যুদ্ধ কী আসন্ন?

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্ক: বাগদাদ বিমানবন্দরে ড্রোন থেকে মিসাইল ছুড়ে ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলেমানিকে হত্যার মধ্যে দিয়ে বিশ্বকে নতুন উদ্বেগের মধ্যে ঠেলে দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। 

সেই সঙ্গে তিনি বছরের শুরুতেই বিশ্বের মানুষের মনে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন।

ট্রাম্প যা করেছেন তা কী আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা পেতে পারে? জাতিসংঘ এখন কী করবে? এখনই কেন এই পদক্ষেপ নিলেন ট্রাম্প? এই পদক্ষেপ কী তাকে অন্য কোনো সুবিধা দেবে? এর বদলা নিতে কী করতে পারে ইরান?

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- সোলেমানিকে হত্যার ঘটনা কী মধ্যপ্রাচ্য আর বিশ্বকে নতুন যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিল?

আরও অনেকের মত সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও সেই শঙ্কার কথা বলেছেন। তার ভাষায়, বারুদের বাক্সে ডনাল্ড ট্রাম্প ডিনামাইট ছুড়ে দিয়েছেন। 

সোলেমানি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পর দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আলোচিত নাম মেজর জেনারেল কাসেম সোলেমানি।

তিনি ছিলেন বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর এলিট ইউনিট কুদস ফোর্সের প্রধান। বলা হচ্ছে, দেশের বাইরে ইরানের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় সোলেমানি ছিলেন মূল ব্যক্তি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণেও তার ভূমিকা ছিল।

বিবিসি লিখেছে, গত দুই দশক ধরে ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া ও লেবাননের মত দেশে শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে তিনিই ছিলেন প্রধান রূপকার । এর মোকাবেলায় তেহরানের আঞ্চলিক শত্রু সৌদি আরব, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বেগ পেতে হয়েছে। ফলে বহুদিন ধরেই তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ‘টার্গেট’।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও গত এপ্রিলে ইরানের রেভুলিউশনারি গার্ডস ও কুদস ফোর্সকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করেন।

ইরান সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনীর ঘাঁটিতে মার্কিন হামলায় ২৫ জন নিহত হওয়ার পর দুদিন আগে বাগদাদে মার্কিন দূতাবাসে হামলা-ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। জেনারেল কাসেম সোলেমানির পরিকল্পনায় ওই হামলা হয়েছিল বলে পেন্টাগন দাবি করে আসছে, যদিও তা অস্বীকার করেছে ইরান।

অনেক যুদ্ধের ‘কুশলী’ হিসেবে পরিচিত ৬২ বছর বয়সী সোলেমানি নিজের দেশে ছিলেন রহস্যঘেরা এক নায়কোচিত চরিত্র। তার  নিহত হওয়ার খবরে তেহরানের রাস্তায় তার ছবি নিয়ে বিক্ষোভও হয়েছে। 

কে এই সোলেমানি  

কীভাবে হত্যা করা হল সোলেমানিকে?

বিবিসি লিখেছে, লেবানন অথবা সিরিয়া থেকে শুক্রবার ভোরের দিকে বাগদাদে পৌঁছান ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান সোলেমানি ও তার কয়েকজন সঙ্গী। বাগদাদ বিমানবন্দর থেকে দুটি গাড়িতে করে রওনা হন তারা। 

বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালের কাছে মার্কিন ড্রোন থেকে ওই দুই গাড়িতে ছোড়া হয় ক্ষেপণাস্ত্র। তাতে সোলেমানিসহ অন্তত সাতজন নিহত হন। 

রয়টার্স জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে ইরাকি মিলিশিয়া কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহান্দিসও রয়েছেন। জেনারেল সোলেমানির সঙ্গে একই গাড়িতে ছিলেন তিনি। আর তাদের নিরাপত্তার জন্য দ্বিতীয় গাড়িতে ছিলেন আল-মুহান্দিসের পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের সদস্যরা।

ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এক মার্কিন ঠিকাদার নিহতের ঘটনার জন্য ইরানের সমর্থনপুষ্ট পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সকে দায়ী করে আসছে পেন্টাগন। 

কী বলছে যুক্তরাষ্ট্র?

জেনারেল কাসেম নিহত হওয়ার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের পতাকার একটি ছবি টুইট করেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প।

পেন্টাগনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইরাকসহ আশপাশের অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক এবং কর্মকর্তাদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছিলেন সোলেমানি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্দেশে মার্কিন বাহিনী বিদেশে তাদের সদস্যদের সুরক্ষার স্বার্থে ‘প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে’ কাসেম সোলেমানিকে হত্যা করেছে।

“ইরানের ভবিষ্যত হামলা পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেওয়াই ছিল এই আক্রমণের উদ্দেশ্য। বিশ্বের যেখানেই আমাদের নাগরিক ও সম্পদ রয়েছে, তা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থাই যুক্তরাষ্ট্র নেবে।”

ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ আইনসিদ্ধ?

যুক্তরাষ্ট্র যুক্তি দিতে চাইছে, ইরাক সরকারের অনুরোধেই মার্কিন সৈন্যরা সেখানে দায়িত্ব পালন করছে। আর বিনা উসকানিতে সেখানে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলায় মদদ দিয়ে আসছিলেন সোলেমানি। 

বিবিসির সাংবাদিক এয়ামন ডোনাগি বলছেন, পেন্টাগন যেহেতু সোলেমানিকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে আসছে, সেহেতু তাকে হত্যার বিষয়টিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একরকম আইনি ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে- সেটাই স্বাভাবিক। 

তবে বিচার বহির্ভূত হত্যা বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাগনেস ক্যালামার্ড এক টুইটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, এভাবে কাউকে হত্যার ঘটনা আন্তর্জাতিক আইনে বৈধতা পেতে পারে না। তার ভাষায়, সোলেমানি ও অন্যদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা পুরোপুরি বেআইনি।  

এ ঘটনায় সামগ্রিকভাবে জাতিসংঘের অবস্থান কী হবে তা বলা মুশকিল। বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে উঠলে ভেটো ক্ষমতার কারণে কোনো আলোচনাই এগোবে না।

জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যে উত্তেজনা তৈরি হল, তা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।

“এটা এমন এক মুহূর্ত, যখন নেতৃবৃন্দকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে আরেক যুদ্ধের ধাক্কা সামলানোর সামর্থ্য বিশ্বের নেই।”  

ইরান কী বলছে?

ইরানের প্রুতিক্রিয়া খুব স্পষ্ট। সোলেমানিকে হত্যার ঘটনাকে তারা সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে দেখছে। শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে এসেছে রক্তের বদলা নেওয়ার অঙ্গীকার।  

এই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের  সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনি বলেছেন, কাসেম সোলেমানিকে যারা হত্যা করেছে সেই ‘অপরাধীদের’ জন্য অপেক্ষা করছে ‘ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ’।

আর প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “ইরান এবং এ অঞ্চলের মুক্ত দেশগুলো সন্ত্রাসী আমেরিকার এই জঘন্য অপরাধের সমুচিত জবাব দেবে।”

ইরানের মিত্র রাশিয়াও বলেছে, সোলেমানি নিহত হওয়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যে  নতুন করে উত্তেজনা বাড়াবে

জেনারেল সোলেইমানির মৃত্যুতে তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে ইরান। কুদস ফোর্সের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে এ বাহিনীর উপপ্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইসমাইল গানির হাতে।

কী করতে পারে ইরান?

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা উত্তেজনা নতুন মাত্রা পাওয়ার পর সোলেমানি হত্যার বদলা নেওয়ার জন্য অনেক পথই খোলা আছে ইরানের সামনে। 

বিবিসির সাংবাদিক জেরেমি বোয়েন বলছেন, সমর কৌশলে সোলেমানির মস্তিষ্ক ছিল ক্ষুরধার। ফলে তাকে কখনো হত্যা করা হলে কী করতে হবে তেমন পরিকল্পনাও হয়ত তিনি করে রেখে গেছেন।

“ইরান যে এর জবাব দেবে, তা নিশ্চিত। সোলেমানি এতদিন ধরে দেশের বাইরে ইরানের যে প্রভাব তৈরি করেছেন, তা টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা তারা করবে।”

ইরানের সম্ভাব্য একটি লক্ষ্যস্থল হতে পারে সিরিয়ায় ছোট মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো। এসব ঘাঁটির কোনো কোনোটি ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিটের আওতার মধ্যেই অবস্থিত। আর যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য সরিয়ে নেওয়ায় এসব ঘাঁটির অবস্থা এখন অনেকটা দুর্বল।

সিরিয়া ছাড়াও উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশগুলো, বিশেষ করে বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব ইরানের হামলার লক্ষ্য হতে পারে। কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ ঘাঁটিও একই রকম ঝুঁকিতে থাকবে।

তবে বিশ্লেষকদের কারো কারো ধারণা, ইরান উপযুক্ত সময় ও স্থানের অপেক্ষা করতে পারে। আপাতত সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কন্টিনজেন্টগুলো ইরানি হামলার শিকার হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন স্বার্থ ও নাগরিকরা হুমকির মুখে পড়তে পারে। আর এই পরিস্থিতি চলতে পারে বছরের পর বছর ধরে। ইরান হয়ত এমন একটি বার্তা দিতে চাইবে যে মার্কিন নাগরিকরা কোথাও নিরাপদ নয়।

কেন ঝুঁকি নিলেন ট্রাম্প?

বিবিসি লিখেছে, সোলেমানি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নজরে ছিলেন বহু বছর ধরে। এমনকি প্রেসিডেন্ট  জর্জ বুশ ও বারাক ওবামাও তাকে হত্যার পরিকল্পনা নেড়েচেড়ে দেখে পিছিয়ে গেছেন। ফলে ট্রাম্প কেন এখন সেই পথে হাঁটলেন- সেই প্রশ্ন চলে আসছে সামনে। 

এমন একটি সময় তিনি বেছে নিয়েছেন যখন নিজের দেশের কংগ্রেসে তার অভিসংশনের প্রস্তাব পাস হয়েছে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এক বছরেরও কম সময় রয়েছে তার হাতে। আর সে কারণে বাগদাদের ঘটনার পেছনে ট্রাম্পের ‘রাজনৈতিক দূরভিসন্ধি’ দেখতে পাচ্ছে ডেমোক্র্যাটরা।

গার্ডিয়ানের সাংবাদিক জুলিয়ান বার্গার মনে করছেন, ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার ঘটনা বারাক ওবামার দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের প্রচারে বড় বিষয় হয়ে উঠেছিল। ট্রাম্পও হয়তো সেরকম কিছু চেয়েছেন।

বিবিসির সাংবাদিক মার্টিন গালাগের বলছেন, এই হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সম্ভাবনার পাশাপাশি পরিণতির কথাও ট্রাম্পকে ভাবতে হয়েছে।

সোলেমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিখুঁত ইন্টেলিজেন্স এবং অব্যর্থ হামালা চালানোর সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পেরেছেন ট্রাম্প। পাল্টা কিছু করার আগে এটাও ইরানকে ভাবতে হবে।  

আর নির্বাচনের বছরে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই মার্কিন নাগরিকদের প্রাণক্ষয় এড়াতে চাইবেন।

যুদ্ধ কী আসন্ন?

মার্কিন হামলায় ইরানি কমান্ডার নিহত হওয়ার পর অনেকেই ‍তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কার কথা বলতে শুরু করেছেন।

তবে বিবিসির সাংবাদিক লুইস আলকট এর সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন। 

তার ভাষায়, বিশ্বযুদ্ধের মত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে চীন বা রাশিয়ার মত শক্তিকেও এ জটিলতায় জড়াতে হবে। তবে আপাতত এ নাটকে তারা মুখ্য চরিত্র নয়। 

তবে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটবে, সে বিষয়ে আলকটেরও কোনো সন্দেহ নেই।  স্বাভাবিকভাবেই ইরান প্রতিশোধ নিতে চাইবে এবং তাতে ধারাবাহিকভাবে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ আসবে। আর তাতে করে দুই দেশ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধেও জড়িয়ে যেতে পারে।

ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কা বছরখানেক ধরেই চলছিল। উত্তেজনা প্রশমনে ভেতরে ভেতরে কাজও করছিল ফ্রান্স।

কিন্তু সোলেমানি ও মাহদি আল-মুহান্দিস নিহত হওয়ার পর যুদ্ধ এড়ানোর সেই চেষ্টা আর কাজ করবে বলে মনে করছেন না বিবিসির সাংবাদিক লিস ডুসেট।


Spread the love

Leave a Reply