যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা র্যাবে কী কোন পরিবর্তন এনেছে?
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশে পুলিশের বিশেষ বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাব এবং এর সাতজন কর্মকর্তার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার এক বছর পেরিয়ে গেলেও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন যে, কথিত বন্দুকযুদ্ধ কিছুটা কমে আসা ছাড়া আর তেমন কোন পরিবর্তন এই বাহিনীতে দেখা যাচ্ছে না।
২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দফতরের ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস বিভিন্ন দেশের মোট ১০টি প্রতিষ্ঠান ও ১৫ জন ব্যক্তি যারা, তাদের ভাষায়, মানবাধিকার লংঘন ও নিপীড়নের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাদের উপর এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল।
এই নিষেধাজ্ঞারই অন্তর্ভূক্ত ছিল র্যাব ও এর ছয় জন কর্মকর্তা।
এছাড়া আলাদা আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে, বেনজির আহমেদ এবং র্যাব-৭ এর সাবেক কমান্ডার মিফতাহ উদ্দিন আহমেদের উপর যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।
তখন মার্কিন অর্থ দফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল যে, ‘গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ কারণে তাদের উপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
এর আওতায় নিষেধাজ্ঞাভুক্ত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পান না এবং একই সাথে তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলেও বিবেচিত হন।
আর র্যাবও প্রতিষ্ঠান হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে যেসব সহযোগিতা পাচ্ছিলো সেগুলোও বাতিল হয়।
একই সাথে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের বিদেশে সম্পদ থাকলে সেগুলো বাজেয়াপ্ত হয়।
কী পরিবর্তন এসেছে ‘ক্রসফায়ারে’?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের বেসরকারি সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে যে র্যাব এবং অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সালে থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬০০টির মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ৬০০র বেশি মানুষের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং নির্যাতনের জন্য দায়ী।
কিন্তু এসব অভিযোগের কি কোন পরিবর্তন হয়েছে?
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ১৮ জন।
এর মধ্যে র্যাবের হাতে মারা গেছে ৬ জন, যাদের মধ্যে ক্রসফায়ার বা কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে চার জন। বাকিরা র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেছে।
নিহতের এই সংখ্যা ২০২১ সালের তুলনায় কয়েক গুণ কম। সেবছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল ৮০ জন।
এর আগের বছরগুলোতে নিহতের এই সংখ্যা কয়েকশতে গিয়ে ঠেকেছিল। যেমন ২০২০ সালে র্যাবের হাতে ৬১জন সহ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল ২২২ জন। ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিল ৩৮৮ জন, যাদের মধ্যে র্যাবের হাতে মারা গিয়েছিল ১০২ জন।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞার পর র্যাবের হাতে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা কমলেও, এই বাহিনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন আসেনি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান বলেন, নিষেধাজ্ঞার পর ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে মাত্র চারটি। সংখ্যাগত দিক থেকে একটা পরিবর্তন এসেছে।
তবে তিনি মনে করেন, আচরণগত বা ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার ক্ষেত্রে এখনো কোন পরিবর্তন আসেনি।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বর্তমানে সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয়টি হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া এবং সভা-সমাবেশের অধিকার ক্ষুন্ন হওয়া।
“মানুষকে নানা ভাবে হয়রানি করা, মিথ্যা মামলা দেয়া, এবং সেটা দিয়ে যে গণগ্রেফতার, যাকে তাকে গ্রেফতার এবং বিরোধীদল ও মতের মানুষকে গ্রেফতার, এটার ব্যাপকতা কিন্তু বাড়ছে সাম্প্রতিক কালে,” বলেন তিনি।
তিনি বলেন, দেশের ভেতরে এবং বাইরে চাপ সৃষ্টি হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কিছুটা আইনের ভেতরে থেকে কাজ করার চেষ্টা করে। তবে এই চাপ দুর্বল হয়ে গেলে কৌশল পরিবর্তিত হলেও নির্মমতার পরিবর্তন হয় না।
নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিরা কোথায়?
যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তার আওতায় র্যাবের যে কর্মকর্তারা ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন এই বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।
সেসময় র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিলেন কর্নেল খান মোহাম্মদ আজাদ। এদের দুজনের উপরই নিষেধাজ্ঞা ছিল।
এছাড়া বাকি পাঁচজন কর্মকর্তা তখন বাহিনীটিতে কর্মরত ছিলেন না।
তবে নিষেধাজ্ঞার এক বছর পর এর আওতায় থাকা কোন কর্মকর্তাই এখন আর এই বাহিনীতে কর্মরত নেই। বরং তাদের অনেকেই বিভিন্ন সামরিক বাহিনীতে উচ্চ পদে রয়েছেন।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন সেপ্টেম্বরে র্যাবের মহাপরিচালকের পদ থেকে সরে গিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে নিয়োগ পান। বর্তমানে এই পদেই দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
নিষেধাজ্ঞার সময় র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (অপারেশন্স) দায়িত্বে থাকা কর্নেল খান মোহাম্মদ আজাদ র্যাব থেকে মেয়াদ শেষ করে বর্তমানে নিজ বাহিনী বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন।
বেনজির আহমেদ, যিনি নিষেধাজ্ঞার সময় র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ছিলেন, তিনি সেসময় পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব ছিলেন। এ বছরের সেপ্টেম্বরে অবসরে যান তিনি।
কর্নেল তোফায়েল মোস্তাফা সরওয়ার ২০২১ সালের মার্চে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের পদ ছাড়লেও তার উপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। র্যাব ছাড়ার পর সামরিক বাহিনীতে পদন্নোতি পেয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হন মি. সরওয়ার। তিনি বর্তমানে সাভার ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত রয়েছেন এবং সাভার গলফ ক্লাবের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান।
নিষেধাজ্ঞা পাওয়া র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে সেনাবাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন।
এছাড়া সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল এবং তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডে কর্মরত রয়েছ্নে।
নিষেধাজ্ঞা পাওয়া র্যাব-৭ এর সাবেক অধিনায়ক মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত রয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান বলেন, অনেকেই আরো গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন এর কারণ হচ্ছে, এক ধরনের অবজ্ঞা এবং জবাবদিহিতার অভাব।
“স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব থাকলে যেটা হয়, রাষ্ট্র পরিচালনা যারা করেন তারা যখন নিজেদেরকে জবাবদিহিতার ভেতরে আনতে চান না, তখন যেটা করেন সেটাই হয়েছে।”
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখান থেকে বের হওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কারণ গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার হাত ধরাধরি করে চলে। একটিকে ছাড়া অন্যটি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।