যেদিন ট্রাম্প আর বাইডেন ডায়ালগ করবে, সেদিন আমিও করব: শেখ হাসিনা
ডেস্ক রিপোর্টঃ বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে বিরোধী দলগুলোর সাথে সংলাপের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ”যেদিন ট্রাম্প আর বাইডেন ডায়ালগ করবে, সেদিন আমিও ডায়ালগ করব।”
মঙ্গলবার বিকেলে বেলজিয়াম সফর নিয়ে গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
এর আগে সকালের দিকে নির্বাচন কমিশনের সাথে বৈঠক শেষে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের সব পক্ষকে শর্তহীন সংলাপে বসার অনুরোধ জানিয়েছেন।
গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে পিটার হাসের এমন বক্তব্য উল্লেখ করে একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “যারা খুন করছে তাদের সাথে ডায়লগ করতে বলে, ট্রাম্প সাহেবের সাথে কী বাইডেন ডায়লগ করছে? যেদিন ট্রাম্প সাহেব আর বাইডেন ডায়লগ করবে, সেদিন আমিও ডায়ালগ করবো।”
গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সহিংসতার ঘটনায় বিশেষ করে এক সদস্যকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় এই মার্কিন রাষ্ট্রদূতের চুপ থাকা নিয়েও প্রশ্ন তিনি প্রশ্ন করেন।
“তিনি পুলিশ হত্যার ব্যাপারে বিচার চাইলেন না কেন? খুনীদের সাথে আবার কিসের বৈঠক? কিসের আলোচনা? সে বসে ডিনার খাক, সে বসে ডায়লগ করুক।”
“এটা আমাদের দেশ, স্বাধীন সর্বভৌম দেশ, এ কথা মনে রাখা উচিত,” তিনি বলেন।
নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নির্বাচন হবে এবং সময় মতো হবে। কে চোখ রাঙালো কে চোখ বাঁকালো পরোয়া করি না।”
নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে
নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে একজন সাংবাদিক জানতে চান, সেই সরকারের আকার কেমন হতে পারে।
এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘’ইন্ডিয়া, অস্ট্রেলিয়া কানাডা বা ইংল্যান্ডে কেমন হয়? ওখানে যেভাবে হয়, (এখানেও) সেভাবেই হবে। শুধু আমাদের আরপিও অনুযায়ী যখনি ইলেকশনের ডেট ডিক্লেয়ার হবে এবং নমিনেশন সাবমিট হবে, তখন থেকে পতাকা বা সরকারি কোন সুযোগ-সুবিধা মন্ত্রীরা ব্যবহার করতে পারবেন না। তখন একজন প্রার্থী হিসাবেই তাদের ভোট চাইতে হবে।‘’
তিনি বলেন, ‘’২০১৮-তে সেভাবেই হয়েছে। ২০১৪-তে আমি কিছু মন্ত্রী অন্যান্য দল থেকে নিয়োগ করেছিলাম। ১৮-তে আর সেই পদ্ধতি করি নাই।‘’
অতীতে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় বিভিন্ন দলের নেতাদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল। তবে ২০১৮ সালে সরকারে তেমন বড় কোন পরিবর্তন আনা হয়নি। এবারো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘’ অন্যান্য দেশে যেভাবে হয়, এবারো সেইভাবে হবে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি যেহেতু অসুস্থ, তিনি বাইরে আছেন। তার সাথে যোগাযোগ আছে। শিডিউল ডিক্লেয়ারের পর যে সময়টা দেয়া হয় নমিনেশন সাবমিট করার। সেখান থেকে প্রত্যাহারের তারিখ, এরপর বাছাই করার সময় থাকে। এরপর প্রতীক বরাদ্দ হয়। এরপর থেকে নির্বাচনের প্রচারণার কাজ।‘’
‘’নির্বাচনের প্রচারণার সময় কোন মন্ত্রী কোন ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে না আর কোনরকম সরকারি সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে না। কিন্তু সরকার থেমে থাকবে না। সরকারি দৈনন্দিন যে কাজগুলো, রুটিন ওয়ার্ক যাকে বলে, সেগুলো তো করতে হবে। নইলে তো স্থবির হয়ে যাবে দেশ, চলবে না।‘’
‘’ইলেকশন যখন হবে, যখন এমপিরা নির্বাচিত হবে, শপথ নেবে- তাদের সময়কাল হিসাব হয় প্রথম পার্লামেন্ট যখন বসে, সেই সময় থেকে। সেইভাবেই সমস্ত কাজগুলো হবে,’’ তিনি বলেন।
শেখ হাসিনা পরিষ্কার করে দিয়েছেন, ‘’নির্বাচনকালীন সরকার কে হবে না হবে, সেদিকে আর আমরা যাচ্ছি না। যেভাবে চলার-অন্যান্য দেশ- আমি ইংল্যান্ডে আলাপ করেছি, অস্ট্রেলিয়া-কানাডা যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, সেভাবে যারা চলে, সেভাবেই করা হবে।‘’
‘’অর্থাৎ সেই সময় আমরা যারা থাকবো, আমরাই নির্বাচনকালীন সরকার হিসাবে রুটিন ওয়ার্ক, দায়িত্ব পালন, দৈনন্দিন কাজকর্ম, যাতে সরকার অচল হয়ে না যায়, সেটা আমরা করবো, সেভাবেই চলবে।‘’
নির্বাচনকালীন সরকারের আকার কেমন হতে পারে, একজন সাংবাদিক জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘’আকার -যখন যেরকম হবে, দেখা যাবে। আকার ছোট করলে যেটা সমস্যা হয়, ১৪তে দেখেছি, অনেক মন্ত্রণালয়ের কাজ আর হয় না। কাজগুলো বাধাগ্রস্ত হয়ে যায়। আমাদের উন্নয়নের ধারা যাতে অব্যাহত থাকে, আমাদের সেটাই প্রচেষ্টা। সরকারে আমাদের এত উন্নয়নের কাজ চলছে, কেউ এসে যেন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে। তাই যেমনভাবে আছে, চলমান থাকবে, রুটিন কাজ করবে। যে প্রার্থী হবে, সে সরকারি কোন সুযোগ পাবে না।‘’
কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি
গত ২৮শে অক্টোবর বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এভাবে বিএনপি নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে তিনি জানান।
তবে যারা এই সহিংসতা ও অগ্নি সংযোগের সাথে যুক্ত তাদের অবিলম্বে চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে এবং তাদেরকে যথাযথ শাস্তি দেয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
তিনি বলেন, “আমার তো মনে হয় যে হাত দিয়ে গাড়ি পোড়াবে , যে ধরা পড়বে, তার হাতটাও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া উচিত। তাহলেই তাদের শিক্ষা হবে। তাছাড়া শিক্ষা হবে না।.. যারা অগ্নি সন্ত্রাস করে যাচ্ছে তাদের সাজা যাতে যথাযথভাবে হয় সে ব্যবস্থা নিতেই হবে।”
এদিকে এসব সহিংসতার সাথে একই ব্যক্তির সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে কোন বিচারিক পরিকল্পনা আছে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী জানান, বাংলাদেশে মামলা নিষ্পত্তি সময় নিয়ে হওয়ার কারণে এসব সমস্যা হচ্ছে।
তিনি বলেন, “যারা পুনরায় এসে আগুন দিচ্ছে, অথচ আগেও তাদের আগুন দেয়ার রেকর্ড আছে। তাদের অনেকের বিচার হয়েছে। এখন জামিন পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ সাজা ভোগ করেছে বা কারও মামলা ঝুলে আছে।”
তবে এবারে সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত ছিল তাদের কিভাবে দ্রুত সাজা দিয়ে উচিত শিক্ষা দেয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা করার কথা জানান তিনি।
বিএনপিকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সন্ত্রাসীদের কিভাবে শিক্ষা দেয়া হবে, সেই শিক্ষাটা আমাদের দেয়া উচিত এবং সেটাই আমরা দেবো।
বিএনপি তাদের সহিংসতা বন্ধ করবে এমন আশা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “সহিংসতা বন্ধ না করলে এর পরিণতি তাদের ভোগ করতে হবে।”
“এবার এমনি এমনি যেতে দেবো না। এভাবে তারা নির্বাচন থামাতে পারবে না। তেরোতে পারেনি, আঠারোতে পারেনি, এবারও পারবে না।”
সেইসাথে যাদের বাস পুড়েছে তাদের সহযোগিতার আশ্বাসও দেন প্রধানমন্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলন শেষে সহিংসতার বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ সাংবাদিকদের দেখানো হয়।
জো বাইডেনের ‘উপদেষ্টা’ ও হাসান সারওয়ার্দী
এদিকে ২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় বিএনপি কার্যালয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা হিসাবে দাবি করা মিয়া আরেফি নামে এক ব্যক্তির বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক কৌতুহল দেখা দেয়।
পরে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস জানায়, মিয়া আরেফি নামে তাদের কোন প্রতিনিধি নেই এবং কোন মার্কিন প্রতিনিধি বিএনপি কার্যালয়ে যায়নি।
এরপর ওই ব্যক্তির দেয়া বক্তব্যের দায় নিতে অস্বীকার করে বিএনপি।
এই ঘটনা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নিজেদের ইমেজ বাড়াতে ভাড়াটে লোক নিয়ে এসেছে।
তিনি বলেন, “ একজন ভুয়া লোক তাদের অফিসে বসে তাদের পক্ষে সাফাই গেয়ে যায়। পরে ধরা পড়লে তাদের নেতারা বলে যে তারা জানে না।”
পরের দিন ওই ব্যক্তিকে ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে আটক করে পুলিশ। পরে জানা যায় তার প্রকৃত নাম জাহিদুল ইসলাম আরফি বেল্লাল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে থাকেন । মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসেন।
এ ব্যাপারে মার্কিনিদের ভূমিকা রাখার প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তাকে যখন ধরা হল ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল তখন তো আসল কথা বেরিয়ে এল যে সে ভাড়া খাটতে এসেছে। তিনি মার্কিন নাগরিক এটা তো মার্কিনিদের দেখতে হবে।
এদিকে বাংলাদেশের একজন উচ্চপদস্থ সাবেক সেনা কর্মকর্তা চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীর উপস্থিতিতে বিএনপি কার্যালয়ে বাইডেনের উপদেষ্টার ভুয়া পরিচয় দিয়ে বক্তব্য দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিকরা।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “তাকে ছাড়া হচ্ছে না, তাকে ছাড়া হবে না। আমি নির্দেশ দিয়েছি, তার খোঁজ করা হচ্ছে, তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, এ ধরণের প্রতারণা করলো কেন?”
প্রধানমন্ত্রীর এই সংবাদ সম্মেলন শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কথিত মিয়া আরেফির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে লে. জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দীকে গ্রেফতারের খবর প্রকাশ পায়।
মঙ্গলবার বিকালে তাকে সাভার থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিবি।
নিষেধাজ্ঞা
এদিকে গত বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত বা জড়িত বলে মনে করবো, এমন যেকোনো বাংলাদেশির ওপর প্রয়োজন অনুসারে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেবে যুক্তরাষ্ট্র।
এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “তারা কথায় কথায় আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তারা বলেছিল যারা নির্বাচন বানচাল করতে চাইবে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে।”
“আজ তো হাতেনাতে প্রমাণ, কারা সহিংসতা করেছে। তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে এখন সংলাপের অনুরোধ করে।”
এমন অবস্থায় মার্কিন নীতি নিয়েই নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
বেলজিয়াম সফরে চুক্তি স্বাক্ষর
ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইনের আমন্ত্রণে ২৪শে অক্টোবর গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে যোগ দিতে বেলজিয়াম সফরে যান প্রধানমন্ত্রী।
সফর শেষে গত শুক্রবার দেশে ফেরেন তিনি। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী ফোরামের সাইডলাইনে ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতাদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেন।
এই সফরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ও সামাজিক খাতে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে দেশের সামাজিক খাতে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও ইসির মধ্যে ৭০ মিলিয়ন ইউরো’র পাঁচটি ভিন্ন অনুদান চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
সেইসাথে বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মধ্যে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরোর ঋণ সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
ইসি ও ইউরোপীয় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর অনুদান চুক্তি এবং বাংলাদেশ সরকার ও ইসির মধ্যে ১২ মিলিয়ন ইউরোর আরেকটি অনুদান চুক্তি স্বাক্ষর হয়।