলছে, তার রক্ষণশীল ক্রিশ্চিয়ান ইউনিয়ন (সিডিআই/সিএসইউ) ব্লক ভোট পেয়েছেন শতকরা প্রায় ৩৩ ভাগ। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সোশ্যাল ডেমোক্রেট দল পেয়েছে শতকরা ২০ থেকে ২১ ভাগ সমর্থন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আর কখনো এত কম ভোট পায় নি এ দলটি। তাই এ দলটি ও এর নেতা মার্টিন শুলজ রয়েছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। কিন্তু জার্মান নির্বাচনে যেন আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটেছে একটি দলের। তারা হলো এএফডি। এই দলটি মারকেলের রক্ষণশীল নীতি, বিশেষ করে অভিবাসন ইস্যুতে গৃহীত নীতির বিরোধিতা করে ব্যাপক সমর্থন আদায় করেছে। কঠোর ইসলাম ও অভিবাসন বিরোধী এই দলটি পেয়েছে শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ ভোট। আর এর মধ্য দিয়ে তারা জার্মান পার্লামেন্টে তৃতীয় বৃহৎ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এবারই তারা প্রথম নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে প্রবেশের টিকিট হাতে পেলো। এ পরিস্থিতিকে জার্মানির সর্বোচ্চ বিক্রীত দৈনিক পত্রিকা বিল্ড আখ্যায়িত করেছে ‘পলিটিক্যাল আর্থক্যুয়াক’ বা রাজনীতির ভূমিকম্প হিসেবে। বুথফেরত জরিপের ফল প্রকাশ হতেই রাজধানী বার্লিনে এএফডি দলের সদর দপ্তরে গত রাতেই ঢল নামতে থাকে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের। তারা নেচে গেয়ে তাদের এই উত্থানকে উদযাপন করেন। সমস্বরে গাইতে থাকেন জার্মানির জাতীয় সংগীত। এখানে উল্লেখ্য, এএফডি দলটির বয়স মাত্র চার বছর। ইউরোপের অন্যান্য স্থানে যেমন নতুন নতুন চমক সৃষ্টি করেছে এমনি কিছু দল ঠিক তেমনি তারা এই অল্প সময়ের মধ্যে বিশাল কৃতিত্ব দেখালো। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ফ্রান্সের উগ্র ডানপন্থি ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং বৃটেনের ইউকিপের। এখন দলটি জার্মানির পার্লামেন্ট বুন্দেসটাগে শক্ত বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা করবে। জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিগমার গ্যাব্রিয়েল তাদেরকে ‘প্রকৃত নাজি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, প্রকৃত নাজিরা এখন পার্লামেন্টে প্রবেশ করছে। আর জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল স্বীকার করেছেন তিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। তার ভাষায়- আমাদের সামনে বড় একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। সেটা হলো বুন্দেসটাগে এএফডি’র প্রবেশ। ওদিকে জার্মানির সরকারি সংবাদ মাধ্যম ডয়েচে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল এ নির্বাচনে রাজনীতির মাঠে বড় পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সবকিছু যে আগের মতো চলবে না, তারই একটি পরিষ্কার বার্তা দিচ্ছে এই নির্বাচন। তার কথায় স্পষ্ট, জার্মান রাজনীতির গতিপথ পাল্টে যাচ্ছে। আগের মতো মসৃণ গতিতে আর হয়তো চলতে পারবেন না মারকেল। চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল শরণার্থীদের জন্য তার দরজা খুলে দিয়ে এই নির্বাচনে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে হয়ে যায় কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন। তাতে তার দলের ভরাডুবি ঘটে। তখনই মার্কেলের কপালে ভাঁজ পড়া শুরু হয়। বিশ্লেষকরা কালো মেঘের ইঙ্গিত দেন। বলা হয়, পার্লামেন্ট নির্বাচনে হয়তো ধরাশায়ী হবেন তিনি। কিন্তু না, ধরাশায়ী তিনি হন নি। ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। জার্মানির ৫৯৮ আসনের পার্লামেন্ট বুন্দেসটাগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম কোনো নাৎসি সমর্থক দল (এএফডি) আসন নিতে যাচ্ছে। ভোটে এএফডির এই জয়জয়কার দেখে বিক্ষোভ  দেখা দিয়েছে জার্মানদের মধ্যে। বার্লিনে দলটির সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষুব্ধদের হাতে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল- ‘শরণার্থীদের স্বাগতম’। ডানবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে ফ্রাঙ্কফুর্ট ও কোলনেও। জার্মানির পার্লামেন্টে আসন বণ্টন হয় একটু ভিন্নভাবে। রোববার সাড়ে ৬ কোটি ভোটারের প্রত্যেকে দুটি করে ভোট দেন। একটি দেন নিজ এলাকার পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচনের জন্য, অন্যটি দেন দলকে। বুন্দেসটাগের অর্ধেক আসনের সদস্যরা আসেন সরাসরি  ভোটে নির্বাচিত হয়ে; বাকি অর্ধেক আসন দলগুলোর মধ্যে বণ্টন হয় ভোটের আনুপাতিক হারে। ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, সিডিইউ-সিএসইউ জোট ৩৩ শতাংশ ভোট  পেয়েছে, এসপিডি পেয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট। জরিপের ফলকে পেছনে ফেলে এএফডি পেয়েছে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট। বামরা পেয়েছে ৯ শতাংশ ভোট এবং গ্রিন পার্টি পেয়েছে ৮ শতাংশ।


Spread the love

Leave a Reply