যে কারণে বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের খবর নেই ভারতের মিডিয়ায়
বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কোটা-সংস্কার নিয়ে যখন আন্দোলন করছে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী, এবং সেটাই হয়ে উঠেছে দেশটির প্রধান খবর, কিন্তু তখনো সে খবর সামান্যই গুরুত্ব পেয়েছে প্রতিবেশী ভারতের ভারতের গণমাধ্যমে।
ভারতের গণমাধ্যম বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, বাংলাদেশের সরকার ভারতের ‘বন্ধু-সরকার’। আর ভারতীয় গণমাধ্যমে সাধারণত দেশটির বিদেশ নীতির পরিপন্থী কিছু ছাপা হয় না।
তাই ‘বন্ধু-সরকার’এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের খবর গুরুত্ব পাবে না, এটাই স্বাভাবিক – এমনটাই মনে করছেন ওই বিশ্লেষকরা।
তবে ওই আন্দোলনে মঙ্গলবার ছয় জন মারা যাওয়ার যখন খবর এসেছে, সেটাকে গুরুত্ব দিয়েছে ভারতের প্রায় সব খবরের কাগজই।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছয় জন মারা যাওয়ার পরে বুধবার কলকাতার সংবাদপত্রগুলি বড় করে খবরটি ছেপেছে ঠিকই, তবে বেশিরভাগ কাগজেই তা আছে ভেতরের পাতায়।
এর আগে চলমান আন্দোলনটি নিয়ে দু-একবার ভেতরের পাতায় খবর ছাপা হয়েছিল।
অন্যদিকে, বাংলা টিভি চ্যানেলগুলিতে সেরকম কোনও গুরুত্বই পাচ্ছে না বাংলাদেশের এই আন্দোলনের খবর।
যদিও বেশ কয়েকটি বাংলা সংবাদ পোর্টাল কোটা সংস্কার আন্দোলনের খবর দিচ্ছে। বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণের খবরও করা হয়েছে।
এদিকে দিল্লি ভিত্তিক কয়েকটি জাতীয় দৈনিকও বুধবারই প্রথম কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছয় জনের মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছে। এর আগে এই আন্দোলনের খবর প্রায় ছাপাই হয় নি।
গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা কোটার ব্যবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা হলেও, ভারতেও সংরক্ষণের নীতি আছে।
বুধবারই দুটি রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর জন্য সংরক্ষণ বা কোটা ঘোষণা করেছে। আবার সংরক্ষণ এমন একটা বিষয়, যা আশির দশকের শেষ দিক থেকে ভারতের রাজনীতি তো বদলে দিয়েইছে, এমনকি বিষয়টি এখনও অতি-গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু।
অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন যে, সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন কমে যাওয়ার পিছনেও ছিল তপশীলি জাতি-উপজাতিদের জন্য সংরক্ষণ বা কোটা তুলে দেওয়া হতে পারে, এরকম একটি আশঙ্কা।
তাই ভিন্ন ধরণের হলেও পড়শি দেশে কোটা নিয়ে এত ব্যাপক আন্দোলনের খবর ভারতে গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল।
কেন গুরুত্ব দিল না ভারতের মিডিয়া?
দিল্লি ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো দেখলেই স্পষ্ট হয়, শুধু যে কোটা-সংস্কার আন্দোলনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেনি ভারতের জাতীয় গণমাধ্যম, তা নয়। এমনিতেই বাংলাদেশ সংক্রান্ত খবরাখবরকে সেরকম একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না সেখানকার জাতীয় গণমাধ্যমে।
এর ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন বা সেদেশ থেকে অনুপ্রবেশ, তিস্তার জল বণ্টনের মতো ইস্যু অবশ্যই গুরুত্ব পায়।
তবে এর বাইরে দিল্লিকেন্দ্রিক গণমাধ্যমগুলি বাংলাদেশের খবরাখবরকে তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে না।
কিন্তু কেন বুধবারের আগে ভারতীয় গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেল না বাংলাদেশের কোটা-সংস্কার আন্দোলন?
গণমাধ্যম বিশ্লেষক ও পুণের এমআইটি এডিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সম্বিত পালও বলছিলেন, বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বুধবারের আগে সেরকম খবর প্রকাশিত হয়নি।
তিনি বলেন, “এখানকার সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের এই সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়ে মূলত চুপ থেকেছে, তার কারণটা রাজনৈতিক। ভারতের বর্তমান শাসকদলের যে নীতি, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ খবরই করে থাকে এখানকার মূল ধারার সংবাদমাধ্যম, এটা আমরা গত ১০ বছর ধরে দেখছি।
বাংলাদেশের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী সরকারের যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, তার বাইরে গিয়ে খবর করতে দেখা যায় না,” বলছিলেন মি. পাল।
তার কথায়, “শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সেভাবে কোনও খবর আপনি ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাবেন না। সেটা বাংলাদেশের নির্বাচনের সময়েও দেখেছি।
অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যেসব সমালোচনা দেখা গেছে সেদেশে ভোটের সময়ে, সেসব সচরাচর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে কিন্তু আমরা দেখতে পাই নি।
“এখন শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন হচ্ছে, সেটা নিয়ে খবর করা মানে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিরুদ্ধেই খবর করা। তবে যখন হতাহতের খবর পাওয়া গেছে, সেটাকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম আর এড়িয়ে যেতে পারে নি,” জানাচ্ছিলেন অধ্যাপক সম্বিত পাল।
আরেকটি যে কারণে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের কোটা আন্দোলনের খবর এড়িয়ে গেছে, সেটা সংবাদপত্রগুলির দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সম্পর্কিত।
অধ্যাপক পাল বলছিলেন, শুধু যে বাংলাদেশের খবরাখবরকে সেরকম গুরুত্ব দেয় না ভারতের মিডিয়া তা নয়, নেপাল বা শ্রীলঙ্কার খবরকেও সেভাবে মূল ধারার গণমাধ্যমে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
তার কথায়, “আন্তর্জাতিক খবরকে এখানে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না খুব বড় কোনও ঘটনা না ঘটলে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বিদেশ সফর করেন, সেই খবর খুবই গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলি।
বাংলাভাষী টিভিতেও আন্দোলনের খবর নেই
শুধু যে খবরের কাগজে কোটা সংস্কার আন্দোলনের খবরকে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি তা নয়।
কলকাতার বাংলা টেলিভিশনগুলিতেও সেই খবর একপ্রকার আসেই নি।
জনপ্রিয় একটি টিভি চ্যানেলের যে পোর্টাল আছে, সেখানে এ সংক্রান্ত একটি মাত্র খবর দেখা গেছে। আরেকটি জনপ্রিয় চ্যানেলের পোর্টালে দেখা যাচ্ছে যে তারা মঙ্গলবার ছয় জন নিহত হওয়ার খবরটি দিয়ে প্রথমবার বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে খবরটি করেছে।
ওই একই চ্যানেলের পোর্টালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গত রবিবারের সংবাদ সম্মেলন নিয়ে একটি খবর দেখা যাচ্ছে।
সেখানেই তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন এবং যার পরেই আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল, অথচ ওই টিভি চ্যানেলের পোর্টালে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর এক পিওনের চারশো কোটি টাকার মালিক হওয়ার বিষয়টি রয়েছে।
সংবাদ পোর্টাল ‘দ্য ওয়াল’-এর কার্যনির্বাহী সম্পাদক অমল সরকার বলছিলেন বাংলা টিভি চ্যানেলগুলি বাংলাদেশের এত ব্যাপক একটা আন্দোলন নিয়ে খবর না করাটা খুব একটা আশ্চর্যজনক কিছু না।
“এখানকার টিভি চ্যানেলগুলি তাদের দর্শকদের কূপমণ্ডূক করে রাখে একরকম। সারাদিনই তারা নানা ধরণের রাজনৈতিক তরজা দেখাতে থাকে। হাইপার লোকাল, অর্থাৎ ভীষণভাবে স্থানীয় খবর দেখিয়ে রেটিং পয়েন্ট বাড়ানোর চেষ্টা করে। বাংলাদেশের আন্দোলন তো ছেড়ে দিন, ইউক্রেন যুদ্ধ বা গাজা পরিস্থিতি – এসব নিয়ে কটা খবর দেখেন আপনি বাংলা টিভিতে?” প্রশ্ন মি. সরকারের।
তিনি এও বলছিলেন যে বাংলাদেশে যে ইস্যুতে আন্দোলন হচ্ছে, সেই একই বিষয়টা ভারতের রাজনীতিটাই বদলিয়ে দিয়েছে।
তার কথায়, “ভারতের রাজনীতিতে বড় বদল এসেছে গত ৩০-৩৫ বছরে: একটি হচ্ছে সংরক্ষণের ব্যাপারে যে মণ্ডল কমিশন রিপোর্ট বেরিয়েছিল আশির দশকের শেষ দিকে, অন্যটা হচ্ছে অযোধ্যার রাম মন্দির ইস্যু।
বিজেপির রামমন্দির ইস্যুকে রুখতেই তো প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে এনেছিলেন। সেই সময়ে তো অনেক ছাত্র-যুবক আন্দোলন করতে গিয়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে মারাও গিয়েছিলেন।
তাই বাংলাদেশের ইস্যুটির গুরুত্ব কিন্তু ভারতের রাজনীতিতেও যথেষ্ট। অথচ এটা দেখানোই হচ্ছে না।“