মিজানুর রহমান আজহারীর মাহফিলে ধর্মান্তরিত ১২ সদস্যের পরিবারটিকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে
বাংলা সংলাপ ডেস্ক: বিতর্কিত ধর্মীয় বক্তা মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজ মাহফিলে যে পরিবারটির ধর্মান্তকরণ নিয়ে বিতর্ক চলছে, তাদের সবাইকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
গত ২৪শে জানুয়ারী লক্ষীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে একই পরিবারের মোট ১২ জন সদস্য এক সঙ্গে ইসলামে দীক্ষা নেয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। আলোচিত এই পরিবারটি এসেছিল ভারত থেকে। সেখানে হিন্দু ধর্মের অনুসারী ছিলেন তারা।
বাংলাদেশের পুলিশ এই পরিবারের ১২ জনকেই আটক করে। তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। তবে পুলিশ বলছে, ভারতীয় নাগরিক হিসেবে যে ভিসা নিয়ে তারা বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, সে কারণেই তাদের ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
লক্ষীপুরে কী ঘটেছিল:
লক্ষীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া গ্রামে ২৪শে জানুয়ারির মাহফিলটির আয়োজন করে স্থানীয় মসজিদ কমিটি। সেখানে ওয়াজ করেন মিজানুর রহমান আজহারী। তিনি বাংলাদেশে এখন বেশ জনপ্রিয় একজন ধর্মীয় বক্তা। একই সঙ্গে তাকে নিয়ে বিতর্কও আছে। তার মাহফিলে প্রচুর লোকসমাগম হয়।
সেদিন তার উপস্থিতিতে একটি পরিবারের মোট ১২ জন সদস্য ইসলামে দীক্ষা নেন। এর আগেও মিজানুর রহমান আজহারীর মাহফিলে ধর্মান্তকরণের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় তার পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বিতর্ক চলছে।
তবে লক্ষীপুরের এই ঘটনাটির ব্যাপারে পুলিশ কিছু অনুসন্ধান চালিয়ে বলছে, এই পরিবারটি বাংলাদেশি নয়, এরা সবাই এসেছে ভারত থেকে।
তবে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজকরা বলছেন, এরা যে ভারতীয় নাগরিক, সেটি তাদের জানা ছিল না।
পরিবারটির পরিচয় কী?
১২ সদস্যের ধর্মান্তরিত পরিবারটির প্রধান হচ্ছেন মনির হোসেন। এর আগে ভারতে তিনি পরিচিত ছিলেন শংকর অধিকারী নামে।
পুলিশ জানিয়েছে, গত বছরের অগাষ্ট মাসে দুই মাসের ভিসা নিয়ে তারা বাংলাদেশে এসেছিল এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তারা অবধেভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল।
লক্ষীপুর জেলার পুলিশ সুপার এ এইচ এম কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, ধর্মন্তরের ঘটনার পর তদন্ত করে পরিবারটির কর্তাব্যক্তি সম্পর্কে তারা বিভিন্ন তথ্য জানতে পারেন।
“এই পরিবারটির কর্তা বাংলাদেশ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার নাম মনির হোসেন। তাদের পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, উনি ছোটবেলায় হারিয়ে যান। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে উনি কিভাবে ভারতে গেছেন, তা তার জানা নাই। ভারতে হিন্দু পরিবারে বড় হয়েছেন এবং হিন্দু নারী বিয়ে করে সংসার করছিলেন। তিনি ভারতে নাম নিয়েছিলেন শংকর অধিকারী।”
পুলিশ সুপার আরও জানিয়েছেন, “এই ব্যক্তির স্ত্রী দু’জন এবং দুই ঘরে সন্তান সংখ্যা আটজন। একজন নাতিও আছেন। তাদের সবাইকে আমরা পাই ভারতীয় পাসপোর্টসহ। বেনাপোল বন্দর দিয়ে এরা বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেদিক দিয়েই তারা আবার ফেরত গেছেন।”
মনির হোসেন বা শংকর অধিকারীর মা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে বিবিসি বাংলা। লক্ষীপুরের রামগঞ্জের চন্ডীপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তিনি।
ফাতেমা বেগম বলছিলেন, তার ছেলে হারিয়ে যাওয়ার ২৫ বছর পর তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয় গত বছরের জুলাই মাসে। ঘটনাটি ছিল নাটকীয়। সে সময় শুধু গ্রামের নামে বা ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠিয়েছিল মোবাইল নাম্বার দিয়ে। একজন পোস্টমাস্টারের চেষ্টায় সেই নাম্বারের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ হয়। এরপর তার ছেলে পরিবার নিয়ে গত বছরের অগাষ্টে দেশে আসে।
ফাতেমা বেগম জানিয়েছেন, তার ছেলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে বাংলাদেশেই থাকতে চেয়েছিল। তবে তিনি বলেছেন, মাহফিলে তার ছেলে কিভাবে গিয়ে ধর্মান্তরিত হয়েছে তা তার জানা নাই।
তিনি আরও বলেছেন, “আমার ছেলে দুই বউসহ সন্তানদের নিয়ে আসার পর তারা হিন্দু হওয়ায় আমি তাদের আমার সাথে না থেকে অন্য এলাকায় থাকতে বলেছিলাম। তারা কেরানীগঞ্জে বসবাস করছিল ছয় সাত মাস ধরে। তারা মক্তবে গিয়ে ইসলাম ধর্শ গ্রহণ করেছিল এবং এরপর তাদের ঐ মাহফিলে নিয়া কালিমা পড়ায়।”
ধর্মান্তকরণ নিয়ে বিতর্ক
পরিবারটিকে ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে জোর করা হয়েছে কিনা বা এটি সাজানো ঘটনা ছিল কিনা–এসব নানা প্রশ্ন অনেকে তুলেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়।
তবে মাহফিলে আয়োজকদের অন্যতম একজন মোহাম্মদউল্লাহ দাবি করেছেন, পরিবারটিকে ধর্মান্তরিত করার ক্ষেত্রে তারা জোর করেন নি। তাদের নাগরিকত্বের ব্যাপারেও জানা ছিল না বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
“পরিবারটির কর্তা মাহফিলের একদিন আগে আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছিল। এরপর মাহফিলের দিন তারা এফিডেভিট এর কপি সহ আইনজীবী নিয়ে এসেছিলেন।তাদের আইনজীবী ধর্মন্তরিত হওয়া সর্ম্পকিত সেই এফিডেভিট মাহফিলে পড়ে শোনান।”
“তারা মিজানুর রহমান আজাহারীর কাছে ধর্মান্তরিত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজহারী সাহেবকে যখন আমরা প্রস্তাব দেই, তখন উনি অপারগতা প্রকাশ করেন। কারণ কিছুদিন আগেও এরকম একজন বোন ধর্মন্তরিত হয়েছিলেন এবং তা নিয়ে আজহারী সাহেবের বিরুদ্ধে অপপ্রচার হয়েছিল। সেজন্য আমরা মঞ্চে থাকা আরেকজন আলমকে দিয়ে ঐ পরিবারকে কালিমা পড়ানো হয়েছিলো।”
পুলিশ সুপার এ এইচ এম কামরুজ্জামান বলেছেন, “কেউ তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করেছে, এমনটা আমরা পাই।কেউ বাধ্য করলে তখন আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারতাম। এখানে তাদের ধর্মান্তরিত হওয়া না হওয়া আমাদের কাছে বিষয় ছিল না। আমাদের বিষয় ছিল, তারা ভারতীয় নাগরিক হয়ে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ছিল।”