রানির স্মরণসভায় যাওয়া ইমামকে অপসারণের দাবি জানাচ্ছে ইস্ট লন্ডন মসজিদের বাংলাদেশি মুসল্লিরা
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ ব্রিটেনে মুসলিম কমিউনিটির সুপরিচিত এক ইমাম রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্মরণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করায় তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেছে লন্ডনে বাংলাদেশিদের সবচেয়ে বড় মসজিদের একদল মুসল্লি।
ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম শেখ মোহাম্মদ মাহমুদ সম্প্রতি রিজেন্ট পার্ক মসজিদে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্মরণে আয়োজিত সভায় অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেন। সেই অনুষ্ঠানে শিশুরা যুক্তরাজ্যের জাতীয় সঙ্গীত ‘গড সেভ দ্য কিং’ পরিবেশন করে।
এই অনুষ্ঠানের খবর তখন বেশ ফলাও করেই ব্রিটেনের জাতীয় গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল।
কিন্তু এই অনুষ্ঠানকে ঘিরে গত কিছুদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ইমাম মাহমুদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে। তাকে অপসারণের দাবি জানিয়ে চেঞ্জ ডট অর্গ ওয়েবসাইটে একটি পিটিশন করা হয়েছে যাতে এরই মধ্যে এক হাজারের বেশি মানুষ সই করেছেন।
এই আবেদনে বলা হয়েছে, “যিনি ঔপনিবেশিক পদক গ্রহণ করেন এবং আপনার সন্তানদের দিয়ে ‘গড সেভ দ্য কিং’ গান করান, তার কাছ থেকে কি আশা করেন? এসব ইমামের কাছে আপনার সন্তানদের কেন পাঠাবেন?”
উল্লেখ্য, ইমাম শেখ মোহাম্মদ মাহমুদ ব্রিটেনের সম্মানসূচক পদক ‘অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার” (ওবিই) পেয়েছেন।
বিক্ষোভে যা ঘটেছে
গত শনিবার ইস্ট লন্ডন মসজিদে মাগরিবের নামাজের পর একদল মুসল্লি ইমাম মাহমুদকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এই বিক্ষোভের ভিডিও কয়েকটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ এবং ফেসবুকে শেয়ার করেছেন অনেকে।
একটি ভিডিওতে দেখা যায়, উত্তেজিত মুসল্লিরা মসজিদের বড় হলঘরের সামনে জড়ো হয়ে উচ্চস্বরে কথা বলছেন, আর মসজিদের কর্মকর্তারা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
বিবিসি জানতে পেরেছে, বিক্ষোভরত মুসল্লিরা সেদিন ইমাম মাহমুদের অপসারণের দাবি জানাতে মসজিদের কর্মকর্তাদের কাছে ধর্না দেন। সেদিনই এই বিক্ষোভের ছবি এবং ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হয়।
কয়েকটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এখন এ নিয়ে বাংলাদেশি মুসল্লিদের মধ্যে তীব্র বিতণ্ডা চলছে।
‘আল্লাহর ঘরের অপব্যবহার’
ইমাম মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হচ্ছে, “তিনি শুধু আল্লাহর ঘরের অপব্যবহার করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি শিশুদের বিপথে চালনা করেছেন। আমাদের পিতা-মাতার প্রজন্ম মসজিদ বানিয়েছেন তাদের সন্তানদের ইসলামী শিক্ষা দেয়ার জন্য, ‘পশ্চিমা-করণ’ থেকে বাঁচাতে, কিন্তু এসব ইমামদের দেখে মনে হয় তারা যেন মুসলিম শিশুদের পশ্চিমা ধাঁচে গড়তে চায়।”
তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ইমাম মাহমুদের ভূমিকার প্রশংসা করে তার পক্ষেও সোচ্চার হয়েছেন অনেকে।
চেঞ্জ ডট অর্গে তার পক্ষেও একটি পিটিশন খোলা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, ইমাম মাহমুদ সম্পর্কে অনেক ভুয়া খবর এবং মিথ্যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
যে অনুষ্ঠানকে ঘিরে এই গণ্ডগোল পাকানো হচ্ছে, তা ইস্ট লন্ডন মসজিদে হয়নি, সেটি আয়োজন করা হয়েছিল রিজেন্ট পার্ক মসজিদে। সেখানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়েছে অনুষ্ঠানের একেবারে শেষে। এরকম কোন জাতীয় অনুষ্ঠানে তাই করা হয়।
আবেদনে আরো বলা হয়, “এই কাজ ভুল ছিল না সঠিক ছিল, সেটার ব্যাখ্যা ইসলামী পণ্ডিতদের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিৎ।”
ইমাম শেখ মোহম্মদ মাহমুদ যা বলছেন
এই ঘটনার ব্যাপারে জানতে বিবিসি বাংলা ইমাম শেখ মোহাম্মদ মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল।
ইস্ট লন্ডন মসজিদে তার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
তবে তিনি বলেন, যে ঘটনা নিয়ে কথা হচ্ছে, সেই অনুষ্ঠানে তিনি একজন আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তৃতা দিয়েছেন মাত্র। আর অনুষ্ঠানটি হয়েছে রিজেন্ট পার্ক মসজিদে।
সেই অনুষ্ঠানের খবর বিবিসি সহ ব্রিটেনের জাতীয় গণমাধ্যমে ভালোভাবেই প্রচার করা হয়েছে।
ইমাম মাহমুদ ব্রিটেনের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তার জন্ম মিশরে, ১৯৮৬ সালে মাত্র ছয় সপ্তাহ বয়সে তিনি পরিবারের সঙ্গে লন্ডনে আসেন। তিনি ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডনে জীববিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। পরে তিনি ইসলামিক ধর্মতত্ত্বে উচ্চশিক্ষা নেন।
লন্ডনের ফিনসবারি মসজিদে ২০১৭ সালে যখন এক সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছিল, তখন তিনি সেই মসজিদের ইমাম ছিলেন। সেদিন হামলাকারী শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ড্যারেন অসবোর্নকে যখন জনতা মারতে যায়, তখন তাদের নিরস্ত করেছিলেন তিনি।
এই ঘটনার কারণে তিনি ব্রিটিশ গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। ইমাম মাহমুদ তার বিভিন্ন কল্যাণমূলক কাজের জন্য অর্ডার অব ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) খেতাব পান।
তিনি এখন লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকার ইস্ট লন্ডন মসজিদের খতিব। এই মসজিদে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন নামাজে ইমামতি করেন একই সঙ্গে বিভিন্ন কমিউনিটি কার্যক্রমেও অংশ নেন।
ইস্ট লন্ডন মসজিদ ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় মসজিদগুলোর একটি। এটির নেতৃত্ব এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে মূলত বাংলাদেশিরাই।
ইস্ট লন্ডন মসজিদ যা বলছে
ইস্ট লন্ডন মসজিদের জেনারেল বোর্ডের একজন সদস্য হামিদুর রহমান আজাদ জানিয়েছেন, ইমাম শেখ মোহাম্মদ মাহমুদকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভের কথা তিনি শুনেছেন, তবে তিনি সেসময় ঘটনাস্থলে ছিলেন না।
“আমি শুনেছি অল্প কিছু মানুষ বিক্ষোভ করেছিল। সংখ্যায় খুব বেশি নয়। আমাদের মুসল্লিদের মধ্যে অনেক ধরণের মত আছে। কিছু মানুষ মনে করে এটা ঠিক ছিল না”, তিনি বলেন।
তবে তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে এটা বিরাট কিছু নয়।
”আমরা যুক্তরাজ্যে বসবাস করি, কাজেই রানি মারা গেলে আমরা তার প্রতি শোক জানাবো, এটাই স্বাভাবিক,” মি. আজাদ বলেন।
তিনি বলেন, মসজিদে যারা আসেন, তাদের মধ্যে অনেকের অনেক বিষয়ে ভিন্ন মত আছে। মসজিদ একটি কমিউনিটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবাইকে তাদের মত প্রকাশ করার সুযোগ দেয় বলে তিনি জানান।
ইমাম মোহাম্মদ মাহমুদকে অপসারণের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ইস্ট লন্ডন মসজিদের নির্বাহী পরিষদ এ নিয়ে কাজ করছে। এটা এত বড় কোন বিষয় নয় যে এটা জেনারেল বোর্ডের কাছে আসতে হবে।”