মেয়র নির্বাচনে আমি অংশ নিচ্ছি না,দয়া করে ক্ষমা করবেন: আরিফুল হক
খালেদ আহমেদ, সিলেটঃ
শনিবার (২০ মে) বিকালে পূর্ব ঘোষিত নগরীর ঐতিহাসিক রেজিস্ট্রারি মাঠে জনসভায় আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান বিএনপির কেন্দ্রীয় এই নেতা আরিফুল হক চৌধুরী।
আরিফুল হকের সিদ্ধান্তের কথা শুধু সিলেটে নয়, গোটা দেশে ও বিদেশের মানুষ ছিলেন অপেক্ষায়। কী সিদ্ধান্ত আসে। অবশেষে তিনি দৃঢ় কন্ঠে সেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
স্পষ্ট ভাবে তিনি জানিয়ে দিলে প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। সরে দাঁড়ালেন। তখন রেজিস্ট্রারি মাঠজুড়ে পিনপতন নীরবতা। হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন আরিফ, ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরলেন।
তার এই সিদ্ধান্তে অনেক সমর্থক যেমন আহত হয়েছেন তেমনিভাবে দেশে বিদেশে মিডিয়া টকশোতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রসংশায় ভাসছেন আরিফ।
নির্বাচনে না আসার সিদ্ধান্তে মর্মাহত সিলেট সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
এক সাক্ষাতকারে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বলেন, “তার এই সিদ্ধান্তে আমি মর্মাহত। এখনো আরো তিন দিন বাকি আছে, আমি আশা করি তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে সড়ে আসবেন। দলকে বুঝিয়ে ধানের শীষ প্রতীকে তিনি নির্বাচনে আসবেন।”
আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মনোনয়ন পেয়ে এবং আপনাদের অভূতপূর্ব ভালোবাসা ও দোয়ায় গতবার নানা প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমি নির্বাচনে মেয়র হয়ে আপনাদের খেদমত করার সুযোগ পেয়েছি।
পরিবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেন। ইভিএম প্রসঙ্গ টানলেন। পুলিশের ধরপাকড়ের বিষয়টিও উত্থাপন করলেন। এরপর জানিয়ে দিলেন নির্বাচন করছেন না। তার এই ঘোষণার পর রেজিস্ট্রারি মাঠে পিনপতন নীরবতা। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কেউ কেউ প্রতিক্রিয়া দেখালেন।
তিনি সিলেটের রাজনৈতিক সম্প্রতির উদাহরণ তুলে ধরে এ সময় বলেন, ‘এই সিলেট রাজনৈতিক সম্প্রীতির একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। যার ধারাবাহিকতায় আমরা অতীতে দেখেছি কিভবে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান তৎকালীন মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে সহযোগিতা করেছেন। একইভাবে আমি আরিফুল হক সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং পরবর্তী সময়ে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেনের আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি।
এমনকি সরকারপ্রধান হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকাশ্যে আমার কাজের প্রশংসা করেছেন। এই প্রশংসা আমার নয়, এই অর্জন এই নগরবাসীর।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি এটুকু বলতে চাই, ইদানীং নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেকেই বলেছেন আমি যে কাজ করেছি তা অপরিকল্পিত উন্নয়ন। এমন দাবি অত্যন্ত হাস্যকর। যেখানে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি আমার কাজের প্রশংসা করেছেন সেখানে এসব কথাবার্তা একেবারে মূল্যহীন ও অর্থহীন।’
তিনি বলেন, ‘টানা কয়েকবার সিলেট সিটি করপোরেশন কাজের মাধ্যমে প্রথম হওয়ার সম্মান অর্জন করেছে। এই অজর্ন নগরবাসীর। সুতরাং যারা ঢালাওভাবে এসব অভিযোগ করেছেন তাদের এসব হয়তো জানা নেই। মূলত তাদের এ বিষয়ে জ্ঞানের অভাব থেকে তারা এসব বলছেন।’
নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে নির্বাচনের পরিবেশ আছে? নাই। বিশ্বের উন্নত দেশ যখন ইভিএমকে না বলে দিয়েছে, দেশের আপামর জনগণ যেখানে ইভিএমকে নাকচ করেছে সেখানে তারা সিসিক নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে এসেছে। এটা কিসের লক্ষণ? এটা আরেকবার ডাকাতির লক্ষণ।’
সাবেক মেয়র আরিফ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন যদি সুষ্ঠু নির্বাচন চাইত তাহলে ছয় মাস আগে ইভিএম নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারত, কিন্তু করেনি। কারণ তারা চায় না সুষ্ঠু নির্বাচন।’ তিনি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘সিলেটের যেকোনো ইউনিয়নে ভোট নিয়ে দেখুন ৯৯ ভাগ মানুষ ইভিএমকে না বলবে।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো তিনি মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৮ সালে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে জয়লাভ করেন। এবার সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ছিল আরিফের জন্য অগ্নিপরীক্ষা।
বিএনপি থেকে আগেই সবাইকে সিটি নির্বাচন না করার কথা জানিয়ে দেয়া হয়। ছাড় পাননি মেয়র আরিফও। লন্ডনে গিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করেছেন। ওখান থেকে মিললো রেড সিগন্যাল। বিএনপি’র সবাই একবাক্য্যে নির্বাচনে যেতে বারণ করলেন। ঢাকায় গিয়ে দলের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন। তার তরফ থেকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসেনি। ২০ দিন নগরের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। অনেকেই ইতিবাচক ছিলেন। বেশিরভাগই ভোটে দাঁড়ানোর পক্ষে না। সিলেটের আলেম-উলামা সমাজের সঙ্গে কথা বললেন। বরুনার পীর হযরত মাওলানা রশিদুর রহমান ফারুক ওমরা থেকে আসার পর দেখা করলেন।
সিলেটের মারা যাওয়া আলেম দরগাহের মুহতামিম হযরত মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি হুজুরের সঙ্গেও দেখা হলো। কেউ-ই ভোটে দাঁড়ানোর পক্ষে মত দিলেন না। সর্বশেষ নিজের বৃদ্ধা মায়ের মতামত নিলেন। মা-ও না করে দিলেন। এরপর সিদ্বান্ত নিতে আর দেরি করেননি আরিফুল হক চৌধুরী। শুক্রবারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। নির্বাচন করবেন না। তবে শুক্রবার বিকালে প্রশাসনের ঘটনা তাকে মর্মাহত করেছে।
রেজিস্ট্রারি মাঠে ঢুকতে না দেয়ায় বসে যান ফটকে। অবশেষে তিনি নাগরিক সভার অনুমতি পান। শনিবার বিকালে হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে তিনি জানিয়ে দিলেন সিদ্ধান্ত। নাগরিক সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হাসান জীবন, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উদ্দিন মিলন, কেন্দ্রীয় সহ-ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকসহ সিলেটের সিনিয়র নেতারা।
তবে বক্তৃতা করলেন কেবল মেয়র আরিফ একাই। এর আগে আরিফুর হক চৌধুরী দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নিজ বাসা কুমারপাড়া থেকে হেঁটে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারে পৌঁছান।এর আগে হযরত শাহজালাল (রহ.)’র মাজার জিয়ারত করেন আরিফ। পরে বিকাল ৩টায় মাজার প্রাঙ্গণ থেকে হেঁটে হেঁটে তিনি রেজিস্ট্রারি মাঠে পৌঁছেন। এ সময় তার সঙ্গে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী ছিলেন। আসার সময় তিনি হাত উঁচিয়ে নগরবাসীকে অভিভাবাদন জানান। রেজিস্ট্রারি মাঠে দীর্ঘ বক্তৃতায় মেয়র আরিফ পরপর দুইবার তাকে নির্বাচিত করায় নগরবাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
তিনি বর্তমান পরিবেশ তুলে ধরে বলেন, প্রশাসনের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে এসেছেন। এজন্য্য তারা গত দু’সপ্তাহ ধরে তার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছেন। অতীতে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। সিলেটের সম্প্রীতির কারণে সবাই মিলেমিশে নির্বাচন করেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। এবার বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে ধরপাকড় করা হয়েছে।
অনেকের বাসাবাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। যারাই তার পক্ষে রয়েছেন তাদেরকেও নানাভাবে হুমকি দেয়া হচ্ছে। এতে করে সিলেটে ভোটের পরিবেশ নেই। এই অবস্থায় তিনি নির্বাচন করলে দমন পীড়ন বাড়বে বলে আশঙ্কা করেন আরিফ। নির্বাচন করলে মামলা, গ্রেপ্তার, তল্লাশি বাড়বে। ফলে তিনি তার দলের নেতাকর্মী এবং নগরবাসীকে এই হয়রানির মুখে ফেলতে চান না বলে জানান।
বক্তৃতায় বার বার ইভিএম নিয়ে শঙ্কা জানান আরিফ। বলেন, ইভিএম ভোট এখনো আস্থা অর্জন করতে পারেনি। আপনি ভোট দেবেন এক জায়গায়, যাবে অন্য জায়গায়। এই ভোটে কোনো বিশ্বাস নেই। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে শঙ্কার কথাও জানান।
মেয়র আরিফ জানান, তিনি বিএনপি’র একজন কর্মী। তিলে তিলে এই দলের ভেতরেই তিনি বেড়ে উঠেছেন। এই দলের শীর্ষ নেতারাও নির্বাচনের পক্ষে না। অতীতে কখনো দলের বিরুদ্ধে যাননি, ভবিষ্যতেও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাবেন না। এ কারণে সর্বাগ্রে দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নির্বাচন না করার সিদ্বান্ত নেন।
মেয়র আরিফ তার বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে বলেন, ‘বিএনপি আমার রক্তে রন্ধ্র্রে অস্থি মজ্জায়। আমি আপনাদের আরিফ, বিএনপির আরিফ হয়ে অন্ধকারের গহীনে ফেলতে পারি না দেশবাসীকে।
স্পষ্টত এই নির্বাচন হবে প্রহসনের নির্বাচন। সুতরাং এই প্রহসনের নির্বাচনে অংশ নেয়ার কোনো প্রশ্নই উঠে না, তাই আমার দলীয় এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।
‘আরিফ বলেন, যাদের পরামর্শ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করি, আমার মাতৃতুল্য পরম শ্রদ্ধাভাজন বেগম খালেদা জিয়া এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবং আমার মা জননী ও আমার মুর্শিদ বারণ করেছেন এমন প্রহসনের নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে।
আজ সিলেটের অলিতে গলিতে নানা প্রান্তে লাখো জনতা যারা আমি নির্বাচন করবো বলে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিলেন নির্বাচনে অংশ নেয়ার বারবার অনুরোধ জানিয়ে আসছেন, সেইসব লাখো জনতার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান জানাচ্ছি, কিন্তু এবার আপনারা সবাই আমাকে দয়া করে ক্ষমা করবেন।’
তিনি জনগণ ও গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আমি জানি আমার ওপর ষড়যন্ত্র হতে পারে। আরিফুল হক আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায় না। আমার বাসা থেকে নিরাপত্তা সরিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু আমার আল্লাহ আমার সঙ্গে আছেন, নগরের জনগণ আমার সঙ্গে আছেন। আমি ভয় পাই না।’