যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য নীতিতে নতুন দ্বিধা: ইইউ”র ঘনিষ্ঠতা বনাম যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা
সৈয়দ আতিকুর রব:
বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধের সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বাণিজ্য নীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে । এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্য নিজেকে একটি কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি দেখতে পাচ্ছে—ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা বাড়ানো।বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সাবেক প্রধান পাসকাল ল্যামি এবং ইইউতে যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত ইভান রজার্স এই প্রশ্নে বিশদ মতামত দিয়েছেন। তাঁদের মতে, যুক্তরাজ্যের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্বার্থ ইইউর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার মধ্যেই নিহিত।
পাসকাল ল্যামি বলেন, যুক্তরাজ্যের বাণিজ্যের প্রায় তিনগুণ বেশি অংশ ইইউর সাথে হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যের তুলনায় অনেক বেশি। তিনি মনে করেন, ইইউর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো যুক্তরাজ্যের সাথে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের “কঠোর পুঁজিবাদ” মডেল ব্রিটিশ অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।তিনি বলেন, “যুক্তরাজ্যের ইইউর সাথে কাঠামোগত বাণিজ্য নির্ভরতা এতটাই গভীর যে এটি সহজে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। যদি যুক্তরাজ্য ইইউর বাণিজ্য মানদণ্ড ত্যাগ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গ্রহণ করে, তবে এটি যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।”
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় চীনা পণ্যের উপর ৬০% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্প ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের কাছ থেকেও একই ধরনের শুল্ক আরোপের প্রত্যাশা করবেন। তবে ইইউ এবং যুক্তরাজ্য উভয়ই এই চাপ প্রতিহত করবে, কারণ এটি তাদের নিজস্ব বাণিজ্য স্বার্থের পরিপন্থী।
ট্রাম্প প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা স্টিফেন মুর সম্প্রতি বলেন, “যদি যুক্তরাজ্য ট্রাম্পের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে চায়, তবে তাদের ইইউর তথাকথিত ‘সামাজিকতান্ত্রিক মডেল’ প্রত্যাখ্যান করতে হবে।” মুর আরও বলেন, “যুক্তরাজ্য যদি ইইউর মতো মানদণ্ড বজায় রাখে, তবে তারা ট্রাম্প প্রশাসনের ২০% শুল্ক এড়াতে পারবে না।”
ইউরোপের সাথে যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠ থাকার বেশ কিছু কারণ রয়েছে:
১. ভৌগোলিক নৈকট্য:
ইইউ যুক্তরাজ্যের প্রতিবেশী। পণ্য পরিবহন, সরবরাহ চেইন, এবং বাণিজ্যের জন্য ভৌগোলিক সুবিধা বজায় থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ সহজ এবং কম ব্যয়বহুল।
২. বাণিজ্য সম্পর্কের গভীরতা:
ইইউর সাথে যুক্তরাজ্যের দীর্ঘদিনের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। ব্রেক্সিটের পরও ইইউ যুক্তরাজ্যের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার।
৩. সামাজিক ও অর্থনৈতিক মডেল:
ইইউর সামাজিক নিরাপত্তা, শ্রম অধিকার, এবং পরিবেশ নীতিগুলি যুক্তরাজ্যের কাঠামোর সাথে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের মডেল বেশি প্রতিযোগিতামূলক এবং কঠোর।
৪. স্বাধীনতা বজায় রাখা:
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গভীর মিত্রতা মানে কৃষি, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য খাতে তাদের শর্ত মেনে চলা। এটি যুক্তরাজ্যের জন্য স্বাধীন নীতি গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা: লাভ এবং ঝুঁকি
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার কিছু সুবিধা থাকতে পারে। যেমন: প্রযুক্তি এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতা: যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়তে পারে।
বিশ্ব বাণিজ্যে প্রভাব বৃদ্ধি: যুক্তরাষ্ট্রের সাথে জোট গঠন করলে যুক্তরাজ্যের বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতিতে প্রভাব বাড়তে পারে।
বিনিয়োগ প্রবাহ: মার্কিন বিনিয়োগ যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে ঝুঁকিগুলিও কম নয়:
কৃষি ও স্বাস্থ্য মানদণ্ড: যুক্তরাষ্ট্রের শর্তে যুক্তরাজ্যের কৃষি ও স্বাস্থ্য খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
ইইউর সাথে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া: যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে চললে ইইউর সাথে স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য মানদণ্ডে সমঝোতা সম্ভব হবে না।
রাজনৈতিক চাপে পড়া: যুক্তরাষ্ট্রের শর্তযুক্ত চুক্তি যুক্তরাজ্যের স্বাধীন বাণিজ্য নীতিকে প্রভাবিত করতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ব্রাজিলে জি২০ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন। সেখানে তিনি চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাথে আলোচনা করবেন। এছাড়াও, বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং অর্থনৈতিক নীতিতে যুক্তরাজ্যের অবস্থান সুসংহত করার জন্য এই সফর গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সরকারি সূত্র জানিয়েছে, “ট্রাম্পের পুনঃনির্বাচনের পরে বাণিজ্য কৌশল তৈরি করা আমাদের জন্য শীর্ষ অগ্রাধিকার হয়ে উঠেছে।”
সাবেক ইইউ রাষ্ট্রদূত জোয়াও ভালে দে আলমেইদা মনে করেন যে, যুক্তরাজ্যের জন্য উভয় পক্ষের সাথে সীমিত চুক্তি করাই সবচেয়ে বাস্তবসম্মত উপায়। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে, “ট্রাম্প ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার চেষ্টা করবেন।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইইউর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখাই যুক্তরাজ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রতা কিছু সুবিধা আনলেও, ইইউর সাথে বিচ্ছিন্নতা যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এখন যুক্তরাজ্যের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—ইইউর মান বজায় রেখে কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়।
সৈয়দ আতিকুর রব, আয়ারল্যান্ড