মিয়ানমার থেকে নাফ নদীতে ভেসে এলো বাংলাদেশি নাগরিকের লাশ
ডেস্ক রিপোর্টঃ থেমে থেমে গুলি আর মর্টার শেলের বিকট শব্দে এখনো কেঁপে উঠছে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফ অঞ্চল। এদিকে সোমবার উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে এক নিখোঁজ বাংলাদেশি জেলের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
গত পহেলা ফেব্রুয়ারি নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে সীমান্তের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর হাতে অপহৃত হয়েছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান নামে ঐ মৎস্যজীবী।
নিহত ব্যক্তির পরিবার ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিবিসি বাংলাকে জানান, “মিয়ানমারের কোনও একটি বাহিনীর হাতেই অপহরণের পর খুন হন মোস্তাফিজুর রহমান।”
উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নিখোঁজের ১৮ দিন পর তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া গেছে নাফ নদীতে। লাশের গায়ে আমরা আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। পোস্ট মর্টেমের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। এটা নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।”
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে নতুন করে গোলাগুলি না হওয়ায় গত কয়েকদিন ধরে উখিয়ার সীমান্ত এলাকা কিছুটা শান্ত আছে। তবে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের ওপার থেকে আবারো মিয়ানমারের গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরে।
এমন অবস্থায় নৌযান চলাচলের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনায় নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন।
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আদনান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে নদীতে মাছ ধরার ট্রলার ও জনসাধারণের চলাচল বন্ধ রেখেছি।”
যেভাবে মারা গেলেন মোস্তাফিজ
কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নেরে আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত এলাকা থেকে গত পহেলা ফেব্রুয়ারি নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি।
রোববার রাতে উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিলের নাফ নদীর বেড়িবাঁধের পাশে নাফ নদীর ছোট খালে একটি মরদেহ দেখতে পান স্থানীয় বাসিন্দারা। সে সময় মরদেহটি ছিল একটি কম্বলে পেঁচানো।
পরে স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবারের সদস্যরা মোস্তাফিজের মরদেহ সনাক্ত করে লাশটি বাড়িতে নিয়ে যান। মোস্তাফিজ পেশায় ছিলেন জেলে ও দিনমজুর।
মোস্তাফিজের ছোট ভাই আমির হোসেন জানান, “গত পহেলা ফেব্রুয়ারি সকালে অন্য জেলেদের সঙ্গে নাফ নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন মোস্তাফিজ। সেখান থেকেই মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর লোকেরা আমার ভাইকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল।”
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকারি বাহিনী হোক কিংবা মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীই হোক তাকে যারা হত্যা করেছে তারা মিয়ানমারের। অসহায় বাংলাদেশি জেলের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা বিচারের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।”
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা এখন কার বিরুদ্ধে মামলা করবো? যদি তাকে বাংলাদেশের কেউ মারত, তাহলে প্রচলিত আইনে মামলা করা যেত। অন্য একটা দেশের নাগরিকরা হত্যা করলে এ ব্যবস্থা সরকারকেই নিতে হবে।”
উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা খবর পেয়ে থানা থেকে অফিসার পাঠিয়ে সেটার ময়না তদন্তের ব্যবস্থা করেছি। তাকে হয়তো দুই তিন দিন আগে হত্যা করা হয়েছে। আইনি বিষয়গুলো এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।”
কেঁপে উঠছে টেকনাফ
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পূর্ব ও দক্ষিণাংশের ওপারে মিয়ানমার সীমান্ত গতকাল রোববার কিছুটা শান্ত ছিল। রোববার মধ্যরাত পর্যন্ত পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত ছিল বলে বিবিসিকে জানান স্থানীয় বাসিন্দারাও।
স্থানীয়রা জানান, সোমবার ভোর পাঁচটা থেকে একের পর এক বিকট আওয়াজ ও গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় থাকেন সাংবাদিক জাকারিয়া আলফাজ। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, রবিবার দিনভর গোলাগুলি বন্ধ দেখে বাসিন্দাদের মনে একটু স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু সোমবার সকাল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত আবার গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়।
মি. আলফাজ বলেন, “এরপর সারা দিন থেমে থেমে কিছুক্ষণ পরপর গোলাগুলি হয়েছে। তবে সেটির পরিমাণ ছিলও অনেক কম।”
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আব্দুস সালাম বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, “রবিবার রাতে কমলেও সোমবার সকালে গোলাগুলির গুলির শব্দ শোনা গেছে। এতে মানুষজনের মধ্যে যে আতঙ্ক ছিল তা কমছেই না।”
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এখন গোলাগুলি হচ্ছে সে জন্য মানুষের মধ্যে এক ধরণের আতঙ্ক তো আছেই। আমাদের যেহেতু সিকিউরিটি ব্যবস্থা নেওয়া আছে, তারা সীমান্ত এলাকায় পাহারা জোরদার করেছে।”
তবে, এদিন কিছুটা শান্ত ছিলও উখিয়া অংশের বালুখালী থেকে হোয়াইখ্যং সীমান্ত এলাকা।
সেখানকার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে বালুখালী থেকে হোয়াইখ্যং সীমান্তের পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত রয়েছে।”
টেকনাফের বিজিবি ব্যাটেলিয়নেরর অধিনায়ক লেফট্যান্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আজকেও সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় গোলাগুলির শব্দ পেয়েছি আমরা। তবে যে জায়গায় গোলাগুলি হয়েছে সেটি সীমান্ত বাংলাদেশের লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে।”
“মাঝখানে নাফ নদী ও লবণ চাষাবাদের জায়গা থাকার কারণে নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা ঝুঁকি আছে বলে আমি মনে করি না”, জানাচ্ছেন তিনি।
নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধ
কক্সবাজারের উখিয়া টেকনাফ সীমান্ত এলাকা থেকে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে দুই সপ্তাহ ধরে। কখনো থেমে থেমে, কখনো একটানা চলতে থাকে গোলাগুলি।
এমন পরিস্থিতিতে গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন।
এ সপ্তাহ থেকে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ভেতরে গোলাগুলি বেড়ে যাওয়ায় শাহপরীর দ্বীপ এলাকার জেটি-ঘাটে মানুষজনের চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
নাফ নদীতে মাছ ধরার ট্রলারসহ সব ধরণের নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছে স্থানীয় প্রশাসন।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “আমরা নাফ নদীতে মাছ ধরার জন্য নৌকা চলাচল সব বন্ধ রেখেছি। দুই দেশের সীমান্তের মাঝে বড় নাফ নদী আছে সে জন্য কৃষিতে খুব বেশি সমস্যা হবে না।”
তিনি বলেন, “এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি আছে, কোস্টগার্ড আছে, পুলিশ আছে। ওনারা সরকারকে যে ধরনের ইনফরমেশন পাঠাচ্ছেন সে অনুযায়ী সরকার আমাদের যে ধরনের নির্দেশনা দিচ্ছে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।”
মিয়ানমারের অভ্যন্তরের এই সংঘাতের কারণে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল এ মৌসুমে আর চালু না হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন।
গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে উত্তপ্ত বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তের এসব এলাকা।
পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় গত দুই সপ্তাহ ধরে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ ও নাফ নদীতে মাছ ধরার ট্রলার ও নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
গত কয়েকদিনে নাফ নদী দিয়ে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করতে দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের।
তবে টেকনাফ ব্যাটেলিয়নের বিজিবি কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “প্রথম থেকেই আমরা যেমন সতর্ক ছিলাম সেরকম সতর্কই আছি। মিয়ানমারের ওপাশে থেমে থেমে গোলাগুলি হচ্ছে, আবার বন্ধ হচ্ছে। কিন্তু আমরা সব সময়ের জন্য সতর্ক আছি।”
মি. আহমেদ বলেন, “রোহিঙ্গারা কখনো কখনো ঢোকার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা এত চাপ অনুভব করছি না। আমাদের কাছে সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। আমরা সেই নির্দেশনা অনুসরণ করছি।”
এ কয়েকদিন টেকনাফ সীমান্তের ওপারে পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকলেও উখিয়া অঞ্চল কিছু শান্ত ছিল। উখিয়া থেকে রোববার রাতে বাংলাদেশি অপহৃত জেলের মরদেহ উদ্ধারের পর নতুন করে আতঙ্ক ছড়ায় ওই অঞ্চলে।
এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করে মাইকিং হয়েছে সোমবার সকাল থেকে। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সতর্ক অবস্থায় চলাচলের জন্য বলা হয়েছে।
পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সীমান্তে লাশ ভেসে আসার খবরে মানুষজন খুব আতঙ্কিত। আমার ইউনিয়নে তাই সকাল থেকে মাইকিং করা হয়।”
“মানুষজনকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। অপ্রয়োজনে কাউকে সীমান্তের কাছাকাছি না যাওয়ার জন্যও বলা হয়েছে”, জানান তিনি।
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আদনান চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “সীমান্তের এই পরিস্থিতি কবে নাগাদ শান্ত হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তাই স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে সতর্ক করছি। স্থানীয়দের বলা হয়েছে নদীর ওদিকে না যাওয়ার জন্য।”