শিশুর বিকাশে পুষ্টিকর খাবার আর খেলাধুলাই যথেষ্ট নয়, বলছেন গবেষকরা
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃঢাকার বাসিন্দা মৌটুসি রহমানের ছেলের বয়স দেড় বছর। তিনি এতদিন ধরে শিশুর যত্ন বলতে শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাবার আর সময় অনুযায়ী টিকা দেয়ার কথাই জানতেন।
অথচ মায়ের গর্ভ থেকেই যে শিশুর বিকাশ শুরু হয় এবং এর পেছনে যে আরও অনেকগুলো বিষয় জড়িত তা নিয়ে কোন ধারণাই ছিল না মিসেস রহমানের। এর পেছনে প্রচারণার অভাবকে প্রধান কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন।
মিসেস রহমান বলেন, “শিশুর বিকাশে আসলে কি করতে হয় তার বিস্তারিত আমি কিছুই জানিনা। যেভাবে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেয়া হয় সেভাবে যদি এ বিষয়ে প্রচারণা চালানো হতো। আমরা জানতে পারতাম।”
“আমি সবই শিখেছি আমার মায়ের কাছ থেকে। কিছু হয়তো ইন্টারনেট থেকে দেখেছি। কিন্তু যারা দরিদ্র বা স্বল্প-শিক্ষিত তারা কিভাবে জানবে?”
মিসেস শামনাজও এতদিন মনে করতেন যে শিশুর বিকাশের পুরোটাই নির্ভর করে, পুষ্টিকর খাবার, ভাল স্কুলের শিক্ষা এবং খেলাধুলার ওপর।
এর পাশাপাশি শিশুর বিকাশে যোগাযোগের যে বিশাল ভূমিকা আছে সে বিষয়টি জন সচেতনতার ক্ষেত্রে কখনোই গুরুত্ব পায়নি বলে তিনি জানান।
“কিভাবে বাচ্চাকে লালন পালন করতে হয়, তাদের কোন বিষয়গুলো মনোযোগ দিতে হয়, কিভাবে বাচ্চার সাথে এনগেজ হওয়া প্রয়োজন এই বিষয়গুলো বুঝতে পারিনি।।”
“আমার মনে হতো পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো, খেলতে নিয়ে যাওয়া, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া এটাই সব বলে মনে হতো।”
শিশুর জন্মের পর থেকে প্রথম আট বছর তার শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল।
এই সময়ের মধ্যে শিশুর অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা সার্বিক বিকাশের ওপর প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।অথচ শিশুর বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ এ দিকটি বাংলাদেশে এখনও অবহেলিত বলে ব্র্যাকের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশে আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট বা প্রারম্ভিক শৈশব সেবা নিয়ে ওই গবেষণায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন অধ্যাপক ফেরদৌসি খানম।
তিনি মনে করেন আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিশেষ করণীয় আছে।
মিসেস খানম বলেন, “শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশের সময়টা হল তার সারা জীবনের ভীত গড়ে দেয়। এই ভীত যদি মজবুত না হয়, ওই শিশুটা হয়তো সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে, পরিকল্পনার ক্ষেত্রে, বা সমাজের অন্য কারও সাথে মিশতে সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে।”
“তাই প্রাথমিক কেয়ার গিভার মানে মা-বাবা, পরিবার, থেকে শুরু করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্বে যারা আছেন মানে কমিউনিটি, সরকার, অর্থাৎ যারা উন্নয়নের সাথে জড়িত তাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।”এছাড়া শিশুদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পাশাপাশি তাদের সঙ্গে কথা বলা, খেলাধুলা করা, গল্প শোনানো, ভাল পরিবেশে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, যেন তাদের বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
শিশুর সার্বিক বিকাশের ক্ষেত্রে মিসেস খানম যে বিষয়গুলোর কথা উল্লেখ করেছেন তার ব্যাপারে বাংলাদেশের বেশিরভাগ অভিভাবকের তেমন পরিষ্কার ধারণা নেই বলে গবেষণা থেকে জানা যায়।
এছাড়া শিশুকে পর্যাপ্ত সময় দিতে না পারা, সন্তান প্রতিপালনে বাবার ভূমিকা মায়ের তুলনায় কম থাকা এমন আরও নানা বিষয় শিশুর পূর্ণাঙ্গ বিকাশে বাধার সৃষ্টি করতে পারে এবং এতে শিশুর দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে বলে জানান মনোরোগবিদ ড. মেখলা সরকার।
মিসেস সরকার বলেন, “একটি শিশুর মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি জরুরি তার এনভায়রনমেন্টাল ফ্যাক্টরটা জরুরি। অর্থাৎ তার পরিবার,আশেপাশের মানুষ, বেড়ে ওঠার পরিবেশ কেমন সেটার ওপর শিশুর মানসিক বিকাশ নির্ভর করে।”
“এখন যদি জেনেটিক ফ্যাক্টর ঠিক থাকে কিন্তু এনভায়রনমেন্টে গলদ থাকে তাহলে বাচ্চার মধ্য ভীতি সঞ্চার হতে পারে, উদ্বেগে ভুগতে পারে, ইনসিকিওর হয়ে যেতে পারে, অবসাদগ্রস্ত হতে পারে এমনকি আচরণগত সমস্যাও দেখা দিতে পারে।”তবে বাংলাদেশে যে সুবিধাবঞ্চিত শিশু রয়েছে বা যাদের বেড়ে ওঠার মৌলিক নিয়ামকগুলোর অভাব রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এই প্রারম্ভিক শৈশব সেবা নিশ্চিত করা বেশ বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন অধ্যাপক ফেরদৌসি খানম।
এক্ষেত্রে জন সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের আরও বেশি বিনিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন তিনি।