লেবাননে নজিরবিহীন পেজার বিস্ফোরণ, বুধবার ১৪ জন নিহত, পরিণতি কী হতে পারে

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) অনেকটা একযোগে পেজার (যোগাযোগযন্ত্র) বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে পুরো লেবাননজুড়ে। আজ ফের দেশটির বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ছোট এই যন্ত্র ব্যবহার করে থাকে।

লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, লেবাননে সর্বশেষ বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা ৯ থেকে বেড়ে ১৪ জনে দাঁড়িয়েছে, আহত হয়েছে ৪৫০ জনেরও বেশি।

বিস্ফোরণের ঘটনায় মঙ্গলবার কমংগলবা ১২ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ৩ হাজার জন। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। এই ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হিজবুল্লাহ। যদিও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

লেবাননে পেজার বিস্ফোরণ নিয়ে এখন পর্যন্ত কী জানা গেল, তা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে বিবিসি।

কখন ঘটল, কোথায় ঘটল

লেবাননের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিটের দিকে রাজধানী বৈরুতসহ দেশটির আরও কয়েকটি এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, তারা দেখেছেন, লোকজনের পোশাকের পকেট থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এরপর ছোট ছোট বিস্ফোরণ হতে থাকে। বিস্ফোরণের শব্দ ছিল আতশবাজি ও বন্দুকের গুলির শব্দের মতো।

সিসিটিভি ফুটেজের একটি ক্লিপে দেখা গেছে, দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির ট্রাউজারের পকেটে কিছু একটা (পেজার) বিস্ফোরিত হচ্ছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, প্রথম বিস্ফোরণের পর প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে।

বিস্ফোরণের পরপরই আহত ব্যক্তিরা লেবাননের বিভিন্ন হাসপাতালে ভিড় করতে থাকেন।

পেজারে কীভাবে বিস্ফোরণ

ঘটনার পর বিশ্লেষকেরা নানা মত দিচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, হ্যাক করে পেজারের ব্যাটারিগুলোকে হয়তো অতিরিক্ত গরম করে দেওয়া হয়েছিল, আর তাতেই বিস্ফোরণ ঘটে।

তবে অন্য বিশেষজ্ঞদের মত হলো, এ ধরনের কিছু ঘটেনি। বিস্ফোরণের যে ভিডিও দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, এটি ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হওয়া থেকে সৃষ্টি বিস্ফোরণ নয়।

কেউ কেউ বলছেন, পেজার বিস্ফোরণের এই ঘটনার সঙ্গে সরবরাহ শৃঙ্খলের কোনো একটা ঘাপলা থাকার যোগসূত্র আছে। হতে পারে উৎপাদন বা পরিবহনের সময় পেজারগুলোয় কোনো ধরনের গড়বড় করে দেওয়া হয়েছে। আর এমনটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে করছেন তারা।

বিভিন্ন সময়ে সাপ্লাই চেইনে সাইবার হামলার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে সাইবার–দুনিয়ায় ক্রমাগত উদ্বেগ বাড়ছে।

সম্প্রতি এমন কিছু ঘটনা দেখা গেছে যে, হ্যাকারেরা উৎপাদনে থাকা পণ্যের তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। তবে এসব হামলার ঘটনা সাধারণত সফটওয়্যারের সঙ্গে সম্পর্কিত।

হার্ডওয়্যারের সাপ্লাই চেইনে হামলার ঘটনা খুবই বিরল। কারণ, এগুলোতে কোনো গড়বড় করতে হলে তা হাতের নাগালে পেতে হয়।

সেদিক থেকে লেবাননের ঘটনাটি যদি সাপ্লাই চেইনে হামলা থেকে হয়ে থাকে, তাহলে কোনো না কোনোভাবে গোপনে পেজারগুলোয় গড়বড় করা হয়েছে। আর কাজটি করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের গোপন তৎপরতা চালাতে হয়েছে।

ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধাস্ত্রবিষয়ক সাবেক এক বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, যন্ত্রগুলোর প্রতিটির ভেতর সামরিক মানের ১০ থেকে ২০ গ্রাম করে উচ্চ বিস্ফোরক রেখে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে। তার ধারণা, কোনো যন্ত্রে কোনো ভুয়া ইলেকট্রনিক উপকরণের ভেতর বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল।

এই বিশেষজ্ঞের ধারণা, বিস্ফোরকের সঙ্গে একটি সংকেতও যুক্ত করা ছিল, যাকে ‘আলফানিউমেরিক টেক্সট মেসেজ’ বলে ডাকা হয়।

হতাহত কারা

হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে হিজবুল্লাহর দুই পার্লামেন্ট সদস্যের দুই ছেলে আছেন। এ ছাড়া হিজবুল্লাহর এক সদস্যের মেয়েও নিহত হয়েছেন।

আহত ব্যক্তিদের মধ্যে লেবাননে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত মোজতবা আমানিও আছেন। ইরানি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, তার আঘাত গুরুতর নয়।

সূত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে, হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ এই বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত হননি।

লেবাননের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক মন্ত্রী ফিরাস আবিয়াদ বলেছেন, আহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই হাত ও মুখে আঘাত পেয়েছেন।

Smoke rises from a mobile shop as civil defence members gather in Sidon

বিবিসির নিউজ আওয়ার অনুষ্ঠানে ফিরাস আবিয়াদ বলেছেন, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যারা চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাদের বেশির ভাগের পরনে বেসামরিক পোশাক। তাই তারা হিজবুল্লাহ কিংবা নির্দিষ্ট কোনো সংগঠনের সদস্য কি না, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন।

মন্ত্রী আরও বলেছেন, চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের মধ্যে বয়স্করা যেমন আছেন, তেমনি কম বয়সীরাও আছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চিকিৎসাকর্মীও আছেন। আহত ব্যক্তিদের মুখে, বিশেষ করে চোখে আঘাত আছে। কারও কারও হাতে আঘাত আছে। কারও হাত কেটে ফেলতে হয়েছে।

লেবানন ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ সিরিয়াতে একই ধরনের বিস্ফোরণে ১৪ জন আহত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি পর হিউম্যান রাইটস এই তথ্য জানিয়েছে।

দায়ী কে

লেবাননে পেজার বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ দায় স্বীকার করেনি। তবে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী ও হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে এই ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়েছে।

লেবাননের প্রধানমন্ত্রী নাজিব মিকাতি বলেছেন, বিস্ফোরণের এই ঘটনা তার দেশের সার্বভৌমত্বের গুরুতর লঙ্ঘন। সব দিক থেকেই এটা অপরাধ।

এক বিবৃতিতে হিজবুল্লাহ বলেছে, এই বিশ্বাসঘাতক ও অপরাধী শত্রুপক্ষ অবশ্যই এই অপকর্মের জন্য ন্যায্য শাস্তি পাবে, তারা সেটা আশা করুক বা না করুক।

ইসরায়েলি কর্মকর্তারা অবশ্য এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে এই বিস্ফোরণের পেছনে যে ইসরায়েলেরই হাত আছে, এ ব্যাপারে বেশির ভাগ বিশ্লেষক একমত।

যুক্তরাজ্যের ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিমন ম্যাবন বিবিসিকে বলেন, নিজেদের লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান শনাক্তের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের নজির ইসরায়েলের আছে। তবে লেবাননের ঘটনাটিকে ‘নজিরবিহীন’ বলে উল্লেখ করেন তিনি।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান চাথাম হাউসের বিশেষজ্ঞ লিনা খাতিব বলেন, লেবাননের ঘটনাটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, হিজবুল্লাহর যোগাযোগ নেটওয়ার্কের গভীরে অনুপ্রবেশ করেছে ইসরায়েল।

হিজবুল্লাহ কেন পেজার ব্যবহার করে

যোগাযোগমাধ্যম হিসেবে পেজারের ওপর নির্ভর করে হিজবুল্লাহ। প্রযুক্তিগত দিক থেকে এই যন্ত্র খুব একটা উন্নত নয়। ইসরায়েল যেন হিজবুল্লাহর সদস্যদের অবস্থান শনাক্ত না করতে পারে, মূলত তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই তারা এই যোগাযোগযন্ত্র ব্যবহার করে থাকে।

পেজার হলো এক ধরনের বেতার টেলিযোগাযোগ যন্ত্র। যন্ত্রটি আলফানিউমেরিক মেসেজ গ্রহণ করে। যন্ত্রে এই মেসেজ দেখা যায়।

হিজবুল্লাহর সদস্যদের জন্য মুঠোফোন ব্যবহার করা ঝুঁকিপূর্ণ। এই ঝুঁকির কারণে তারা অনেক আগে থেকেই মুঠোফোন ব্যবহার বাদ দিয়েছে।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের নেতা ইয়াহিয়া আইয়্যাশ বোমা বানানোর ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলি গুপ্তহত্যার শিকার হন। তার হাতে থাকা ফোনটি বিস্ফোরিত হয়ে তিনি নিহত হন। মূলত এই ঘটনার পর মুঠোফোন ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যায় ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো।

তবে হিজবুল্লাহর এক সদস্য বার্তা সংস্থা এপিকে বলেছেন, পেজারের ব্যবহার তাদের কাছে নতুন। সংগঠনটির সদস্যরা আগে পেজার ব্যবহার করতেন না।

যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) সাবেক বিশ্লেষক এমিলি হার্ডিং বলেন, নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে যেভাবে বিস্ফোরণ ঘটানো হলো, তা হিজবুল্লাহর জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর। ঘটনাটির মাত্রা ব্যাপক। এই ঘটনা শুধু শারীরিক ক্ষয়ক্ষতিই ঘটায়নি, ঘটনাটি হিজবুল্লাহর গোটা নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।

হার্ডিং মনে করেন, এই ঘটনায় হিজবুল্লাহ অভ্যন্তরীণভাবে ব্যাপক পরিসরে একটি তদন্ত চালাবে। আর তা হিজবুল্লাহকে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত রাখতে পারে।

হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল সংঘাত কি বাড়বে

ইসরায়েলের আঞ্চলিক শত্রু বলে বিবেচিত ইরান। তেহরানের সঙ্গে হিজবুল্লাহর সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ, তা ছাড়া কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে হিজবুল্লাহর উত্তেজনা চলছে।

কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত এলাকা দিয়ে দফায় দফায় রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলও পাল্টা হামলা চালিয়েছে। এ অবস্থায় দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়।

ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভার পক্ষ থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের আবার নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মাথায় লেবাননে পেজার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল।

ইসরায়েল সফররত এক মার্কিন কর্মকর্তাকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার দরকার, তা তারা করবেন।

এর আগে গত সোমবার ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা বলে, সাবেক এক কর্মকর্তাকে হত্যার লক্ষ্যে হিজবুল্লাহর একটি প্রচেষ্টা তারা রুখে দিয়েছে।

পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, উত্তেজনা সত্ত্বেও এত দিন পর্যন্ত উভয় পক্ষ নিজেদের সংযত রেখে এসেছে। পুরোদমে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার মতো কোনো শেষ সীমা তারা অতিক্রম করেনি। তবে গতকালের ঘটনার জেরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। হিজবুল্লাহ ইতিমধ্যে গতকালের বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে।


Spread the love

Leave a Reply