সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলি
সমীক্ষায় দেখা যায় বাংলাদেশে শিক্ষার হার ৭১% এর উপরে। আসলে কি তাই? এই সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে বা বলা হয়েছে যারা অন্তত নাম স্বাক্ষর করতে পারবে তারাই শিক্ষিত বলে বিবেচিত হবে। যদিও প্রকৃত শিক্ষিতের হার অনেক কম বলেই বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। স্বাধীনতা উত্তর কালের দ্বিতীয় প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়লেও প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার হার একেবারেই উল্লেখ করার মতো নয়। এর ফলে প্রথম প্রজন্মের বা অল্প শিক্ষিত লোকের উপর দারুন প্রভাব রয়েছে দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত লোকের। অন্যদিকে, বাংলাদেশের একশ্রেণীর অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে যারা তৃতীয় প্রজন্মের বা তিন প্রজন্ম ধরে শিক্ষিত, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রতিপত্তি, সামাজিক মর্যদা, অর্থ-বিত্ত, রাজনৈতিক ক্ষমতায় বেশ বলীয়ান এবং সমাজে তাদের জ্ঞানগত প্রভাব অনেক বেশি। আর অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত জনবসতি শিক্ষিত, বা তাদের চাইতে বেশী জ্ঞানী, বেশী সংস্কৃতিবান ও বেশী ক্ষমতবান লোক দ্বারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রভাবিত হয়ে থাকে।এই প্রভাব নতুন কোন বিষয় নয়, বরং তা বংশ পরম্পরায়, বা ইতিহাস থেকে ইতিহাসে, গোষ্ঠী থেকে গোষ্ঠীতে, দেশ থেকে দেশে এর তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না।
এই শিক্ষিত ক্ষমতাবানদের দ্বারা কোনো বক্তব্য বা তাদের কোনো নীতি, আদর্শ বা মতাদর্শ সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু পরিকল্পিত পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের সেই ধ্যান-ধারণা,বা নীতিকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। যেমন-বাংলাদেশে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো যে ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু রাষ্ট্র নয়, আবার একটি প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা হলো যে দাড়ি, টুপি, বোরকা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা প্রগতি ও উন্নতির অন্তরায়, এখন এই সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করার জন্য অথবা এই মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার জন্য বহু পদক্ষেপ বা ধাপের আশ্রয় গ্রহন করা হয়। আমরা আজকে সেই পদক্ষেপের কথা গুলো নিয়ে আলোচনা করবো।
আপনাদের নিশ্চয়ই ফ্ল্যাগ ওয়েভিং তত্ত্বের (Flag Waving Theory) কথা মনে আছে।Kathleen Bell তার “Developing Arguments: Strategies for Reaching Audience” নামক গ্রন্থে বলেছেন-The ad populum argument presumes that the audience already holds a particular attitude and specific beliefs on the issue. – এড পপুলাম তত্ত বা যুক্তি অনুযায়ী সাধারন জনগন কোন একটি বিষয়ে বা ইস্যুতে ইতিমধ্যেই একটি নির্দিষ্ট মনোভাব এবং নির্দিষ্ট বিশ্বাস রাখে।
ধরুন উপরের উদাহরণ দুটির ক্ষেত্রে আমার্ দেশের জনগণের ইতিমধ্যে একটি মনোভাব রয়েছে, এখন কোনো একটি গোষ্ঠী বা শ্রেণীর লোক সার্বজনীন এই ধ্যান-ধারণাকে পরিবর্তন করতে চায়। তাহলে তাঁদেরক ক্রমাগতভাবে নিম্নের বিভিন্ন পদক্ষেপর আশ্রয় নিতে হবে।
শিক্ষিত প্রভাবশালী কর্তা বনে যাওয়া লোকেরা যে বিষয়টি সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন (সত্য কথন-ভারত বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু নয়, অথবা মিথ্যা কথন- দাড়ি, টুপি, বোরকা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা প্রগতির অন্তরায়), তার পক্ষে সর্বপ্রথমে মানুষের মধ্যে একটি গুন্ গুন্ গুঞ্জন রব তৈরির মধ্য দিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু করতে হয়। তাদের সেই বক্তব্যকে/নীতিকে সবার আগে তাদের অনুগত কিছু মানুষের মধ্যে অহনির্স প্রচার করতে থাকে, অনুগতদের মগজে সবার আগে ঢুকাতে থাকে, এবং বিষয়টি বেশি বেশি প্রচার করতে থাকে, বেশি বেশি আলোচনা করতে থাকে লোক সমাগমে।শিক্ষিত প্রভাবশালীরাই তাদের (উদাহরণস্বরূপ) উল্লেখিত নীতি প্রতিষ্ঠার প্রাণ-পান চেষ্টা করতে থাকে। এটি হলো প্রথম ধাপ, যা অনেকটা পারিবারিক ও বন্ধু পরিমণ্ডলেই সীমাবদ্ধ থাকে।
দ্বিতীয় ধাপে সেই মতের পক্ষে তাদেরকে কিছু কারণ তৈরি করতে হয়, কিছু সুবিধা বর্ণনা করতে হয়, দেশ-বিদেশের কিছু উদাহরণ দেখাতে হয় এবং তাদের মতাদর্শ বা নীতিকে প্রথমে হোয়াটস্যাপ, ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সট্রাগ্রামসহ সকল প্রকার সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশি বেশি প্রচার, প্রসার, শেয়ার করে মানুষের মধ্যে একটি কৌতূহল সৃষ্টি করতে হয়। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে একটি গ্রূপ তৈরি করা যে – হ্যা আসলেই ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধু (যদিও না) এবং দাড়ি, টুপি, বোরকা ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রগতির অন্তরায় (যদিও তা মিথ্যা)।মানুষের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টির পরবর্তী পর্যায়ে আরেকটি কাজ তাদেরকে করতে হয়। এর পরবর্তী ধাপটি আরো বেশি উল্ল্যেখযোগ্য।
উল্ল্যেখিত মতাদর্শের পক্ষে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ তৈরী করা, বা বিশেষজ্ঞ হায়ার করা, তাদেরকে ফিন্যান্স করে কোথাও থেকে বা বিদেশ থেকে ডিগ্রি অর্জন করানো এবং সেই মতাদর্শের(ভারত আমাদের বন্ধু বা দাড়ি, টুপি, বোরকা ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রগতির অন্তরায়)পক্ষে সর্বদা আলোচনা করা, তাদের মতামত দেয়া। আবার তাদের তৈরী বিশেষজ্ঞরা টিভি চ্যানেলে প্যানেল ডিসকাশনে অংশ নেওয়া এবং মতের পক্ষে তাত্তিক আলোচনা ও তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করা। তাদের এই আলোচনাকে টিভি চ্যানেলের প্রাইম টাইম স্লটে দেখানোর ব্যবস্থা করা। এই বিশেষজ্ঞরা আবার কিছু আর্টিকেল, প্রতিবেদন, মুখবন্দ, ও সংবাদপত্রের এডিটোরিয়ালও লিখতে থাকে। তাদের বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এটি প্রতিষ্ঠা করতে চায় যে দেশের জনগণ আসলে সত্য জানা থেকে বিরত রয়েছে, তারা দেশবাসীকে বুঝাতে চায় যে আসলে ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধু (যদিও কথাটিকে দেশবাসী মিথ্যা বলেই মনে করে) আর দাড়ি, টুপি, বোরকা ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রগতির অন্তরায় (যদিও দেশের আপামর জনগণ তা বিশ্বাসই করে না)। উপরোক্ত ধাপ সমুহ পার হওয়ার পড়ে, তারা ইতিমধ্যে অবস্থান একটু শক্ত করে ফেলেছে, এবং জনগণকে দ্বিধা-দন্ধের ফেলে দিয়েছে।
তাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য পরের যে ধাপটিকে তারা বেছে নেয় তা কিন্তু অসাধারণ। তা হলো তাদের উল্ল্যেখিত নীতির বিপরীতে যারা অবস্থান করে বা তাদের মতাদর্শকে যারা বিশ্বাস করে না বা যারা তাদের বক্তব্যকে বিভ্রান্তিকর বলে মনে করে তাদেরকে তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেই ক্ষ্যান্ত হয় না বরং তাদের বিরুদ্ধে বিষেদাগার শুরু করতে থাকে। তাঁদের মতের বিরোধে অবস্থানকারিদেরকে বা অবিশ্বাসীদেরকে দেশ ও জাতির সামনে দেশ বিরোধী হিসেবে চিত্রায়িত করা, উন্নতি ও অগ্রগতির অন্তরায় হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা, উন্নয়ন বিরোধী, আধুনিকতা বিরোধী, বাঙ্গালী চেতনা বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি, দেশের শত্রু, অন্য কোনো দেশের প্রেতাত্মা, তাদের চরিত্র হননের পথ বেছে নেওয়া, তাদের সম্পর্কে নানা ধরণের বাজে মন্তব্য করা ইত্যাদি ইত্যাদি (অর্থাৎ এমন বিষয়ে দায়ী করা হয়, যে বিষয়ের সাথে দেশপ্রেম থাকবে, মানবিকতা থাকবে, মানুষের আবেগ-অনুভুতি জড়িত কিন্তু সেটিকে যাচাই করার মতো বাবস্থা থাকবে না)। এই ধাপটি অনেকটা ব্যক্তিগত আক্রমন পর্যায় হয়ে থাকে। শুরু থেকেই বিরোধী মনোভাবকে সমুলে আঘাত করে থাকে।
এর পরবর্তীতে তারা যে কাজটি করে থাকে তা হলো তাদের মতের পক্ষে বিভিন্ন ভেন্যুতে, প্রেসক্লাবে ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সাংবাদিক সম্মেলন করে তাদের মিথ্যা মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কিছু সাংবাদিকদেরকে আমন্ত্রণ করে থাকে, টিভি ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোক হায়ার করে এবং এই সাংবাদিক শ্রেণীর দ্বারা তাদের সেই মিথ্যা মতটিকে সংবাদপত্রে, ফেইসবুক, হোয়াটস্যাপ, টুইটারসহ নানাহ মিডিয়াতে বেশি বেশি প্রচার করতে থাকে, এর ফলে তারা বিদেশী শক্তির মদদপুষ্ট হয়ে ওঠে এবং বিদেশী টু পাইস কামায়। আবার তাঁদের ভ্রান্ত মতবাদটি এবার জনগনের মধ্যে আলোচনার বিষয়ে পরিনত হয়।প্রাথমিক পর্যায়ে এটিই তারা চেয়েছিল।
এর পরবর্তীতে তারা তাদের ভ্রান্ত ও মিথ্যা মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠা করার এই পর্যায় আদালতের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। তারা এই পর্যায় আদালতে একটি মামলা ঠুকে দিতে পারে। মামলার আর্জিতে তারা এইভাবে বর্ণনা করতে পারে যে – এই বিষয়টি (ভারত আমাদের বন্ধু, যদিও জনগণ তা বিশ্বাস করে না) অথবা দাড়ি, টুপি, বোরকা ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রগতির অন্তরায় (যদিও জনগণ তা মনে করে না)জগণের বিষয়, জনগণের তা জানার অধিকার আছে, বুঝার অধিকার আছে, বুদ্ধি-বৃত্তি চর্চার অধিকার আছে, এই বিষয়টি জনগণের মনোভাবের সাথে জড়িত, আমাদের চেতনার সাথে অঙ্গা-অঙ্গি ভাবে জড়িত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত, কিছু অশুভ শক্তি আপামর জনগণকে তা জানা ও মানা থেকে বিরত রাখছে, তা হতে পারে না।এই মর্মে একটি আইনি সিদ্ধান্ত বা বিহিত হওয়া জরুরি। তারা তাঁদের মতের পক্ষের আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে তাঁদের পছন্দনীয় আদালত থেকে একটি রায় পাওয়ার জোড় প্রচেষ্ঠা চালায়।
এরই পরবর্তীতে তারা যে কাজটি করতে পারে তা হলো – মামলার শুনানি শেষে তাদের সেই সাংবাদিকদের ডেকে তাদের সামনে আদালত প্রাঙ্গনে একটি ব্রিফিং করবে মামলার বিষয়ে। তারা বলবে বিজ্ঞ আদালত আমাদের কথা ও যুক্তিগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। আমরা আশাবাদী যে বিজ্ঞ আদালত আমাদের মতবাদের পক্ষেই রায় প্রদান করবে। তাদের পালিত ও পোষিত সাংবাদিকগণ তা ফলাও করে প্রচার করতে থাকবে, আবার তাদের গৃহপালিত টিভি গুলো আদালত প্রাঙ্গন থেকে তা সরাসরি লাইভ সম্প্রচার করে থাকবে। মূলকথা কিন্তু একটিই সেই ফ্ল্যাগ-ওয়েভিং থিওরী, বেশি বেশি প্রচার করে জনমনে একটি গুঞ্জন তৈরী করা।
আইন আদালত ও সংবাদ সম্মেলন করেই কিন্তু তারা বসে থাকবে না, তারা তাদের মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠা করার পরবর্তী পর্যায়ে তাদের মতবাদটিকে স্কুল, কলেজ, ও বিশ্বাবিদ্যালয়ের পাঠ্য পুস্তকে ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্তির জন্য জোর চেষ্ঠা ও দাবি তুলবে। এক পর্যায়ে মতবাদটি পাঠ্য পুস্তকে জায়গা করে নিবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে তাদের মতের পক্ষে সেমিনার, সিম্পোসিয়াম, বিতর্ক ও আলোচনা সভার আয়জন করে থাকবে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের মাথায় একটি ডোজ ঢুকিয়ে দিতে চাইবে যে ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধু (যদি তা নয়) এবং দাড়ি, টুপি, বোরকা, ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রগতির অন্তরায় (একেবারেই মিথ্যে কথা)। এই ধাপে তারা আরেকটি কাজ করে থাকবে যে – যারা তাদের এই মতবাদে বিশ্বাসী নয় (প্রতিপক্ষ) তাদের সমস্ত বই পুস্তক, লিটারেচার, লাইব্রেরি, সংগ্রশালা বাজেয়াপ্ত করে দিবে, তাদের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিবে, প্রতিপক্ষের সংবাদকর্মীকে জেল জুলুম দিবে, হয়রানি করবে, স্বাধীন মতপ্রকাশের নামে মিথ্যাচার ও বিষেদাগার করবে। পাশাপাশি তারা তাদের মতের পক্ষে ও অনুকূল মতাদর্শে বাংলা ও ইংরেজিতে আকর্ষণীয় আর চটকদার পুস্তিকা, লিফলেট, বই-পুস্তক, লিটারেচার লিখবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে, স্টেডিয়ামে, বাজারে, মার্কেটে, মসজিদের গেট বিনা মূল্যে বিতরণ করবে। তাদের এই কাজে আঞ্জাম দেয়ার জন্য তারা নিয়োগ দিবে এক শ্রেণীর সেচ্ছাসেবক, মাঠকর্মী যারা সর্বদা প্রশাসনের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে থাকবে।
সেচ্ছাসেবক ও বই-পুস্তকের পরবর্তী পর্যায় তারা বিভিন্ন জেলা শহরে তাদের শাখা অফিস গড়ে তুলবে, লোকবল নিয়োগ করবে, তাদের পক্ষে মিছিল মিটিং করবে, জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করবে, ও মানব বন্ধন করবে, কর্মী নিয়োগ করবে, ও দেওয়াল লিখন করবে। এক্ষেত্রে তারা যদি নামমাত্র বাধাপ্রাপ্ত হয় তাহলে তারা বলবে – বাধাদানকারীরা গণতন্রের দুশমন, গণতন্ত্রকে হত্যা করতে চায়, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়, তাঁদের বাক-স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে নিতে চায়, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর কেউ যদি ভুলক্রমে নিহত হয়, বা তারাই কাউকে নিজেরাই হত্যা করে (জনগণের সহানুভূতি অর্জন করার জন্য)নিহতের পরিবারদ্বারা সংবাদপত্র ও টিভিতে সাক্ষাৎকার ও হত্যার বিচার দাবি করা, নিহতকে কেন্দ্র করে আলোচনা করা, শহীদ দিবস পালন করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর কেউ যদি আহত হয় তাহলে তাকে নিয়ে ডকুমেন্টারী তৈরী করা, তা জনগনের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া এবং আহত ব্যক্তিকে দেশের স্বার্থে আত্মত্যাগকারী হিসেবে উপস্থাপন করা এবং জনগনকে তাঁদের মতের পক্ষে উদ্ভুদ্ধ করা।
উপরোক্ত ধাপগুলো পারি দিয়ে এবার তারা তাদের মতাদর্শকে আরো শক্তিশালী করার জন্য কোনো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের আশ্রয় নিয়ে থাকবে। বৃহৎ রাজনৈতিক দলটিকে তারা বুঝাতে চেষ্ঠা করে যে তাদের মতবাদটি সঠিক ও নির্ভেজাল। এক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক দলের সাথে একটি ডিল বা চুক্তি করে যে তারা হলো তাদরে ভোট ব্যাংক, দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই তাদের অবস্থান রয়েছে, তাদের আছে প্রচুর ভোট, তাই তারা ওই দলকে ভোট দিবে বিনিময়ে রাজনৈতিক দলটি ভোটে বিজয়ী হলে তাদের মতবাদটিকে প্রচার করবে, প্রচারে সহায়তা করবে, প্রচার কাজে কোনো বাধা দিবে না, মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠা করবে এবং জনগনকে তা মানতে বাধ্য করবে। শুধু তাই নয়, তাদের (উপরে উল্লেখিত উদাহরনস্বরূপ) মতবাদের পক্ষে পার্লামেন্টে একটি বিল পাশ করতে হবে।বিলটিকে আবার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাবে পাশ দেখাতে বা করাতে হবে।কেউ যদি সেই বিলে বিরোধিতা করে তাদেরকে ওয়াক আউট করতে বাধ্য করা হবে, বা পার্লামেন্টে ভোটদানে বিরত রাখতে হবে।যদি তাদের মতবাদটি প্রথম পর্যায় পাশ না হয়, তাহলে বার বার পার্লামেন্টে বিল আকারে উপস্থাপন করতে হবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তা পাশ হয়। এইভাবে তাদের মতবাদ/মতাদর্শটি পার্লামেন্টে পাশ করিয়ে নিবে।
শেষ ধাপে এসে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্যকে (ভারত আমাদের প্রকৃত বন্ধু নয়) মিথ্যা আর একটি প্রতিষ্ঠিত মিথ্যাকে (দাড়ি, টুপি, বোরকা ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রগতির অন্তরায়) সত্যে পরিণত করার জন্য যে সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব রেখেছে, অবদান রেখেছে, বা যে নিহত হয়েছে তার জন্য একটি বিশেষ দিবস পালন করতে হবে বা তার জন্য একটি মনুমেন্ট তৈরী করতে হবে যাতে যেখানে মানুষ যাবে, ভ্রমন করবে এবং তা বার বার মনে করবে এবং বলতে পারবে যে সত্যি হলো মিথ্যা আর মিথ্যা হলো সত্যি।
ফ্ল্যাগ ওয়েভিং তত্ত্বের মাধ্যমে গুঞ্জন শুরু হওয়া সেই মতবাদটিকে যখন জনগণের মধ্যে চাপিয়ে দেয়া হয় বা বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয় তখন একটি পর্যায় গিয়ে মানুষ আর সত্যি-মিথ্যা খুঁজতে চায় না বরং নকলের সাথেই নিজেকে মানিয়ে নেয়, একপর্যায় এসে মানুষ বিষয়টি নিয়ে আর মাথা ঘামায় না বা স্মৃতির পট থেকে মুছে ফেলে। উপরোক্ত ধাপগুলো পাড়ি দিয়ে একটি ভ্রান্ত মতবাদকে জাতির উপর সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালানো হয়।
বিবেকবান, বুদ্ধিদীপ্ত ও সচেতন নাগরিক সহজেই অনুমান করতে পারবে যে আজ দেশে কি হচ্ছে, কি করতে যাচ্ছে অথবা গোটা জাতির উপর কি ধ্যান-ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে সংখ্যায় খুবই নগন্য একটি শ্রেণী। কিভাবে একটি মিথ্যা অন্যপক্ষ বা প্রতিপক্ষের উপর চাপিয়ে দেয়া যায়, অথবা প্রতিপক্ষের সত্য বিষয়টিকেও কিভাবে জনগণের মধ্যে মিথ্যা হিসেবে উপস্থাপন করা যায় ফ্ল্যাগ-ওয়েভিং থিওরি এবং কন্সপাইরি থিওরির মাধ্যমে।
অথচ মিথ্যা হলো একটি জঘন্যতম অপরাধ, একটি রোগ ও একটি ব্যাধি যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ যেমনটি বলেছেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসূল (স)- বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সত্য একটি পুণ্যময় কাজ। আর পুণ্য জান্নাতের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সর্বদা সত্যের উপর দৃঢ় থাকে, তাকে আল্লাহর খাতায় সত্যনিষ্ঠ বলে লিখে নেয়া হয়। পক্ষান্তরে, মিথ্যা হচ্ছে পাপকাজ। পাপাচার জাহান্নামের পথ দেখায়। যে ব্যক্তি সদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তাকে আল্লাহর খাতায় মিথ্যুক বলে লিখে নেয়া হয়’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত বাংলা ৯ম খণ্ড হা/৪৬১৩)।
পাশাপাশি কুরআন কারীমের সূরা বাকারায় আল্লাহ তায়ালাও মানব জাতিকে সতর্ক করেছেন এই বলে যে “তোমরা মিথ্যা দিয়ে সত্যের গায়ে পোশাক পরিয়ে দিয়ো না এবং জেনে বুঝে সত্য গোপন করো না”। অন্যত্র সুরা গাফিরে আল্লাহ আরও বলেছেন যে–“নিশ্চয়ই আল্লাহ মিথ্যাবাদীকে হেদায়েত দান করেন না”।
একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে উপরোক্ত ধাপগুলোর মাধ্যমে শুধু শত-সহস্র মিথ্যার আশ্রয়ই নেয়া হয় না বরং এমনকি গুম, খুন ও হত্যার ঘঠনাও সংঘটিত হয়। আর এই মিথ্যা মানুষকে নিয়ে যায় ধ্বংসের দাঁড় প্রান্তে।উপরে উল্লেখিত দুটি উদাহরণ শুধুমাত্র পাঠকদেরকে বুঝানোর জন্যই দেয়া হয়েছে, এই রকম বুহু উদাহরন দেওয়া যাবে। বরং যেকোন মিথ্যাকে জাতীয়ভাবে ও স্থায়ীভাবে প্রমোট করার জন্য কিছু শিক্ষিত জ্ঞানপাপী একটি ভ্রান্ত পথের আশ্রয় নেয় যদিও আপামর জনগণ সত্যকে সত্যি হিসাবে এবং মিথ্যাকে মিথ্যা হিসেবেই জেনে থাক, কিন্তু হয়তোবা মুখ খুলে তা বলতে পারেনা, বুঝাতে পারেনা, অথবা পারিপার্শ্বিক কারনে নিরব থাকে।
সত্য সুন্দর, সত্য সমাগত, সত্য শাস্বত আর সত্যের বিজয় সুনিশ্চিত। সত্য সর্বদাই কল্যানের পথ দেখায় এবং মানুষের জীবনের চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে নিয়ে যায়। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রেই মিথ্যাকে বর্জন করি, সত্যকে তুলে ধরি, সত্যের সাথে থাকি এবং সত্য দিয়েই জীবন গড়ি ।