২০২৩ সালে ইইউ ভুক্ত বিভিন্ন দেশে ৪০ হাজার ৩৩২জন বাংলাদেশি নাগরিকের আশ্রয় দাবি
ডেস্ক রিপোর্টঃ প্রতি বছরই ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা-সহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন অনেক বাংলাদেশি নাগরিক। তবে ২০২৩ সালে ইউরোপে এমন আবেদনের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে এযাবত কালের সর্বোচ্চ সংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে ২০২৩ সালে।
গত বছর ইউরোপিয় ইউনিয়ন (ইইউ)-ভুক্ত বিভিন্ন দেশে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছেন ৪০ হাজার ৩৩২জন। এর মধ্যে অনুমতি মিলেছে দুই হাজার জনের।
এর অর্ধেকেরও বেশি আবেদন পড়েছে ইতালিতে। ৫৮ শতাংশ বাংলাদেশি সেখানে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। এর পরেই রয়েছে ফ্রান্স। ওই দেশটিতে অনুমতি চেয়েছেন ২৫ শতাংশ।
ইইউ-র রাজনৈতিক আশ্রয় বিষয়ক সংস্থা ইইউএএ ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রবণতা সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য প্রকাশ করে।
যাতে দেখা যায়, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ সিরিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ আবেদন করেছেন। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে আফগানিস্তান। বিগত বছরের নিরিখে দেশ দুটির অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান এগিয়েছে এক ধাপ। ২০২২ সালে তুলনায় আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার বেড়ে যাওয়ায় ষষ্ঠ অবস্থানে উঠে এসেছে দেশটি।
সিরিয়া-আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে যুদ্ধ-সংঘাত বিপুল সংখ্যায় আশ্রয় প্রার্থনার একটা বড় কারণ।
পৌনে দুই লাখের বেশি সিরিয়ান শরণার্থী ইউরোপে আশ্রয় চেয়েছেন। বেশির ভাগের আবেদনই মঞ্জুর হয়েছে।
আর আফগানদের তরফে আবেদন পড়েছে এক লাখ ১৪ হাজার। ৬০ শতাংশের বেশি গৃহীত হয়েছে।
কিন্ত, তালিকার ওপরের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান কেন? কেনই বা বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন ক্রমশ বাড়ছে?
রেকর্ড সংখ্যক আবেদনের সম্ভাব্য কারণ
ইইউএএ-র পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৪ সালে নয় হাজার ২৯০ জন বাংলাদেশি নতুন করে ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন করেন। ওই বছর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল আগের ১৩ হাজারেরও বেশি নথি।
পরবর্তী কয়েক বছর ওঠানামার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আবেদনের সংখ্যা।
২০২১ সালে প্রথম বারের মত নথিভুক্ত হওয়া আবেদনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৮৩৫ এ। ২০২২ সালে এ সংখ্যা প্রায় ১৩ হাজার বেড়ে ৩১ হাজার ৯৬৫ হয়।
গত বছর আবেদন করা ৪০ হাজারের মধ্যে নতুন আবেদনকারী ৩৮ হাজারের ওপর।
অভিবাসন সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট বা ‘রামরু’-র চেয়ারম্যান অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী এর কারণ হিসেবে দুটো বিষয়কে উল্লেখ করছেন।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “বৈধভাবে অভিবাসনের সুযোগ সীমিত হলেও কিন্তু সে সব দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। ফলে, অবৈধ পথে হলেও অনেকেই যেতে চান।”
এর পাশাপাশি তিনি আরও বলছেন, “গত বছর যেহেতু নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের অভ্যন্তরে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল, বিরোধী মনোভাবের যারা মনে করেছেন তাদের ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স বা জেলে যাওয়ার ভয় আছে তাদেরও একটা অংশ হয়তো ইউরোপে পাড়ি দিয়ে আশ্রয় চেয়েছেন।”
গন্তব্য দেশগুলোর ভিসা পলিসির জটিলতার কথাও উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
“কৃষিকাজ, যেমন ‘চেরি পিকিং’য়ের জন্য এক বছরের ভিসা দেওয়া হচ্ছে। এই কাজ পাওয়ার জন্য অনেকে যাচ্ছেন। কিন্তু, অনেক খরচ করে গিয়ে এক বছরে সেটা তুলে আনা কঠিন হয়ে যায়। যে কারণে অবৈধ অভিবাসন উৎসাহিত হচ্ছে।”
ইতালিতে বসবাসরত সাংবাদিক জাকির হোসেন সুমন বিবিসি বাংলাকে জানান, “এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে প্রচুর। কোভিডে অনেক লোক মারা গেছে। শ্রমিকের অভাব রয়েছে। সেজন্য ইতালি সরকার ঘোষণা দিয়েও বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের আনছে।”
ইতালিকে কেন বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশিরা?
আশ্রয় হিসেবে ইতালিকেই বেছে নিতে চাইছেন অধিকাংশ বাংলাদেশি আবেদনকারী। মোট আবেদনের ৫৮ শতাংশ হিসাব করলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৩৯৩ জন।
ফ্রান্সেও দশ হাজারের বেশি আর্জি লিপিবদ্ধ হয়। বাংলাদেশিদের তৃতীয় সর্বোচ্চ আবেদন জমা পড়ে রোমানিয়ায়।
গত বছর সেখানকার আশ্রয়প্রার্থীদের সিংহভাগই ছিলেন বাংলাদেশি নাগরিক।
এত বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশির ইতালিতে আশ্রয় প্রার্থনার পেছনে তাদের ইউরোপে যাওয়ার রুট অন্যতম কারণ বলে মনে করেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, “তাদের যাওয়ার পথটা দেখতে হবে। অবৈধভাবে যারা যাচ্ছেন তারা নানা দেশ ঘুরে তিউনিসিয়া বা লিবিয়া পৌঁছান।”
লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি মানব পাচারের অন্যতম আলোচিত রুট।
“ফলে এই বাংলাদেশিরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে প্রথমে ইতালিতে গিয়ে ওঠেন,” যোগ করেন মিজ সিদ্দিকী।
ইতালিতে দিনে দিনে বাংলাদেশিদের বড় কমিউনিটিও গড়ে উঠেছে।
তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, “ইতালিতে একটা নেটওয়ার্ক আছে বাংলাদেশিদের। সাধারণত আইন বহির্ভূত পথে নেটওয়ার্ক ধরেই চেইন মাইগ্রেশন হয়। অনেকের আত্মীয়-স্বজনও আছেন। যে কারণে আবেদনের বৃহৎ অংশ ওই দেশটিতে নিবন্ধিত হতে দেখা যায়।”
“তবে, সবাই যে ইতালিতে থিতু হন তা নয়, বরং অনেকেই সেখান থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে মাইগ্রেট করেন,” বলেন তিনি।
দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে কয়েকগুণ বেড়েছে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসীদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার পরিমাণ।
২০১৯ সালে দুই হাজার ৯৫১ জন আবেদন করেছিলেন। যদিও তার আগের বছর সংখ্যাটা ছিল পাঁচ হাজার ২৬।
২০১৭ সালে ১২ হাজার ৭৩১ জন এবং ২০১৪ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন ৪ হাজার ৫১৭ জন।
জাকির হোসেন সুমন বিবিসি বাংলাকে জানান, রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি এখন দারিদ্রকেও কারণ হিসেবে দেখাচ্ছেন কেউ কেউ।
“দেশে থাকা পরিবারের দারিদ্র দূর করার জন্য আসছে এমন কারণ দেখিয়ে আবেদন করছেন। কয়েকজনকে জানি যারা এভাবে প্রাথমিক অনুমতি পত্র পেয়েছেন যার মেয়াদ ছয় মাস”।
লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা
লিবিয়ার সর্ব পশ্চিমের উপকূল থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের দূরত্ব সমুদ্রপথে প্রায় ৩০০ মাইল।
একটি আধুনিক নৌযানে এই পথ পাড়ি দেয়া কোনও মুশকিল নয়। কিন্তু পাচারকারীরা গাদাগাদি করে ছোট নৌকা, কখনও কখনও এমন কী বাতাস দিয়ে ফোলানো ডিঙিতে করে অভিবাসীদের বেশ কিছুটা পথ নিয়ে যান।
আর সেজন্য দুর্ঘটনাও ঘটে অনেক।
২০১৯ সালে ইতালি যেতে গিয়ে সাগরে ডুবে বহু বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা খবরের শিরোনাম হয়।
তিউনিসিয়া রেড ক্রিসেন্টের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থাগুলো জানায়, বৃহস্পতিবার ভূমধ্যসাগরে এক নৌকাডুবিতে নিহত প্রায় ৬০ জন অভিবাসীর অধিকাংশই ছিল বাংলাদেশি নাগরিক।
রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা মঙ্গি স্লিমকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, রাবারের তৈরি ‘ইনফ্লেটেবেল’ নৌকাটি ১০ মিনিটের মধ্যে ডুবে যায়।
উদ্ধার হওয়া ১৬ জনের ১৪ জনই ছিলেন বাংলাদেশি।
বেঁচে ফেরা অভিবাসীদের ভাষ্যমতে, নৌকাটিতে ৫১জন বাংলাদেশি ছাড়াও তিনজন মিশরীয় এবং মরক্কো, শ্যাড এবং আফ্রিকার অন্যান্য কয়েকটি দেশের নাগরিক ছিল।
আইওএমের ২০১৭ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি ঢোকার চেষ্টা করেছে যে সব দেশের নাগরিকেরা, বাংলাদেশিরা রয়েছেন সে রকম প্রথম পাঁচটি দেশের তালিকায়।
জাতিসংঘের এই সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আট বছরে এশিয়ায় প্রায় পাঁচ হাজার অভিবাসীর হয় মৃত্যু হয়েছে নয়তো তারা নিখোঁজ হয়ে গেছে।
নিহতদের বেশির ভাগই রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশি শরণার্থী।
বাংলাদেশ থেকে অভিবাসীরা সমুদ্র পথে বঙ্গোপসাগর এবং আন্দামান সাগর পার হবার চেষ্টা করে। বিপজ্জনক হলেও এই সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে তারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছতে চেষ্টা করে।
তবে, ঝুঁকি এড়াতে বিকল্প পথে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ছে।
সাংবাদিক সুমন বলেন, রুট হিসেবে লিবিয়ার পরিবর্তে এখন রোমানিয়া এবং গ্রিসকেও ব্যবহার করছেন অনেকে।