রোহিঙ্গাদের জন্য কিছুই করতে পারল না নিরাপত্তা পরিষদ
সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব ছাড়াই শেষ হলো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা। বৈঠকে রাখাইনে সামরিক অভিযান বন্ধের জোর দাবি জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁ। তিনি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতাকে মানবিক দুঃস্বপ্ন (হিউম্যানিটারিয়ান নাইটমেয়ার) হিসেবে অভিহিত করেছেন। সতর্কবার্তা দিয়েছেন এই অভিযান বন্ধ না হলে সহিংসতা আরো ছড়িয়ে পড়বে। আরো বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হবে। বাংলাদেশের স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত একটার দিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার সংকট নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। ওদিকে, মিয়ানমারের কাছে সব দেশকে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে জাতি নিধনে যেসব নেতা, বিশেষ করে সামরিক নেতা জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনার দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি নিরাপত্তা পরিষদের ওই অধিবেশনে এসব দাবি উত্থাপন করেন। এই প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের রাখাইনে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতাকে জাতি নিধন বলে অভিহিত করলো। পাশাপাশি শাস্তি দাবি করলো সেনা কর্মকর্তাদের। নিকি হ্যালি বলেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নৃশংসতা চালাচ্ছে। তারা জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিধন অভিযান চালাচ্ছে। এ অবস্থায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানাতে আমাদের ভীত হওয়া চলবে না। তবে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ও ব্যাপক সংখ্যক মানুষের বাংলাদেশে চলে যাওয়ার কারণে মিয়ানমার সরকারের ওপর অতিরিক্ত চাপ দেয়া হলে তাতে মিয়ানমার ও এর আশেপাশের পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজিত করবে বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেজিয়া। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত এই সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক উপায় ও আলোচনার কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মন্তব্য করেন। বলেন, আলোচনা হতে হবে মিয়ানমারের সব জাতি ও ধর্মের প্রতিনিধিদের মধ্যে। একই সঙ্গে তিনি সব পক্ষের তরফ থেকে সহিংসতা বন্ধের ওপর গুরুত্ব দেন। এ সময় তিনি মিয়ানমার সরকারের সুরে সুর মিলান। বলেন, রাশিয়া যেসব তথ্য পাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা উগ্রপন্থিরা সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলো থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের পালিয়ে বাংলাদেশে যেতে বাধ্য করছে। তিনি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘সন্ত্রাসীরাই’ গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ওদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের উপ-রাষ্ট্রদূত উয়াউ হাইতাও মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সহিংসতার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, যেসব রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গিয়েছেন তাদের সমস্যা দ্রুততম সময়ে সমাধান হওয়ার মতো নয়। এ সময় তিনি মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা তুলে ধরেন। বলেন, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন করে চীন। তাই তিনি বলেন, এই সংকট সমাধানে সব পক্ষকেই গঠনমূলকভাবে কাজ করতে হবে, উত্তেজনা নিরসন করতে হবে, ধাপে ধাপে মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। তিনি আশা করেন, শিগগিরই সেখানে শৃঙ্খলা ফিরবে। সাধারণ মানুষের ওপর আর সম্ভবত কোনো ক্ষতিকর কিছু ঘটবে না। সমাজে ফিরবে স্থিতিশীলতা। অন্যদিকে রাখাইন সহিংসতায় নিজেদের দায় বেমালুম এড়িয়ে গেছেন মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইউ থাউং তুন। তিনি নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, রাখাইন সংকট ধর্মের ভিত্তিতে নয়। এ সংকটের মূলে রয়েছে সন্ত্রাস। তাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যাতে তার দেশের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেয় এমন আহ্বান জানান তিনি। আবারো তিনি বলেন, জাতিগত নিধন হয়নি মিয়ানমারে। কোনো গণহত্যাও চালানো হয়নি। তিনি দাবি করেন বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী রোহিঙ্গা মুসলিম উগ্রপন্থিরা। তাদের সহিংসতার জন্যই মানুষ পালিয়ে বাংলাদেশে যেতে বাধ্য হয়েছে। ওদিকে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, মিয়ানমার সরকার অভিযান বন্ধের কথা বললেও এখনো রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ হয়নি। এর ফলে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন কমপক্ষে ৫ লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে বিশে^র সবচেয়ে নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ৯ লাখ সদস্য এখন বাংলাদেশে। তিনি এই পরিস্থিতিকে সমর্থন অযোগ্য বলে আখ্যায়িত করেন। আবারো জাতিসংঘের কাছে আহ্বান জানান মিয়ানমারের ভেতরে একটি সেফ জোন সৃষ্টি করতে। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, শরণার্থীরা বলছেনÑ তাদের ওপর কিভাবে গণধর্ষণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছাড়া করতে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে মিয়ানমার। পাশাপাশি গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। লোকজনের সবকিছু কেড়ে নেয়া হচ্ছে। তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, এইসব নৃশংসতা প্রমাণ করে যে, মিয়ানমার সরকার রাখাইনকে জনশূন্য করে দেয়ার জন্য অস্ত্র হিসেবে অগ্নিসংযোগ করছে। ওদিকে নিকি হ্যালি জাতি নিধনের এই খেলায় জড়িত নেতাদের অবিলম্বে তাদের কমান্ডের দায়িত্ব থেকে অবিলম্বে অব্যাহতি দাবি করে এই অপরাধের জন্য বিচার দাবি করেছেন। জাতিসংঘের একটি প্যানেল যে এলাকায় রোহিঙ্গাদের নিধন করা হয়েছে বা হচ্ছে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু মিয়ানমার সরকার সেই অনুমতি দেয়নি। এরই প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এমন ঝাঁঝালো প্রতিক্রিয়া এলো। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী কমপক্ষে ৫ লাখ এক হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে নির্বিচারে চলছে গণধর্ষণ, গণহত্যা। গ্রামের পর গ্রাম জ¦ালিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওদিকে বৃহস্পতিবার শতাধিক রোহিঙ্গা বোঝাই করে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা করার পর একটি নৌকা বঙ্গোপসাগরে ডুবে গেছে। এতে কমপক্ষে ১৫ জন মারা গেছে। এর মধ্যে ৯ শিশু রয়েছে। এ তথ্য দিয়েছে অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম)। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এপি, অনলাইন স্কাই নিউজ। নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় গতকাল বিকাল তিনটায় (বাংলাদেশ সময় রাত একটায়) এ বিতর্ক শুরু হয়। এতে অ্যান্তনিও গুতেরাঁ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে যে সহিংসতা চলছে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর তা রাখাইনের মধ্যাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ওই এলাকায় এখন আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছেন। তাদের জীবন এতে আরো ঝুঁকিতে পড়বে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সহিংসতা বর্তমান বিশে^র দ্রুততম শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করেছে। এতে মানবাধিকার পরিস্থিতিকে অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, রাখাইন থেকে শিশু, নারী, পুরুষ, বয়স্ক মানুষ এরই মধ্যে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। তারা সেখানে সংঘটিত অপরাধের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে গা-শিউরে ওঠে। তাদের দেয়া সাক্ষ্যে প্রমাণ করে সেখানে মানবাধিকারের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সহিংসতা, শক্তি প্রয়োগ ও আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বৈষম্যহীনভাবে অস্ত্রের ব্যবহার। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে স্থলবোমার ব্যবহার করা হয়েছে। যৌন সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, মিশর, সেনেগাল ও কাজাখস্তানের আহ্বানে শুরু হয় নিরাপত্তা পরিষদের এ বৈঠক। এতে বক্তব্যে মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁ বলেন, অবিলম্বে আক্রান্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। জাতিসংঘ ও সাহায্য বিষয়ক গ্রুপগুলোর প্রতি বর্তমানে যে বিদ্বেষমূলক পরিস্থিতি সেখানে বিরাজ করছে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
এদিনের আলোচনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালির বক্তব্য ছিল এ যাবৎ রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সব থেকে স্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ। তিনি বলেন, ‘এক মাসের বেশি সময় ধরে বার্মা থেকে যেসব ছবি পুরো বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে তা যেন কাউকে দেখতে না হয়। আমরা যেসব কর্মকা-ের ছবি দেখেছি সেগুলো যেন কাউকে সহ্য করতে না হয়।’ প্রাণ নিয়ে পালানো নারী-শিশুদের দুর্দশা, গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিসংযোগ, রাখাইনে হত্যাযজ্ঞের নানা বর্ণনার রিপোর্ট, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তৎপরতা, মানবিক সহায়তার কথা উল্লেখ করে হ্যালি বলেন, ‘তারপরও ভীত সন্ত্রস্ত আহত ব্যক্তিদের দলে দলে বার্মা ত্যাগ অব্যাহত রয়েছে। আর বার্মা সরকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা স্বীকার করতে নারাজ।’
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা দেশে ফিরতে ভীত। বার্মিজ নেতাদের অবশ্যই বাস্তবতা মানতে হবে।
২৫শে আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের ওপর সন্ত্রাসীদের হামলার নিন্দা জানিয়ে হ্যালি বলেন, ‘কিন্তু এরপর যা ঘটেছে তা হলো অসামঞ্জ্যপূর্ণ, বাছবিচারহীন সহিংসতা। বার্মিজ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ আসলে যেমন সেটা স্বীকার করতে আমাদের ভয় পাওয়া চলবে না। সেটা হলোÑ দেশকে জাতিগত এক সংখ্যালঘু মুক্ত করতে নির্মম, চলমান এক অভিযান। এতে সিনিয়র বার্মিজ নেতাদের লজ্জিত হওয়া উচিত যারা গণতান্ত্রিক এক বার্মার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন।’
নিকি হ্যালি আরো বলেন, বার্মিজ সরকারের দাবি তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়ছে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে তারা গণমাধ্যম ও মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে দিক- তাদের দাবি সামনে আসুক। সন্ত্রাসীরাই যদি সমস্যা হবে, তাহলে সেনাবাহিনী ব্যাখ্যা দিক কিভাবে শিশুদের হত্যা করে আর পরিবারগুলোকে তাদের ভিটে থেকে পালাতে বাধ্য করে বার্মা নিরাপদ হবে।
নিকি হ্যালি বলেন, বার্মিজ সামরিক নেতাদের বাগাড়ম্বরপূর্ণ আর উস্কানিমূলক বক্তব্য ইতিমধ্যে ভয়াবহ হয়ে ওঠা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। আর এসব ভাষা প্রয়োগ বার্মিজ জনগণের মধ্যে এই নোংরা দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
তিনি আরো বলেন, ‘এই কাউন্সিলে সুন্দর আর কূটনৈতিক কথাবার্তার সময় ফুরিয়েছে। আমাদের এখন অবশ্যই বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বিবেচনা করতে হবে যারা নিজেদের নাগরিকদের ওপর নির্যাতন চালানো আর ঘৃণা ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত।’
সংকট নিরসনে তিন দফা সুপারিশ করেন নিকি হ্যালি। তিনি বলেন, ‘প্রথমত, বার্মিজ সামরিক বাহিনীকে মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার ওপর সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। যাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন চালানোর অভিযোগ এসেছে তাদের অবিলম্বে পদ থেকে অপসারণ করতে হবে এবং অপরাধের জন্য বিচারের আওতায় আনতে হবে। আর যেসব দেশ বর্তমানে বার্মিজ সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করছে তাদেরকে এসব কর্মকা- বন্ধ করতে হবেÑ জবাবদিহিতার পর্যাপ্ত পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত।
দ্বিতীয়ত, বার্মিজ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই অবিলম্বে জাতিসংঘ সংস্থাগুলো ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলোকে দ্রুত, নিরাপদ ও অবাধ প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে।
নিকি হ্যালি প্রশ্ন রাখেন, বার্মিজ কর্তৃপক্ষ যদি বাস্তুচ্যুতদের ঘরে ফেরার বিষয়ে আন্তরিকই হয়, তাহলে তাদের কাছে খাবার ও চিকিৎসা পৌঁছাকÑ এটা কেন তারা চাইবে না?
তৃতীয়ত, বাস্তুচ্যুত সকলকে নিজ ঘরে ফেরার জন্য তাদের স্বাগত জানাতে হবে মিয়ানমারকে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার আহ্বান জানান নিকি হ্যালি। এমন একটি প্রক্রিয়া নিরূপণ করতে আহ্বান জানান যেখানে আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকবে। কয়েক লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের উদারতার প্রশংসা করেন তিনি। তবে, আরো শরণার্থী ঢলের আশঙ্কা থাকায় এই উদারতা যথেষ্ট হবে না বলে কাউন্সিলকে সতর্কবার্তা দেন নিকি হ্যালি।
ওদিকে, বৃটেনের প্রতিনিধি তার বক্তব্যে সৃষ্ট পরিস্থিতিকে হিউম্যান ট্র্যাজেডি আর মারাত্মক মানবিক সংকট বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়ে অগ্রগতি দেখতে চায় বৃটেন। রাখাইনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের নানা রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে তিনি পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বিশ্ব অভিমত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বার্মা ও বার্মিজ সামরিক বাহিনীর তরফে জবাব আসতে হবে। বার্মিজ সেনাপ্রধানকে অবিলম্বে এই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। ২৫শে আগস্ট বার্মিজ সেনাবাহিনীর ওপর হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, এর যে জবাব দেয়া হয়েছে তা অতিরঞ্জিত। এটা চলতে পারে না। ঘৃণা আর সহিংসতা উস্কে দেয়া বন্ধ হতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাখাইনে জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থার প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। বার্মাকে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে হবে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। আনান কমিশনের সুপারিশগুলো পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে।
চীনের রাষ্ট্রদূত লিয়াং বলেন, আমরা মিয়ানমারে সম্প্রতি সহিংসতার নিন্দা জানাই, পাশাপাশি পরিস্থিতি মোকাবিলায় মিয়ানমার সরকারের অবস্থানকে সমর্থন করি। সংকট সমাধানে আলোচনাকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলেন তিনি। তবে, তিনি এও বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত কোনো সমাধান নেই।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ডায়ালগ করার জন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান লিয়াং। এ জন্য চীন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সহায়তা করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান তিনি।
অপরদিকে নিরাপত্তা কাউন্সিলে রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, মিয়ানমার সংকটের নতুন দিক তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, মিয়ানমার থেকে হিন্দু সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করেছে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালানোর জন্যও তিনি আরসাকে দায়ী করেন। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক কোনো ব্যবস্থা সংকটের সমাধান করবে না বলেও মনে করেন তিনি। মিয়ানমারকে বেশি চাপ দিলে পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
নিরাপত্তা কাউন্সিলে উন্মুক্ত আলোচনার শেষে বক্তব্য রাখেন মিয়ানমার ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি। মিয়ানমারের প্রতিনিধি পুরনো সুরে সৃষ্ট সংকটের দায় চাপায় আরসা’র ওপর। মিয়ানমারে কোনো গণহত্যা বা জাতিগত নিধন হচ্ছে না বলে তিনি দাবি করেন। বাংলাদেশের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি আবুল মাসুদ মোমেন। এসব সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, সহিংসতা বন্ধ করা, মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করা এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো। রাখাইনের সাম্প্রতিক সহিংসতাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ বলে আখ্যা দেন তিনি। মি. মোমেন বলেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়েছে। তাদের মানবিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। মানবিক সহায়তায় এগিয়ে আসা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান তিনি। বক্তব্যে নিরাপত্তা কাউন্সিলের সামনে মিয়ানমারের বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তিনি। মোমেন বলেন, ‘জিরো লাইনের ২০০ মিটারের মধ্যে মিয়ানমারের সেনাদের দেখা গেছে। আমাদের সীমান্তের কাছে ভারী যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েনের খবর পাওয়া গেছে। মিয়ানমারের হেলিকপ্টার ও ড্রোন ১৯ বার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে।’ সর্বশেষ আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা দু’দিন আগে ঘটেছে বলেও জানান তিনি। রোহিঙ্গারা যেন ফেরত যেতে না পারে সেজন্য সীমান্তে মাইন পুঁতে রাখার কথা জানিয়েছেন। বারবার মিয়ানমারের এহেন কর্মকা- অপ্রত্যাশিত ও ইচ্ছাকৃত উস্কানি বলে তিনি আখ্যা দেন। মিয়ানমারের নেতারা কথিত সন্ত্রাসীদের ‘বেঙ্গলি’ আখ্যা দেয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানান মোমেন। মিয়ানমারের এমন ভিত্তিহীন ও বিদ্বেষপরায়ণ প্রচারণা বন্ধ করতে হবে বলে তিনি বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করেন।
সরজমিন পরিস্থিতি দেখতে আবুল মাসুদ মোমেন নিরাপত্তা কাউন্সিলকে বাংলাদেশ সফরের আহ্বান জানান।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কূটনীতিকরা আরো আলোচনার বিষয়ে সম্মত হয়েছেন। এর অংশ হিসেবে আগামী সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিষদে আমন্ত্রণ জানানো হবে সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে। তিনি রাখাইনে তার তদন্তের অভিজ্ঞতা জানাবেন নিরাপত্তা কাউন্সিলকে।