মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নির্যাতন: সত্য, মিথ্যা এবং আং সান সুচি
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর মিয়ানমারের নেত্রী আং সান সুচিকে এক কাতারে ফেলতে চাইবেন না অনেকেই। কিন্তু রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে বিবিসির সংবাদদাতা জোনাহ ফিশার যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন, তাতে তার মনে হয়েছে, দুজনের মধ্যে আসলে অনেক মিল। সেই অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন জোনা ফিশার তাঁর এই লেখায়:
আপনি যা ভাবছেন, তার চেয়েও আসলে অনেক বেশি মিল ডোনাল্ড ট্রাম্প আর আং সান সুচির মধ্যে।
দুজনেরই বয়স ৭০-এর বেশি। দুজনের মাথার চুল নিয়েই বেশ আলোচনা হয়। এবং দুজনেই সাংবাদিকদের প্রচন্ড অপছন্দ করেন।
সাংবাদিকদের সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অশান্ত সম্পর্ক খুবই আলোচিত। কিন্তু আং সান সুচির সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক যে অনেকটা একই রকম সেটা জানলে অবাক হবেন অনেকে।
আং সান সুচি অনেকের কাছেই পরিচিত ‘দ্য লেডি’ নামে। ১৯৯০ এর দশকে তিনি বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পান মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে।
সুচিকে যখন মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা রেঙ্গুনে গৃহবন্দী করে রেখেছিল, তখন তার সঙ্গে কথা বলার জন্য, তার সাহসী প্রতিরোধের কাহিনি তুলে ধরার জন্য অনেক সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন।
তবে আং সান সুচি ক্ষমতায় যাওয়ার পর সবকিছু যেন বদলে গেছে।
মিয়ানমারের সরকারে তিনি নিজের জন্য তৈরি করেছেন এক ক্ষমতাধর পদ। প্রেসিডেন্টেরও উর্ধ্বে এই ‘স্টেট কাউন্সেলর’ বা ‘রাষ্ট্রীয় পরামর্শকের’ পদটি। বাস্তবে তিনি আসলে সবার ধরা ছোঁয়ার উপরে। তাঁকে জবাবদিহি করার কেউ নেই।
আং সান সুচি কখনোই মিয়ানমারের গণমাধ্যমে কোন সাক্ষাৎকার দেন না। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কথা বলেন বেছে বেছে। পার্লামেন্টে এমপি-রা তাঁকে নিয়মিত প্রশ্ন করার কোন সুযোগই পান না। ১৪ মাস আগে নির্বাচনের সময়ের সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনের পর আর কোন সত্যিকারের সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে দেখা যায়নি।
আর এর পাশাপাশি সরকারী প্রপাগান্ডা তো রয়েছেই। এই প্রপাগান্ডা মিয়ানমারে সামরিক শাসন আর সেন্সরশীপের কালো দিনগুলোকেই মনে করিয়ে দেয়।
রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে প্রশ্ন:
রোহিঙ্গা মুসলিমরা দাবি করে তারা বহু বছর ধরে রাখাইনে বাস করছেছবির
রোহিঙ্গা মুসলিমরা দাবি করে তারা বহু বছর ধরে রাখাইনে বাস করছে
প্রায় প্রতিদিনই মিয়ানমারের সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রে ছাপা হয় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে আক্রমণ করে লেখা নিবন্ধ। রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরার কারণেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই হামলার লক্ষ্যবস্তু।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় দশ লাখ। দশকের পর দশক ধরে তারা মিয়ানমারে বৈষম্যের শিকার। গত সাড়ে তিন মাস ধরে রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছে সামরিক বাহিনির নির্মম অভিযান।
সেখানে কী ঘটছে তার উত্তর নির্ভর করছে আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন তার ওপর। কারণ কেউ যে স্বাধীনভাবে সেখানে গিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানবেন, তার সব পথ বন্ধ রেখেছে মিয়ানমার সরকার।
অনেকে দাবি করছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সেখানে জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে। কারও দাবি সেখানে গণহত্যা চলছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং আং সান সুচি অবশ্য এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করছেন। তারা বলছেন, সেখানে পুলিশের ওপর রোহিঙ্গা জঙ্গীরা যে হামলা চালিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান চলছে।
সাক্ষাৎকারের বিফল চেষ্টা
গত সপ্তাহে বিবিসি-কে যখন রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা কবলিত এলাকায় যাওয়ার অনুমতি দেয়া হলো, সেটা ছিল বেশ অবাক করা ব্যাপার। আমরা তাড়াতাড়ি বিমানে উড়ে গেলাম রাখাইনের রাজধানী সিটুয়ে-তে। সেখান থেকে আমরা একটা ফেরিতে চড়ে মায়ু নদী ধরে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রওনা হলাম।
চার ঘন্টা পর আমরা বুথিডং এ পৌঁছালাম। সেখান থেকে সংঘাত কবলিত এলাকাগুলি আর মাত্র ৪৫ মিনিটের পথ।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য: সাংবাদিকদের যেখানে প্রবেশ নিষেধ
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ সেখানেও হাজির। আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো পুলিশ আর নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের একটি দল। আমাদেরকে স্থানীয় টাউনশীপের’ অফিসে নিয়ে যেতে চায় তারা।
টাউনশীপ অফিসে নিয়ে আমাদের জানানো হলো, রাখাইন রাজ্যে আমাদের সফর বাতিল করা হয়েছে। আমরা যে রাখাইনে যাচ্ছি সেই খবর রাজধানীতে আং সান সুচির সরকারের কানে পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে নির্দেশ এসেছে আমাদের থামানোর।
আমরা আবার নৌকায় উঠে ফিরে আসার আগে স্থানীয় এক কর্মকর্তা আমাদের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে একটা সাক্ষাৎকার দিতে রাজী হলেন।
এটাকেও একটা ছোটখাট বিজয় বলা যেতে পারে। আং সান সুচি আর তাঁর মুখপাত্র এ পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলতে ক্রমাগত আমাদের সব আবেদন খারিজ করেছে।