যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদল: ‘সুবর্ণ যুগের’ প্রতিশ্রুতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের

Spread the love

আমেরিকার সুবর্ণ যুগ শুরু হলো—যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে অভিষেক ভাষণে এ কথাই বললেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। একই সঙ্গে বললেন যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান করে তোলার কথাও।

সোমবার ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁকে শপথ পাঠ করান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। এ সময় বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, তাঁর স্ত্রী জিল বাইডেনসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সবার উপস্থিতিতে ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলের ওপর হাত রেখে শপথ পাঠ করেন ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প। তিনিই হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে ক্ষমতায় বসা প্রেসিডেন্ট।

এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিলেন ট্রাম্প। এর আগে ২০১৭ সালে ক্যাপিটল ভবনের পাশে ন্যাশনাল মলে বিপুল আয়োজনে শপথ নিয়েছিলেন তিনি। তবে এবার বাদ সাধে তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়া। সে কারণেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে। ৪০ বছর আগে ১৯৮৫ সালে একই কারণে ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে শপথ নিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান।

নিজের প্রথম মেয়াদের তুলনায় এবার ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি ট্রাম্প। দেশের ভেতরে যেমন অর্থনীতি, অভিবাসনসহ নানা সংকট চলছে, তেমনই যুদ্ধবিগ্রহ এবং ক্ষমতার পাল্লাপাল্লিতে অস্থিতিশীল পুরো বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই সবকিছুই সামাল দিতে হবে তাঁকে। এ কাজে পাশে পাবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সকে। ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্পের আগে নতুন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ভ্যান্স।

‘আমেরিকার পতনের দিন শেষ’

শপথ গ্রহণের পর অভিষেক ভাষণ দেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, ঠিক এখন থেকে আমেরিকার সুবর্ণ যুগের সূচনা হলো। আজ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আরও উন্নতি করবে। সারা বিশ্বে আবার সম্মান অর্জন করবে। যুক্তরাষ্ট্রকে দেখে ঈর্ষা করবে সব দেশ। মার্কিনদের ব্যবহার করে কাউকে আর সুবিধা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের পতনের সময় শেষ হয়েছে উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, গত নির্বাচনে তাঁর একটি ম্যান্ডেট ছিল, যেসব প্রতারণা হয়েছে তার জবাব দেওয়া। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের বিশ্বাস, তাঁদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে চান তিনি। এই মুহূর্ত থেকে আমেরিকার পতনের দিন শেষ।

নিজের অভিষেকের দিনকে ‘স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করেন ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারের সময় আততায়ীর হামলার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমেরিকাকে অবার মহান করে তুলতে সৃষ্টিকর্তা তাঁর জীবন বাঁচিয়েছেন।

অভিষেক ভাষণে আলোচিত নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর নিয়েও কথা বলেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, এই নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার যাত্রা শুরু হবে।

গির্জা ও হোয়াইট হাউস হয়ে ক্যাপিটলে ট্রাম্প

শপথ নিতে ক্যাপিটল ভবনে পৌঁছার আগে ট্রাম্প তাঁর স্ত্রী মেলানিয়াকে নিয়ে প্রথমে গির্জা ও পরে হোয়াইট হাউসে যান। ট্রাম্প যথারীতি কোট–টাই পরলেও মেলানিয়ার নজরকাড়া পোশাকে আলাদা করে চোখে পড়ছিল তাঁর হ্যাট।

ট্রাম্প ও মেলানিয়া প্রথমে যান ওয়াশিংটনে সেন্ট জনস এপিস্কোপাল চার্চে। এটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের অভিষেক রীতির অংশ। এ সময় সেখানে ছিলেন ইলন মাস্ক, জেফ বেজোস, সুন্দর পিচাই, টিম কুকসহ প্রযুক্তি অঙ্গনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। চার্চে আনুষ্ঠানিকতা শেষে ট্রাম্প ও মেলানিয়া যান হোয়াইট হাউসে। সেখানে তাঁদের স্বাগত জানান বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও বিদায়ী ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন। হোয়াইট হাউসে চা–চক্রে যোগ দেন। সেখান থেকে নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সবাই রওনা দেন ক্যাপিটলের উদ্দেশে।

ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের আগেই উপস্থিত হন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। অনুষ্ঠানে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামা। ছিলেন ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী কমলা হ্যারিস। অনুষ্ঠানে দেখা গেছে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকেও। বিদেশি নেতাদের মধ্যে ছিলেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই। ঠিক এখন থেকে আমেরিকার সুবর্ণ যুগের সূচনা হলো। আজ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আরও উন্নতি করবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প, প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্র

অনুষ্ঠান শুরুর জন্য অতিথিদের অপেক্ষার মধ্যেই হোয়াইট হাউস থেকে ক্যাপিটলে এসে পৌঁছান ট্রাম্প, মেলানিয়া, বাইডেন ও জিল। ট্রাম্প যখন অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করছিলেন, তখন ভেসে আসছিল গানের সুর। হেঁটে গিয়ে ট্রাম্প নিজের আসনে বসেন। প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জেডি ভ্যান্স। তাঁকে শপথ পড়ান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ব্রেট কাভানা। বাইবেলের ওপর হাত রেখে শপথ নেন জেডি ভ্যান্স। বাইবেল ধরে রেখেছিলেন স্ত্রী উষা ভ্যান্স। এ সময় উষার কোলে ছিল তাঁদের শিশুসন্তান।

এরপর ট্রাম্পকে শপথ পড়ান যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস। তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া বাইবেল ধরে ছিলেন। শপথ শেষ হওয়ার পরপর তোপধ্বনিতে সম্মান জানানো হয় নতুন প্রেসিডেন্টকে।

শপথ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন ক্যারি আন্ডারউড ও ক্রিস্টোফার ম্যাকিও।

আলোচনায় নির্বাহী আদেশ

ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের পরপরই তাঁর বেশ কিছু নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করার কথা। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আলোচনা অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে নির্বাহী আদেশ নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই সোচ্চার ট্রাম্প।

এ ছাড়া অভিষেকের পরপর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–সংক্রান্ত প্রকল্পের গতি বাড়ানো, সরকারের কার্যকারিতাবিষয়ক দপ্তরের গঠনপ্রক্রিয়া, ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে হত্যাসংক্রান্ত নথিপত্র প্রকাশ, আয়রন ডোমের মতো আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা নির্মাণ করতে সামরিক বাহিনীকে নির্দেশনা এবং সামরিক বাহিনীর কিছু নীতি বাতিলসহ নানা নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করার কথা ছিল ট্রাম্পের।

হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের আবার ফিরে আসার পথ সহজ ছিল না। চার–চারটি ফৌজদারি মামলা ঘাড়ে নিয়ে নির্বাচনের মাঠে নেমেছিলেন তিনি। এর মধ্যে একটিতে দোষী সাব্যস্তও হয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় দুবার হামলার শিকার হয়েছেন। একবার তো আততায়ীর গুলি তাঁর কান ছুঁয়ে গেছে। আর নির্বাচনী জরিপে বরাবরই পিছিয়ে ছিলেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কমলা হ্যারিসের চেয়ে। তবে ৫ নভেম্বর নির্বাচনের দিন সব পূর্বাভাস উল্টে দিয়ে বাজিমাত করেন ট্রাম্প।

২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন ট্রাম্প। তবে ওই পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারেননি। পরের বছরের ৬ জানুয়ারি বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার দিন ট্রাম্পের উসকানিতে ক্যাপিটল ভবনে দাঙ্গা শুরু করেন তাঁর সমর্থকেরা। ওই দাঙ্গার জন্য প্রায় ১ হাজার ২৭০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ট্রাম্প আগেই বলে রেখেছেন, ক্ষমতায় বসার দিনই দোষী সাব্যস্ত সবাইকে ক্ষমার পদক্ষেপ নেবেন তিনি।

তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় বসার পর হয়তো বিপদে পড়তে যাচ্ছেন তাঁর রাজনৈতিক শত্রু ও বিরোধীরা। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারের পুরো সময়ে

তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। বলেছিলেন, ‘নির্বাচন শেষ হলে এই লোকগুলোর ওপর চড়াও হওয়ার পুরোপুরি অধিকার আমার রয়েছে। কখনো কখনো প্রতিশোধ নেওয়াটাও ন্যায্য হয়।’

ট্রাম্পকে অভিনন্দন

ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়েছেন দেশ–বিদেশের নেতারা। গতকাল রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে দেওয়া ভাষণে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘সদ্য অভিষিক্ত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছি।’

ট্রাম্পকে স্বাগত জানিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, সামনে যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েলের বন্ধুত্বের সেরা দিনগুলো আসবে। আর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ট্রাম্প যে নীতির ঘোষণা দিয়েছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে আরও শক্তিশালী করার এবং দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার আশা দেখাচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানানো নেতাদের তালিকায় আরও রয়েছেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন ও ন্যাটোর মহাসচিব মার্করুটে।


Spread the love

Leave a Reply