মেহেদির রঙে হাতে ফুটিয়ে তুলতাম গাণিতিক সূত্র- মালালা ইউসুফজাই
মালালা ইউসুফজাই। এক আন্দোলনের নাম, এক প্রেরণার নাম। ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ বিশ্বের কনিষ্ঠতম এই নোবেলজয়ী পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন তার জীবনের গল্প, জানিয়েছেন স্বপ্নের কথাও। বর্ষপূর্তিতে বাংলা সংলাপ পাঠকদের জন্য মালালার সেই নোবেল স্পিসের চুম্বক অংশ অনুবাদ করেছেন নাজমিন আরা
নোবেল কমিটিকে ধন্যবাদ, এই পুরস্কার দিয়ে আমাকে গর্বিত করার জন্য। এ পুরস্কার শুধু আমার একার নয়। এটি সেই সব শিশুর যারা শিক্ষার্জন করতে চায়, সেই সব ভয়ার্ত নির্বাক শিশুর, যারা শান্তি চায়, চায় পরিবর্তন।
আমি লক্ষ করেছি, মানুষ আমাকে নানা নামে ডাকে। কেউ বলে সেই মেয়েটি যাকে তালেবানরা গুলি করেছিল, যে শিক্ষার জন্য লড়াই করে। এখন বলে সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ী। কিন্তু আমি জানি, আমি খুবই সাধারণ একটি মেয়ে, যার চাওয়া পৃথিবীর সব শিশু মানসম্মত শিক্ষালাভ করুক, নারীরা সমান অধিকার পাক আর পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত হোক শান্তি। আমি আমার ১৭ বছরের জীবনে একটি জিনিসই শিখেছি- শিক্ষা সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আমার বয়স যখন ১০ বছর, তখন পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় সোয়াত উপত্যকা ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি, পর্যটনের স্বর্গরাজ্য। আমার মনে আছে, আমি স্কুল খুব ভালবাসতাম এবং সব সময় নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করতাম। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা বন্ধুরা যখন হাতে মেহেদি লাগাতাম, তখন ফুল কিংবা নকশা আকার বদলে মেহেদির রঙে আমরা হাতে ফুটিয়ে তুলতাম গাণিতিক সূত্র আর সমীকরণ! ছোট্ট ক্লাসরুমে সবাই একসঙ্গে বসে পড়াশোনা করেছি কিন্তু আমাদের চোখের স্বপ্নটা ছিল অনেক বড়। আমরা আমাদের বাবা-মাকে গর্বিত করতে চেয়েছি, শিক্ষিত হয়ে ভালো কিছু অর্জন করতে চেয়েছি। অনেকের ধারণা, যা শুধু ছেলেরাই পারে।
কিন্তু পরিস্থিতি হঠাৎ বদলে গেল। আমার সৌন্দর্যের স্বর্গরাজ্য সোয়াত পরিণত হলো সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে। সেখানে ধ্বংস করা হলো চার শতাধিক স্কুল। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে মেয়েদের বন্দী করা হলো ঘরে। শিক্ষা অধিকার নয়, গণ্য হলো অপরাধ হিসেবে। নিরীহ লোকদের নির্বিচারে হত্যা করা হলো। আমরা সবাই চরম দুর্ভোগে দিন কাটাতে লাগলাম। চোখের সামনে স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিল। কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের লক্ষ্যটাও বদলে নিলাম।
আমার সামনে দুটি পথ খোলা ছিল। এক. চুপ করে ঘরে বসে থাকা আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। দুই. প্রতিবাদ করা আর খুন হওয়া। আমি দ্বিতীয়টিকেই বেছে নিলাম। শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে এলাম। সন্ত্রাসীরা আমাদের স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর তালেবানরা আমাদের আক্রমণ করে। কিন্তু তাদের বুলেট জয়ী হতে পারেনি এবং তারপর থেকে দিনে দিনে আমাদের আওয়াজ শুধু জোরালোই হচ্ছে। এ গল্প এ কারণে বলছি না যে এটি শুধু আমার গল্প, আলাদা কিছু। বরং এটা বলছি, কারণ এ গল্প সাধারণ পাঁচটি মেয়ের গল্প, বঞ্চিত প্রতিটি শিশুর গল্প। ধন্যবাদ আমার বাবাকে, যিনি আমার ডানা বেঁধে রাখেননি। আমাকে মুক্ত আকাশে উড়তে দিয়েছেন। ধন্যবাদ মাকে, যিনি সব সময় আমাকে ধৈর্য ধারণের প্রেরণা জুগিয়েছেন, সত্য বলার তাগিদ দিয়েছেন, যা ইসলামের মূল বক্তব্য।
হামলার ঘটনার পর আমার সাহস আরো বেড়ে গেছে। এখন আমি জানি কোনো অপশক্তিই আমাকে থামাতে পারবে না। আজ আমি আর একা নই। আমার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় সাড়ে ছয় কোটিরও বেশি মেয়ের কণ্ঠ, যারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, যাদের শিশুশ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে, জোরপূর্বক দেয়া হচ্ছে বাল্যবিবাহ। আমরা সবাই আজ একসঙ্গে দাঁড়িয়েছি।
অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, শিক্ষা, বিশেষ করে নারীশিক্ষা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? আমি সব সময় একটি জবাবই দিয়ে এসেছি, যা আমি পবিত্র কোরআন শরিফের প্রথম দুই পারায় শিখেছি। ‘ইকরা’ অর্থাৎ পড় এবং ‘নূন ওয়াল কালাম’ যার অর্থ কলমের সাহায্যে। আরো একটি কথা, যা আমি প্রায়ই বলি- একটি শিশু, একজন শিক্ষক, একটি বই এবং একটি কলমই পারে পৃথিবীটাকে বদলে দিতে।
একদিকে পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে কিছু কিছু দেশ এখনো ক্ষুধা, দারিদ্র্য, ন্যায়বিচারের অভাব এবং সংঘাতের মতো হাজার বছরের পুরনো সমস্যায় জর্জরিত। এভাবে সার্বিক উন্নয়ন কিংবা স্থায়ী পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিশ্ব নেতাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা এক হয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করুন। অনেকেই বলবেন এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, প্রায় অসম্ভব। কিন্তু ট্যাংক, পরমাণু অস্ত্র তৈরি কি ব্যয়বহুল না? একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমরা জানি কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। আমরা ওই সব দেশকে ক্ষমতাধর বলি যারা যুদ্ধ সৃষ্টিতে খুবই পারদর্শী কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ। কেন কামান তৈরি সহজ আর স্কুল তৈরি করা কঠিন? কেন হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া সহজ অথচ বই তুলে দেয়া কঠিন?
বিশ্ববাসীর সময় এসেছে বড় কিছু ভাবার। তাই আসুন, সবার জন্য সমঅধিকার, ন্যায়বিচার আর শান্তি সুনিশ্চিত করি। আর যেন কোনো শিশুকে কষ্ট পেতে না হয়। আর যেন কারো শৈশব কারখানায় না কাটে, আর যেন কোনো মেয়ে বাল্যবিয়ের শিকার না হয়, আর যেন কোনো নিষ্পাপ শিশু যুদ্ধে প্রাণ না হারায়, আর যেন ক্লাসরুমগুলো খালি না থাকে। শুধু রাজনীতিবিদ নয়, এটা আপনি, আমি, আমাদের সবার দায়িত্ব।
আমি এই নোবেল পুরস্কারের প্রাইজমানি মালালা ফান্ডে দান করছি, যেখান থেকে অসহায় মেয়েদের শিক্ষার জন্য ব্যয় করা হবে। এ ফান্ড থেকে আমি পাকিস্তানে স্কুল নির্মাণ করতে চাই, বিশেষ করে আমার গ্রামে। সেখানে এখনো পর্যন্ত মেয়েদের জন্য কোনো মাধ্যমকি বিদ্যালয় নেই। এতে করে শিশুরা পড়াশোনার সুযোগ পাবে এবং তাদের স্বপ্নগুলো সত্যি করতে পারবে। আমি আমার গ্রাম থেকে শুরু করতে চাই; কিন্তু সেখানেই থেমে থাকব না। যত দিন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রতিটি শিশু বিদ্যালয়ে যেতে না পারছে, আমার লড়াই চলবে।