রাজা তৃতীয় চার্লসের পথ-চলা কেমন হবে
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ ব্রিটিশ ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে থাকার পর রাজা হয়েছেন তৃতীয় চার্লস। সত্তর বছর ধরে তিনি এজন্য নিজেকে সবচেয়ে ভালো ভাবে প্রস্তুত করার সুযোগ পেয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি হচ্ছেন ব্রিটিশ সিংহাসনে অভিষেক হওয়ায় সবচেয়ে বয়সী রাজা।
এখন ৭৩ বছর বয়সী রাজা তৃতীয় চার্লস তার মায়ের রাজত্বের দীর্ঘ সময়কাল দেখেছেন, একের পর এক বিশ্ব নেতাদের পরিবর্তন চাক্ষুষ করেছেন – যাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী আর ১৪ জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অসাধারণ, যুগান্তকারী রাজত্বের পর কেমন ধরনের রাজা আশা করা হচ্ছে? যে রাজপুত্র বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন, তিনি কীভাবে একজন রাজার নিরপেক্ষতা ভূমিকার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবেন?
রাজা হিসাবে চার্লসের এখন আর নিজস্ব পাসপোর্ট বা ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকবে না-অথবা প্রকাশ্যে কোন ব্যাপারে তিনি জোরালো মতামত দিতে পারবেন না।
রাজা হওয়ার মানে হলো তিনি এখন যেকোনো ব্যক্তির তুলনায় আলাদা।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ভার্নন বোগদানর মনে করেন, এটা পুরো আলাদা ধরনের দায়িত্ব, ভিন্ন নিয়মকানুনের বিষয়।
তিনি বলছেন, ”একেবারে শুরু থেকেই তিনি জানেন যে, তার ধরন-ধারণে পরিবর্তন আনতে হবে। জনগণ এমন কোন রাজাকে চাইবে না, যিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রচারণা চালাবেন।”
রাজা তৃতীয় চার্লস নিশ্চয়ই এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন যে, তাকে আগের তুলনায় অনেক কম কথা বলতে হবে।
”আমি বোকা নই। আমি বুঝতে পারি যে, রাজা হওয়ার মানে হলো সেখানে অনেক কিছুই আলাদাভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে,” ২০১৮ সালে বিবিসিকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন। ”আমি আগের মতো তখনো একই রকম থাকবো, সেটা ভাবা একেবারে অর্থহীন।”
যখন একজন নতুন রাজা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন, তখন মুদ্রার ওপরে আগের রাজা বা রানির মুখ যেদিকে থাকে, নতুন রাজার মুখ অন্যদিকে দেয়া হয়। চার্লসের রাজত্বেও তেমনি আলাদা কিছু বিষয়ও গুরুত্ব পাবে।
চার্লস যে দেশে এখন রাজত্ব করবেন, সেটি তার মায়ের রাজত্বকালের তুলনায় অনেক বেশি বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। অধ্যাপক ভার্নন বোগদানর মনে করেন, নতুন রাজা বহু সংস্কৃতির, বহু বিশ্বাসের ব্রিটেনের মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবেন বলে তিনি মনে করেন।
তিনি আশা করেন যে, নতুন রাজা একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসাবে কাজ করার চেষ্টা করবেন, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীগুলির সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য আরও দৃশ্যমান উদ্যোগ নেবেন।
অধ্যাপক বোগদানর ধারণা করেন, শিল্প, সংগীত এবং সংস্কৃতিতে পৃষ্ঠপোষকতা আরও বাড়িয়ে দেবেন নতুন রাজা।
রাজা চার্লসের জন্য প্রিন্স চার্লস চ্যারিটিতে বহু বছর কাজ করেছেন স্যার লয়োড ডর্ফম্যান। তিনি মনে করেন না, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক খাবারের মতো যেসব বিষয় নিয়ে চার্লস কাজ করেছেন, সেসব বিষয় থেকে তিনি একেবারে দূরে সরে যাবেন।
স্যার লয়োড বলছেন, ”তিনি খুবই জ্ঞানী এবং সক্রিয় একজন ব্যক্তি। যেদিন তিনি রাজা হবেন, সেদিন তিনি একেবারে কিছু বাদ দিয়ে দেবেন, এটা চিন্তা করা কঠিন।”
অনেকদিন ধরেই আলোচনা চলছে যে, রাজা ছোট আকারের রাজতন্ত্র পছন্দ করেন। এটির মানে সম্ভবত হতে পারে যে, রাজকার্য পরিচালনায় রাজপরিবারের কেন্দ্রে থাকা সদস্যদের নিয়ে একটি ছোট গ্রুপের ওপর বেশি জোর দেয়া হতে পারে, যাদের মধ্যে রয়েছেন চার্লস এবং ক্যামিলা, প্রিন্স উইলিয়াম এবং ক্যাথরিনের মতো সদস্যরা।
তবে ব্রিটিশ রাজপরিবার পর্যবেক্ষক ভিক্টোরিয়া মারফি মনে করেন, এসব সত্ত্বেও নতুন রাজত্বের প্রধান বার্তাটি হবে ধারাবাহিকতা আর স্থিতিশীলতা রক্ষা করা।
”কোন বিশাল, বৈপ্লবিক পরিবর্তন আশা না করাই ভালো। তিনি খুব সতর্ক থাকবেন,” তিনি বলছেন।
রাজপরিবার ভাষ্যকার এবং লেখক রবার্ট হার্ডম্যান বলছেন,”আমরা রানিকে আমাদের জাতীয় জীবনে একটি চিরন্তন অংশ হিসাবে ভাবতে শুরু করেছিলাম । কিন্তু তার বাইরে তিনি (রাজা চার্লস) জনজীবনে যে কোনও রাজনৈতিকের চেয়ে বেশি সময় ধরে আছেন।”
ইতিহাসবিদ এবং লেখক স্যার অ্যান্থনি সেলডন বিশ্বাস করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়গুলোতে সতর্কবার্তা সঠিক প্রমাণিত হওয়ায় রাজা চার্লস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন।”
গ্লাসগোয় ২০২১ সালে জলবায়ু সম্মেলনে চার্লসকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো নেতারা, যিনি সেই সময় বলেছিলেন যে, বিশ্ব দরবারে তার মর্যাদা একজন রাজার মতোই।
মি. হার্ডম্যান বলেছেন, ”এটা শুধুমাত্র দেখানো ব্যাপার ছিল না। তারা দুজন এক কোণে বসেছিলেন এবং বাইডেন বলেছিলেন, আপনি এইসব করতে পেরেছেন।”
নতুন রাজা হিসাবে আমরা কেমন ব্যক্তিত্ব দেখতে পাবো?
যারা নতুন রাজা চার্লসকে কাছে থেকে চেনেন, তারা বলেন, আসলে তিনি লাজুক, রাশভারী ব্যক্তিত্বের মানুষ। অন্যভাবে বললে, তিনি সংবেদনশীল আত্মার অধিকারী একজন মানুষ।
অতীতে এক একাকী ছেলের বর্ণনা পাওয়া যায় যে, স্কুলে পড়ার সময় সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এবং উৎপীড়নের শিকার হওয়ার অভিযোগ করেছিল।
”তারা আমার দিকে সারারাত ধরে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারে অথবা বালিশ দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে, রুম জুড়ে ছুটে এসে আমাকে যতটা সম্ভব জোড়ে আঘাত করে,” বাড়িতে পাঠানো একটি চিঠিতে তিনি স্কুলের ছাত্রাবাসে যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন।
তার স্ত্রী ক্যামিলা, এখন কুইন কনসর্ট, তার বিষয়ে বর্ণনা করেন এভাবে: ”বেশ অধৈর্য। তিনি চান, গতকালের মধ্যে কাজগুলো সম্পন্ন হয়ে যায়, এভাবেই তিনি সব কিছু সম্পন্ন করেন।”
চার্লসের ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, মানুষ জনসমক্ষে তাকে যেভাবে দেখে, পেছনে তার অনেক মজার দিক রয়েছে।
”তাকে সবাই একজন রাশভারী চরিত্রের মানুষ হিসাবে দেখে থাকে, তিনি আসলেও তাই। কিন্তু আমি চাই, মানুষ তার হালকা দিকটাও দেখুক। তিনি হাঁটু গেড়ে বাচ্চাদের সাথে খেলা করেন, তাদের হ্যারি পটার পড়ে শোনান এবং কণ্ঠ দেন,” বলেছেন ক্যামিলা।
চার্লস যখন জনসাধারণের সাথে দেখা করেন, তখন তিনি স্বাচ্ছন্দ্য এবং সহজগম্য ব্যক্তিতে পরিণত হন, শ্রোতাদের সঙ্গে তিনি হালকা ধরনের কিছু রসিকতাও করেন। কিন্তু রাজা হিসাবে হয়তো সেটা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। কিন্তু প্রিন্স অফ ওয়েলস হিসাবে কোনরকম অস্থিরতা ছাড়াই তিনি স্নেহপূর্ণ, পিতামহের মতো একটি আবহ তৈরি করেছিলেন।
সত্তর বছর বয়সের একজন ব্যক্তি হলেও, স্তিমিত হয়ে যাওয়ার মতো কোন লক্ষণ দেখাননি নতুন রাজা।
চার্লসের সঙ্গে প্রিন্স টিচিং ইন্সটিটিউটে কাজ করেছেন ক্রিস পোপ। নতুন রাজা প্রসঙ্গে তিনি বর্ণনা করেন এভাবে, একজন নিরলস ব্যস্ত, পরিশ্রমী ব্যক্তি শক্তিতে ভরপুর ব্যক্তি যিনি বিশাল সব কাজের ভার কাঁধে তুলে নিচ্ছেন।
”পরবর্তী প্রজন্মের ভালোমন্দের ব্যাপারে তিনি সত্যিকারের একজন উৎসাহী ব্যক্তি। তাঁর অনেক কাজের মধ্যে আপনি এটার প্রতিফলন পাবেন,” তিনি বলছেন।
প্রিন্স হিসাবে তিনি যেসব দাতব্য কাজ করেছিলেন, তার মধ্যে ছিল ঐতিহ্য রক্ষা করা এবং ঐতিহ্যবাহী দক্ষতাগুলো ধরে রাখা- কিন্তু সেই সঙ্গে একই সময়ে তিনি উদ্ভাবন ও পরিবর্তনকেও উৎসাহিত করেছেন।
”তিনি সবসময়েই চেয়েছেন যেন ঐতিহ্য হারিয়ে না যায়, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমাদের পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করতে হবে,” বলেছেন মি. পোপ।
নতুন রাজার চরিত্রে এমন অনেকগুলো বিষয় একত্রিত হয়েছে, যা একই সঙ্গে সংরক্ষণের পাশাপাশি নানা দিকে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
অনেক সময় তাকে লাল গালওয়ালা একজন জমিদারের মতো দেখাতে পারে, যিনি আঠারো শতকের কোন চিত্রকর্ম থেকে যেন বেরিয়ে এসেছেন। অন্য সময়ে তাকে একজন হতাশ সংস্কারকের মতো মনে হতে পারে, কীভাবে কিছু সম্প্রদায়কে অবহেলিত আর অনুন্নত করে রাখা হয়েছে, এবং তাতে খুব বিরক্ত।
মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি হয়তো দায়িত্ববোধ পেয়েছেন, কিন্তু রাজা চার্লস সেই সঙ্গে তার কাছ থেকে ধর্মীয় বিশ্বাস আর শক্তিশালী রসিকতাবোধও পেয়েছেন।
ব্রিটিশ এশিয়ান ট্রাস্ট গঠনে ২০০৭ সালে সহায়তা করার পর থেকেই তার সঙ্গে কাজ করেছেন হিতান মেহতা।
তিনি বলেন, ‘”তিনি মনের দিক থেকে একজন মানবতাবাদী। আমি মনে করি, তিনি মানুষকে নিয়ে যতটা ভাবেন, তাকে সেভাবে মানুষ মূল্যায়ন করতে পারেনি। তিনি তাঁর নাতি-নাতনিদের জন্য কী ধরনের পৃথিবী রেখে যাচ্ছেন, প্রায়ই সেটা নিয়ে কথা বলেন, তিনি এসব নিয়ে চিন্তা করেন।”
এর মানে হলো, তিনি সরাসরি পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আহ্বান জানাতে পারেন।
”হয়তো শুক্রবার রাত নয়টা বাজে, তখন আমি তার কাছ থেকে একটা টেলিফোন পেলাম। তিনি বলছেন, আমি এইমাত্র শুনলাম যে, পাকিস্তানে বন্যা হয়েছে। আমরা তাদের জন্য কী করছি? এটা এমন নয় যে, তার ব্যস্ততা নেই। কিন্তু তিনি সব সমস্যার কথা শোনেন এবং সেটা নিয়ে কাজ করেন। তিনি আসলেই ভালোমন্দ নিয়ে ভাবেন,” বলছেন মি. মেহতা।
নিজের পিতা প্রসঙ্গে প্রিন্স হ্যারি বলেছিলেন, ”তিনি হচ্ছেন এমন একজন মানুষ, যিনি হাস্যকরভাবে গভীর রাতে খাবার খান, এবং তারপরে নিজের ডেস্কে যান আর কাগজপত্রের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েন।”
বাকিংহ্যাম প্যালেসে ১৯৪৮ সালের ১৪ই নভেম্বর জন্ম হয়েছিল চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জের। যখন বিবিসি তার জন্মের কথা ঘোষণা করে, সেখানে বলা হয়নি যে, রানি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সেই ঘোষণা বলা হয়েছিল, রানি ‘নিরাপদে একজন রাজপুত্রের’ জন্ম দিয়েছেন। চার বছর পর তিনি ব্রিটিশ সিংহাসনের স্পষ্ট উত্তরাধিকারী হন।
”জন্মের পর থেকেই আমি দেখতে পেয়েছি যে, আমি এই একটি অবস্থানে রয়েছি। আমি এটির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। (মানুষকে) সহায়তা করার জন্য যা আমি করতে পারি, সেটা করবো,” ২০০৫ সালে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন চার্লস।
চারশোর বেশি সংস্থার তিনি প্রেসিডেন্ট অথবা পৃষ্ঠপোষক হিসাবে রয়েছেন। রাজকীয় নৌবাহিনী অবসর নেয়া বাবদ পাওয়া অর্থ দিয়ে ১৯৭৬ সালে তিনি দ্যা প্রিন্স’স ট্রাস্ট নামে নিজস্ব দাতব্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন।
সেই প্রতিষ্ঠান বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর প্রায় নয় লাখ অনগ্রসর তরুণকে নানাভাবে সহায়তা করেছে। এসব কর্মকাণ্ড সামাজিক নানা সমস্যা সম্পর্কে তাকে গভীর ধারণা দিয়েছে।
প্রিন্স’স ট্রাস্ট নিয়ে, তাঁর ভাষায় ‘সমাজের যাদের কাছে পৌঁছানো সবচেয়ে কঠিন’ তাদের সাথে তিনি সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সবসময় সেই পরিকল্পনা ভালোভাবে এগোয়নি।
”স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করেছিল, এটা ভালো পরিকল্পনা হচ্ছে না। ফলে এটা বাস্তবায়ন করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল,” বিবিসিকে দেয়া ২০১০৮ সালের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন।
তার কাজ নিয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছিল, বিশেষত তথাকথিত ‘ব্ল্যাক স্পাইডার মেমোস’ নিয়ে। ২০০৪ সাল থেকে ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রীদের কাছে কিছু ব্যক্তিগত চিঠি পাঠিয়েছিলেন চার্লস। সেখানে কৃষি খামার, নগর পরিকল্পনা, স্থাপত্য, শিক্ষাসহ নানা বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
চার্লসের দিক থেকে তদবির পেয়েছিলেন, এমন সাবেক একজন মন্ত্রী বলেছেন, তাকে অনেক চাপ দেয়া হয়েছিল এমন নয়, কিন্তু নতুন রাজার স্মৃতি নিয়ে ভাবতে গেলে তিনি এমন একজনকে বুঝতে পারেন, যার মিশ্র ধরনের মতামত রয়েছে। নতুন রাজাকে তিনি দেখেন এভাবে যে, তিনি পূর্ব থেকেই কিছু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছেন, যা নিয়ে পাল্টা মতামতে যাওয়ার চেয়ে বরং সেগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে চান।
”আমি ভ্রু কোঁচকানো দেখিনি। তিনি হয়তো হস্তক্ষেপ করবেন, আপনি চিঠি পাবেন। কিন্তু তিনি জোর দেননি, তিনি চাপাচাপি করেননি, তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন না,” বলেছেন সাবেক মন্ত্রী।
হস্তক্ষেপ করার অভিযোগের প্রসঙ্গে ২০০৬ সালের একটি সাক্ষাৎকারে চার্লস বলেছেন, ”এটা যদি হস্তক্ষেপ করা হয়, আমি তা নিয়ে খুব গর্বিত।” কিন্তু তিনি স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি জয় পাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে ছিলেন না।
”আপনি যদি একেবারেই কিছু না করেন, তাহলে তারা সেটা নিয়ে অভিযোগ করবে। আপনি যদি কিছু করার চেষ্টা করেন, এবং আটকে যান, সাহায্য করার জন্য কিছু করেন, তাহলেও তারা অভিযোগ করবে, ” তিনি বলেছিলেন।
পরবর্তী একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন। কিন্তু মানুষ যেসব পরিস্থিতিতে রয়েছে, সেসব ইস্যু নিয়ে কথা বলার একটি দায়বদ্ধতা তিনি অনুভব করেন।
লেবার দলের সাবেক মন্ত্রী ক্রিস মুলিন তার ডায়রিতে চার্লসের একটি আলোচনার বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। সেখানে তার একক মনোনিবেশ এবং কাজের জন্য সরকারি জটিলতা মাড়িয়ে ঝুঁকি নেয়ার প্রস্তুতি দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন।
”তিনি একই প্রসঙ্গে ফিরে আসেন। কীভাবে তরুণদের জগৎ আরও বিস্তারিত করা যায়, বিশেষ করে অসন্তুষ্ট, অসহায় এমনকি ক্ষতিকর তরুণদের জন্যও। আমি স্বীকার করছি যে, আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। ইনি হচ্ছেন এমন একজন মানুষ, তিনি যদি চান, তাহলে আদর্শের আর আত্ম-সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবনকেও ছিন্নভিন্ন করতে পারেন।”
রাজত্ব শুরুর সময় রাজা চার্লসের কতটা জনসমর্থন আছে?
”রাজতন্ত্রের মতো আগ্রহ উদ্দীপক কিছু টিকে থাকবে না, যদি আপনি জনগণের মনোভাবে বিবেচনায় না নেন। সর্বোপরি, জনগণ যদি না চায়, তাহলে তারা তা পাবে না,” চার্লস বলেছেন।
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ইউগভের চালানো একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জনগণের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ তাকে ইতিবাচকভাবে দেখেন।
কিন্তু তার মা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ অথবা পুত্র প্রিন্স উইলিয়ামের তুলনায় জনমত জরিপে তিনি এখনো পিছিয়ে আছেন। সুতরাং জনগণের মধ্যে এখনো বেশ উল্লেখযোগ্য একটি অংশ আছে, যাদের জয় করা এখনো তাঁর বাকি। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা কম।
ভিক্টোরিয়া মারফি বলছেন, তার প্রথম স্ত্রী প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানার সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে টেলিভিশন শো এবং চলচ্চিত্রগুলোয় যেভাবে চার্লসকে অসহানুভূতিপূর্ণভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, তার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে। ১৯৯৭ সালের অগাস্ট মাসে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানা।
সেখানে হয়তো সত্য ও কল্পকাহিনীর মিশেল ঘটানো হয়েছে, কিন্তু সেগুলো বিশাল প্রভাব তৈরি করেছে।
”গত বেশ কিছু বছরে যা সত্যিই মজার বিষয় ছিল, তা হলো ডায়ানা রাজপরিবারের চারপাশে একটি আখ্যান হিসাবে কতটা বড় হয়ে উঠেছে,” বলেছেন মিজ মারফি।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়্যাল হলওয়ের সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ দ্য মডার্ন রাজতন্ত্রের অধ্যাপক পলিন ম্যাকলারান বলেছেন, চার্লস যখন সিংহাসনের কাছাকাছি এসেছেন, তখন জনসাধারণের ধারণা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছে।
স্পিটিং ইমেজের মতো কৌতুকের অনুষ্ঠানে তাকে নিয়ে আগে যে ধরনের মজা করা হতো, তার বদলে ধীরে ধীরে আরও মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্থান দেয়া হয়েছে, যেখানে পরিবেশ সম্পর্কে বলার মতো তাকে একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।
তবে জনসাধারণের আগ্রহ সবসময় এতো উচ্চমানের বিষয়-আশয় নিয়ে হয় না। রাজপরিবারের প্রধান হিসাবে তাকে প্রিন্স হ্যারি ও মেগান, ডাচেস অব সাসেক্স এবং রাজপরিবারের সাথে তাদের সম্পর্কের গল্প নিয়ে বিশ্ব জুড়ে যে আগ্রহ আছে, সেসব মোকাবেলা করতে হবে।
যখন রাজকীয় গল্প মঞ্চ নাটকের বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনের গল্পের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে শুরু করে, সেটা ঠিক তার জন্য স্বাভাবিক হয় না।
রাজা চার্লসকে অন্যান্য পারিবারিক কঠিন সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হতে হবে। যেমন ভার্জিনিয়া গ্রিফের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নিষ্পত্তি করার পরে প্রিন্স অ্যান্ড্রুর ভবিষ্যৎ ভূমিকা কী হবে অথবা আদৌ কোন ভূমিকা থাকবে কি না।
যুক্তরাজ্যের বাইরে তাঁর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে কমনওয়েলথের সঙ্গে আরও আধুনিক সম্পর্ক পুন-নির্ধারণ করা। সংস্থাটির নতুন প্রধান হিসাবে কীভাবে কমনওয়েলথের বিভিন্ন দেশে সফর করবেন, সেসবও।
সেখানে তিনি কীভাবে ঔপনিবেশিকতার কঠিন ইতিহাস এবং দাসত্বের মতো যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল, সেসব বিষয়কে তিনি কীভাবে মোকাবেলা করবেন।
যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১৪টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন রাজা চার্লস। এদের কোনো কোনো দেশ কমনওয়েলথে থাকার পাশাপাশি পুরোপুরি প্রজাতান্ত্রিক হয়ে যেতে চায়। রাজা চার্লস এর মধ্যেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন, এই পরিবর্তনের ব্যাপারে তিনি আলোচনা করতে প্রস্তুত আছেন।
তার রাজত্বের পথ-চলা মসৃণ করতে এর মধ্যেই বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি অবশ্যই আনন্দিত হয়েছিলেন যখন তার মা হস্তক্ষেপ করে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, রাজা হওয়ার পর তার স্ত্রী ক্যামিলা প্রিন্সেসের পরিবর্তে কুইন কনসর্ট উপাধি ব্যবহার করতে পারবেন।
কুইন কনসর্ট ক্যামিলা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একজন সমর্থক হবেন যখন তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় পদগুলোর একটিতে এমন বয়সে দায়িত্বভার শুরু করতে যাচ্ছেন, যখন বেশিরভাগ মানুষ অবসরে চলে যান।
এই মুহূর্তটি, সমস্ত রকম গাম্ভীর্য নিয়ে, তাঁর বাকি জীবনের জন্য অপেক্ষা করছে।