সপরিবারে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরের দুই সপ্তাহে যা ঘটেছিল
পনেরোই অগাস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ঢাকায় ছিলেন না। ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন গাড়িতে চেপে কলকাতা হয়ে ১৬ই অগাস্ট ঢাকায় পৌঁছান।
এরপর বেশ কয়েকটি বৈঠক করে ১৮ই অগাস্ট তিনি বঙ্গভবনে যান।
এক খণ্ড কাগজ হাতে সমর সেনকে সরাসরি প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের সান্নিধ্যে দেখা যায়। মোশতাক দাঁড়ানো থাকতেই ভারতীয় হাইকমিশনার তার কূটনৈতিক নোট পড়ে শোনান। মোশতাক এরপর বিমর্ষ মুখে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন।
ওই কাগজে লেখা ছিল, “যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোনো দেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করা হয়, তাহলে ভারতের সাথে থাকা বৈধ চুক্তির আওতায় ভারতের সেনাবাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
কিন্তু আপনি যদি নাম পরিবর্তন এবং তথাকথিত কনফেডারেশনের ধারণা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে ভারত ১৫ই অগাস্ট থেকে যাই ঘটুক না কেন, তাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে বিবেচনা করবে।”
ভারতের কলকাতার দ্যা স্টেটসম্যানের সম্পাদক মানস ঘোষ এভাবেই ২০১১ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর এক নিবন্ধে সে সময়কার পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন।
সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট সেনাবাহিনীর একটি অংশ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে রাতারাতি দেশের ক্ষমতা নিয়ে নেয়।
মধ্যম সারির ওই কর্মকর্তাদের পছন্দে নতুন রাষ্ট্রপতি হন খন্দকার মোশতাক আহমেদ।
কিন্তু বঙ্গভবনে থেকে দেশ পরিচালনায় নেপথ্য ভূমিকা রাখছিল হত্যাকারী মেজররা।
হত্যাকাণ্ডে জড়িত কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর নামে ক্ষমতা দখল করলেও তাদের পেছনে পুরো বাহিনীর সমর্থন ছিল না।
বরং কয়েকজন মেজর বঙ্গভবন থেকে আদেশ-নির্দেশ দিচ্ছেন, সেটা মানতে পারছিলেন না সামরিক বাহিনীর অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
আবার হঠাৎ করে ক্ষমতা পাওয়া খন্দকার মোশতাক আহমদও ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছিলেন।
সেই সময় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও চলছিল নানা হিসেবনিকেশ, পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনাপ্রবাহে সেসব পরিষ্কার হয়ে যায়।
সেসময় ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন কর্মকর্তা, গবেষকদের লেখা এবং বিভিন্ন দলিলে ১৫ই অগাস্টের পরবর্তী সময়ে ঢাকায় যা ঘটেছিল তার চিত্র পাওয়া যায়।
পরিবর্তন আর অস্থিরতা
সেই সময় ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ডেভিড ইউজিন বোস্টার। তিনি যেসব তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন, তাতে সেই সময়কার বেশ কিছু ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন উঠে এসেছে।
লেখক ও গবেষক মিজানুর রহমান খান ‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’ বইতে তার কিছু উল্লেখ করেছেন।
যেমন রাতারাতি জয় বাংলার পরিবর্তে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলা শুরু হয়।
পনেরোই অগাস্টের পরের প্রথম সপ্তাহে রেডিও ও টেলিভিশনে জাতীয় সংগীত ছাড়া রবীন্দ্র সংগীত এবং ভগবদগীতা পাঠ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, যদিও কিছুদিন পরে আবার তা চালু হয়।
ফলে দেশটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হতে যাচ্ছে বলে প্রথম দিকে পাকিস্তান এবং সৌদি আরব যে ধারণা করেছিল, সেটি ভুল বলে প্রতীয়মান হয়।
তার বার্তায় মি. বোস্টার লেখেন, “মুজিববিহীন একটি সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার পর এখন মনে হচ্ছে, দেশটি বড়ই অনিশ্চয়তার কবলে। ক্ষমতার কেন্দ্র যে কোথায় তা এখনো স্থির হয়নি এবং ভারতের ভয় বাতাসে ভাসছে।”
শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের সঙ্গে ভারতের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। কিন্তু খন্দকার মোশতাক আহমেদ পাকিস্তানের সাথে পুনরায় সম্পর্ক তৈরি করতে চাইছিলেন।
তখন বাতাসে গুজব ভাসছিল যে, পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের একটি ‘কনফেডারেশন’ হতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকেই খন্দকার মোশতাককে সতর্ক করে দিয়েছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনার।
শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পরের কয়েক সপ্তাহে কী ঘটছিল, সেই সময়ের পত্রপত্রিকা থেকে তা আঁচ করা যায়।
দৈনিক ইত্তেফাকের ১৬ই অগাস্ট সংখ্যার শিরোনাম ছিল, “খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ”। আরেকটি খবর ছিল, “উপরাষ্ট্রপতি, ১০ জন মন্ত্রী ও ৬ জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ”।
এদিকে আরেকটি খবর ছিল, কালোবাজারি এবং দুর্নীতি ঠেকাতে শেখ মুজিবের সরকার যে ১০০ টাকার নোট বাতিল বলে ঘোষণা করেছিল, সেখানে সংশোধন এনে বলা হয়, যাদের কাছে অচল একশো টাকার নোট আছে, তারা আট হাজার টাকা পর্যন্ত বদলে নিতে পারবে।
রেডক্রসের তৎকালীন চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আগে একটি ঘটনা নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়েছিল মেজর ডালিমের। ফলে ক্ষমতা নেয়ার পরে ১৫ অগাস্টেই এক আদেশে রেডক্রস চেয়ারম্যান পদ থেকে তাকে অপসারণ করে বিচারপতি বি. এ সিদ্দিককে ওই দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়।
কারফিউ, সামরিক শাসন জারি
পনেরো তারিখ থেকেই কারফিউ জারি করা হয়।
এরপর ২০শে অগাস্ট সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। তবে ঘোষণায় বলা হয়ে, এটি কার্যকর হবে ১৫ই অগাস্ট থেকে।
সেদিন দৈনিক ইত্তেফাক শিরোনাম করেছিল, ‘রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সর্বসময় ক্ষমতা গ্রহণ’। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, সেদিন খন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত, সোভিয়েত চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এবং ভারতের রাষ্ট্রদূত।
সেদিন আরও একটি আদেশে জারি করেন খন্দকার মোশতাক। শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির যে আদেশে মেজর ডালিম এবং মেজর নূরকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দিয়েছিলেন, ২২শে অগাস্ট সেই নয় নম্বর আদেশ বাতিল করা হয়। পরের দিনের দৈনিক বাংলায় এটাই ছিল শিরোনাম।
যেসব দেশ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, মোশতাক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তাদের স্বীকৃতি আসতে শুরু করে। এর মধ্যে রয়েছে শুরুতেই রয়েছে পাকিস্তান।
এরপর একেএকে সৌদি আরব, ইরান, কাতার, সুদান এসব দেশও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পহেলা সেপ্টেম্বর চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
এর আগে ২২শে অগাস্ট অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ এনে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের ২৬জন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন আগের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ।
শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব নিয়ে অস্বস্তিতে ছিল ক্ষমতা গ্রহণকারী মেজরদের দলটি। অগাস্টের ২৪ তারিখে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়।
সেনাবাহিনীতে পরিবর্তন আর সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল
‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য, স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইতে মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, ক্ষমতায় এসেই এই সরকার তাড়াহুড়ো করে সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন আনে। জেনারেল ওসমানীকে (এমএজি ওসমানী) একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা করা হলো।
উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয়। আর পূর্বতন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে অব্যাহতি দিয়ে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয় রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য।
বাকশাল ব্যবস্থা আগেই বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর ৩০শে অগাস্ট আরেকটি অধ্যাদেশ জারি করে দেশে রাজনৈতিক দল বা কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তবে পরে অক্টোবর মাসে একটি বেতার ভাষণে খন্দকার মোশতাক ঘোষণা দেন, ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এবং ১৯৭৬ সালের ১৫ই অগাস্ট থেকে আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করা যাবে।
এর আগে আওয়ামী লীগের সরকার দেশের ১৯টি জেলাকে বিভক্ত করে ৬১টি জেলায় রূপান্তর করে গভর্নর নিয়োগের পরিকল্পনা করেছিল। তখন ২৮শে অগাস্ট সেই ব্যবস্থা বাতিল করে পুনরায় ১৯টি জেলা চালু করে জেলা প্রশাসকদের হাতে দায়িত্ব দেয়া হয়।
সেই সঙ্গে আটককৃত আওয়ামী লীগ ও বাকশালের নেতাদের বিচারের জন্য কয়েকটি সামরিক বিশেষ ও সংক্ষিপ্ত আদালত গঠন করা হয়।
আদেশে বলা হয়, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বেআইনি অস্ত্র রাখার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড।
পনেরোই অগাস্টের পর থেকে ঢাকা বিমানবন্দরের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিমান চলাচল বন্ধ ছিল বলে ধারনা করা যায়। কারণ ইত্তেফাক অগাস্টের ২০ তারিখে একটি সংবাদ প্রকাশ করে যে, ১৯শে অগাস্ট থেকে ঢাকা বিমান বন্দর আবার খুলে দেয়া হয়েছে।
সে সময় এসব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল বঙ্গভবন থেকে।
সরকার বা সেনাবাহিনী নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, সরকারের নীতি কী হবে, এমনকি সেনা প্রধানের দায়িত্ব কী হবে সেসবও মেজরদের দল নির্ধারণ করে দিচ্ছিল।
সেই সময় সেনা সদরে ক্যাপ্টেন হিসাবে কাজ করতেন মেজর জেনারেল (অব) মুহাম্মদ ইবরাহিম।
‘সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে আটাশ বছর’ বইতে তিনি লিখেছেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট থেকে তেসরা নভেম্বর পর্যন্ত দুই মাস ১৮ দিন সেনাবাহিনী অনেকটা দ্বৈত কমান্ডে চলেছিল। আমরা যারা জুনিয়র ছিলাম, তারা কোনমতেই বুঝতে পারছিলাম না যে, দেশ বা সেনাবাহিনী কীভাবে চলছে বা কাজ করছে।”
কূটনৈতিক হিসাব-নিকাশ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়া এবং সেনাবাহিনীর একটি অংশের গঠিত সরকার নিয়ে তখন কূটনীতিক মহলে নানা হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছিল।
যেসব মুসলিম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, তাদের ধারণা ছিল, বাংলাদেশ ইসলামী প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সময় পাকিস্তান ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ’ নামে স্বীকৃতি দিয়ে অন্যসব দেশকেও স্বীকৃতি দেয়ার আহবান জানিয়েছিল।
‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’ বইতে মিজানুর রহমান খান লিখেছেন, “মার্কিন দলিলগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে, ওই সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী কিছু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছি তাদের স্বপ্নের ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ’ এর নতুন নেতাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য।”
সেই সময় বাংলাদেশে মোশতাক সরকারের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করছিল যে, ভারত হয়তো বাংলাদেশের সেনা পাঠাতে পারে।
একই আশঙ্কা করছিল তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল পাকিস্তানও। তবে তারা এও ভাবছিল, এরকম কিছু ঘটলে সৌদি আরবসহ ইসলামী দেশগুলো নিশ্চয়ই বাধা দেবে।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল মোশতাক সরকার। কিন্তু আমেরিকা এক্ষেত্রে সতর্ক পর্যবেক্ষণের নীতি নিয়েছিল।
পাকিস্তানের সঙ্গেও নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের নীতি নিয়েছিল খন্দকার মোশতাকের সরকার। ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ’ কে স্বীকৃতি জানিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, ২৬শে অগাস্ট তার জবাব দেন খন্দকার মোশতাক।
ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. বোস্টার তার তার বার্তায় লিখেছেন, “গত সন্ধ্যায় (২৬ শে অগাস্ট) বাংলাদেশ বেতার একটি খবর প্রচার শুরু করে….ওই বার্তায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর কাছে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের প্রেরিত পত্রের একটি বয়ান রয়েছে।”
” খবরে উল্লেখ করা হয় যে, ভুট্টো এর আগে মোশতাকের কাছে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, এটি তার জবাব। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা এবং উপমহাদেশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ দেখতে আগ্রহী।”
বাংলাদেশের পরিস্থিতি সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছিল ভারতও।
তাদের আশঙ্কা ছিল, নতুন সরকার পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন তৈরি করতে পারে। এমন হলে মৈত্রি চুক্তির আওতায় তারা পদক্ষেপ নেবে। না হলে পুরো ঘটনাটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে মেনে নেয়ার নীতি নিয়েছিল ভারত।
সপরিবারে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পরে ভারতের প্রতিক্রিয়া এসেছিল ১৬ই অগাস্ট, যা দেশের পত্রপত্রিকায় ১৭ই অগাস্ট ছাপা হয়েছে।
একজন মুখপাত্রের বরাত দিয়ে সেখানে বলা হয়, ভারতের সরকার বাংলাদেশের ঘটনাবলী সংক্রান্ত প্রতিবেদন সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে।
“প্রতিবেশী দেশের ঘটনাবলীতে আমরা উৎকণ্ঠা এড়িয়ে থাকতে পারি না, তবে এসবই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।”
“রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এক বিরাট আঘাত বয়ে এনেছে। স্বাধীনতার জন্য সাহসিকতার সঙ্গে জাতীয় সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মন্তুদ মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত,” বলা হয় ওই বিবৃতিতে।
পরের দুই সপ্তাহে আরও যা ঘটেছিল
‘মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড’ বইতে মিজানুর রহমান খান লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট শেখ মুজিবের ভাগনে প্রয়াত শেখ ফজলুল হক মনির পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আশ্রয় চাওয়ার অনুরোধ পেয়েছিল মার্কিন দূতাবাস।
শেখ মনির বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া বাড়িটির তিনটি বাড়ি পরেই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পলিটিকাল কাউন্সিলরের বাড়ি।
মি. বোস্টারের তারবার্তায় বলা হয়, যেহেতু তারা সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন, তিনি মনে করেন, তারা রাজনৈতিক অস্থায়ী আশ্রয় পাওয়ার যোগ্য।
কিন্তু পরিবারের সদস্যরা চিন্তিত ছিলেন যে রাতটা কীভাবে কাটবে। তারা বলেছিলেন, কারফিউ প্রত্যাহার হলে তাঁরা চলে যাবেন।
কারফিউ প্রত্যাহারের পর ১৬ই অগাস্ট সকালে তাদের অনুরোধে তাদের একজন আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয় বলে মি. বোস্টার তারবার্তায় উল্লেখ করেছেন।
এর কয়েকদিন পরেই মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় চেয়েছিলেন হত্যাকারী মেজরদের মধ্যে মেজর মহিউদ্দিন আহমেদ ও তার স্ত্রী।
মিজানুর রহমান খান উল্লেখ করেছেন, “মার্কিন তারবার্তা থেকে জানা যায়, তারা ২০শে অগাস্ট দূতাবাসের কনস্যুলার সেকশনে প্রবেশ করে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। বোস্টারের তারবার্তার জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ঢাকাকে বলেন, প্রকৃত হুমকি কেটে গেলেই তাদের থাকার অনুমতি বাতিল করতে হবে।”
“তাকে জানিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশ থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দিতে দূতাবাসের কিছু করনীয় নেই।
এরপর দূতাবাস থেকেই একজন ক্যাপ্টেনকে টেলিফোন করে কথা বলেন মেজর মহিউদ্দিন। ফোনের পর তিনি ও তার স্ত্রী দূতাবাস ছেড়ে চলে যান।