সমঝোতার পরও তাবলীগ জামাতের দুই গ্রুপ সংঘর্ষে জড়ালো কেন?
বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের দু’টি অংশ ‘জুবায়ের’ ও ‘সাদ’পন্থীদের মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব আবারও সংঘাতে রূপ নিয়েছে। টঙ্গীর তুরাগ তীরে অবস্থিত বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের সংঘর্ষে কমপক্ষে চারজন প্রাণ হারিয়েছেন।
মঙ্গলবার শেষরাতের এ ঘটনায় উভয়পক্ষের আরও প্রায় অর্ধশত অনুসারী আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে।
সংঘর্ষের একপর্যায়ে মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীদের ধাওয়া দিয়ে ইজতেমা ময়দানের নিয়ন্ত্রণ নেন মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভীর সমর্থকরা।
পরে জুবায়েরপন্থীরা পুনরায় সংগঠিত হয়ে আশপাশের এলাকায় বিক্ষোভ-সমাবেশ শুরু করলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
এ অবস্থায় উভয়পক্ষের সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা করে ইজতেমা ময়দান খালি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। দুপুরের পর সবাইকে সরিয়ে দিয়ে মাঠের নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনা, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা।
এছাড়া পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ, মিছিল ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে পুলিশ।
অন্যদিকে, সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায় জুবায়ের ও সাদপন্থীরা একে অন্যের দিকে আঙুল তুলছেন। ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে সাদপন্থীদের নিষিদ্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন জুবায়েরপন্থীদের অন্যতম নেতা মামুনুল হক।
তবে ইজতেমা মাঠের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে পক্ষ দু’টির রেষারেষি, সংঘর্ষ ও পরস্পরকে দোষারোপের ঘটনা এবারই প্রথম নয়।
এর আগে, ২০১৮ সালেও তারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিল এবং তাতে একজন নিহত ও শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিল। এমনকি সবশেষ গত নভেম্বরেও ইজতেমা ও ঢাকার কাকরাইল মসজিদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দু’পক্ষকে মুখোমুখি অবস্থানে দেখা গিয়েছিল।
পরে সরকারের মধ্যস্থতায় পরিস্থিতি শান্ত হয় এবং অতীতের সমঝোতা মেনে জুবায়ের ও সাদপন্থীদের নেতারা সংঘাত এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু সেই অবস্থা থেকে পক্ষ দু’টি আবারও সংঘর্ষে জড়ালো কেন?
কীভাবে সংঘর্ষ শুরু হলো এবং এর ফলে কি সামনের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানে কোনো পরিবর্তন আসতে পারে?
সংঘর্ষের সূত্রপাত কীভাবে?
ঢাকার কাছে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে মঙ্গলবার শেষরাতে সংঘর্ষের যে ঘটনা ঘটেছে, সেটির সূত্রপাত নিয়ে জুবায়ের ও সাদপন্থীরা একে অপরকে দোষারোপ করে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা তুলে ধরেছেন।
তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, আগামী শুক্রবার থেকে পাঁচদিনের জোড় ইজতেমা পালনের ঘোষণা দেন ভারতে তাবলীগ-জামাতের শীর্ষ নেতা মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্দালভীর অনুসারীরা।
কিন্তু তাদের এই জোড় ইজতেমার বিরোধিতা করে গত কিছুদিন ধরেই সড়ক অবরোধ, প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দেওয়াসহ নানান কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন ঢাকার মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীরা।
সম্প্রতি তাদের অনেকে ইজতেমা মাঠেও অবস্থান নেয়। এ অবস্থায় সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে প্রশাসনের কর্মকর্তারা উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন।
এর মধ্যেই মঙ্গলবার শেষরাতে সাদপন্থীরা ইজতেমা ময়দানে ঢুকে পড়লে সংঘর্ষ শুরু হয়।
“সাদপন্থীরা মঙ্গলবার রাত চারটার দিকে ইজতেমা ময়দানে ঢোকার চেষ্টা করে। সেসময় জুবায়েরপন্থীরা বাধা দিলে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে যায়,” বিবিসি বাংলাকে বলেন টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইস্কান্দার হাবিবুর রহমান।
এ ঘটনায় বুধবার বিকেল পর্যন্ত চারজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে প্রশাসন।
“তবে তারা কে কোন পক্ষের সেটি এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি,” বলছিলেন মি. রহমান।
সংঘর্ষে দু’পক্ষের প্রায় অর্ধশত সমর্থক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গুরুতর আহত বেশ কয়েক জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে, সংঘর্ষের খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব ও সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে ভোরেই পরিস্থিতি শান্ত করেন বলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
“সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং পরিস্থিতি এখন শান্ত আছে,” বলেন মি. রহমান।
উল্লেখ্য যে, বিশ্ব ইজতেমার মূল পর্ব শুরু হওয়ার আগে প্রতিবছর জোড় ইজতেমার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
সে অনুযায়ী, চলতি বছর গত ২৯শে নভেম্বর থেকে তেসরা ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচদিন জোড় ইজতেমা পালন করেছিলেন কাকরাইল মারকাজের মাওলানা জুবায়ের আহমেদের অনুসারীরা।
এরপর ২০শে ডিসেম্বর মাওলানা সাদের অনুসারীদের একইভাবে পাঁচদিনের জোড় ইজতেমা পালন করার কথা ছিল।
কী বলছেন জুবায়েরপন্থীরা?
গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে জুবায়ের ও সাদপন্থীদের মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হলে উভয়পক্ষের নেতারা আলোচনায় বসেন। সেখানে তারা অতীতের সমঝোতা মেনে সংঘাত এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন।
কিন্তু তারপরও মঙ্গলবার রাতে সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনা ঘটলো কেন?
“তারাই (সাদপন্থীরা) এর জন্য দায়ী। এর দায় তাদেরকেই নিতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন তাবলীগ জামাতের জুবায়েরপন্থী অংশের অন্যতম নেতা ওমর ফারুক।
তিনি আরও বলেন, “ইজতেমা ময়দান প্রস্তুতে সারাদিন কাজ করে মুসল্লিরা রাতে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমন্ত সেসব মুসল্লিদের ওপর তারা (সাদপন্থীরা) অতর্কিত হামলা চালিয়েছে।”
ওই ঘটনায় তাদের সমর্থকরা সবচেয়ে বেশি হতাহতের শিকার হয়েছেন বলেও দাবি করেছে জুবায়েরপন্থী নেতারা।
“নির্মমভাবে আমাদের মুসল্লিদের হত্যা করা হয়েছে। গুরুতর আহত অবস্থায় অনেকে এখনও হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন,” বলেন মি. ফারুক।
এ ঘটনার পর সাদপন্থীদের আর ইজতেমা করতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে জুবায়েরপন্থীরা।
“তারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের পরিচয় তুলে ধরেছে। সাদপন্থীরা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তাই তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে। তারা যা করেছে তাতে তাদের আর ইজতেমার প্রশ্নই আসে না,” সাংবাদিকদের বলেন জুবায়েরপন্থীদের আরেক নেতা ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক।
একইসঙ্গে, বুধবারের মধ্যেই “হামলা ও হত্যার” ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করার দাবি করেছেন তিনি।
কিন্তু গত তেসরা ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা শেষ করার পরও জুবায়েরপন্থীরা সেখানে কী করছিলেন?
“বিশ্ব ইজতেমা শুরু হওয়ার আগে ময়দান প্রস্তুতের অনেক কাজ থাকে। আমাদের লোকেরা সেগুলোই করছিলেন,” বিবিসি বাংলাকে বলেন জুবায়েরপন্থী নেতা মি. ফারুক।
সাদপন্থীরা যা বলছেন
উল্টো অভিযোগ তুলে জুবায়েরপন্থীদের ওপর সব দোষ চাপিয়েছেন মাওলানা সাদের অনুসারীরা।
“তারাই (জুবায়েরপন্থী) প্রথম আমাদের সাথীদের ধরে মারধর করেন,” সাংবাদিকদের বলেন সাদপন্থীদের গণমাধ্যম সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম।
পূ্র্বঘোষণা অনুযায়ী, জোড় ইজতেমা পালন করতেই সাদপন্থীরা তুরাগ তীরে গিয়েছিল বলে জানান তিনি।
“২০শে ডিসেম্বর যে আমাদের জোড় ইজতেমা শুরু হবে, সেটা তো আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল। তাহলে শেষ হওয়ার পরও কেন উনারা মাঠ দখল করে রেখেছিলেন?” বলেন মি. সায়েম।
কিন্তু প্রশাসন যেখানে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন, সেখানে দু’দিন আগেই সাদপন্থীরা ইজতেমা ময়দানে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? এছাড়া রাতেই-বা কেন ময়দানে ঢুকতে গেলেন?
“রাতে মাঠে ঢোকার কোনো পরিকল্পনা আমাদের ছিল না। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে আমাদের সাথীরা আসছিলেন,” বলেন মি. সায়েম।
“মাঠে ঢুকতে না পেরে তারা কামারপাড়া ব্রিজ ও রাস্তার বিভিন্ন অংশে অবস্থান নেন। কিন্তু সেখানেও তাদের উপর অনবরত ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন জুবায়েরপন্থীরা। পরে আমাদের সাথীরা বাধ্য হয়ে মাঠে প্রবেশ করেন,” বলেন তিনি।
তবে সংঘর্ষের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন তারা।
“যেভাবেই ঘটুক, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক,” স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন সাদপন্থীদের নেতা রেজা আরিফ।
বুধবার দুপুরের বৈঠকে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে তারা মাঠ ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
“অতীতে আমরা সরকারের সমস্ত কথা রেখেছি, সরকারের এই কথাটুকুও আমরা রাখছি। আমরা এরই মধ্যে সেখানে উপস্থিত সাথীদের বলে দিয়েছি মাঠ ছেড়ে দিতে,” বলেন মি. আরিফ।
তিনি আরও বলেন, “সরকারি সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিয়েছি, উনারাও যেন ইসলামের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, কোনো রকম সমস্যার চেষ্টা না করেন। উনারা যেন রাস্তায় নেমে না আসেন, উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার না করেন।”
সরকার কী বলছে?
মঙ্গলবার রাতের সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনার পর বুধবার দুপুরে তাবলীগ জামাতের বিবদমান পক্ষ দু’টির সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনায় বসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, “এতে ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। খুনিদের কোনো অবস্থায় ছাড় দেওয়ার সুযোগ নাই। যারা প্রকৃত দোষী তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।”
এ লক্ষ্যে মামলার প্রস্তুতি চলছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে, জুবায়েরপন্থীদের নেতা মামুনুল হক ‘সাদপন্থী’দের আর ইজতেমা করতে না দেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে, সে বিষয়ে সরকারের বক্তব্য জানতে উপদেষ্টার কাছে প্রশ্ন রাখেন সাংবাদিকরা।
জবাবে মি. চৌধুরী বলেন, “তারা দু’পক্ষ যদি আলোচনা করে সমাধান করতে পারে, তাহলে সাদপন্থীরা ইজতেমায় অংশ নিতে পারবেন। ইজতেমার তারিখ সরকার বাতিল করেনি। তারা আলোচনা করুক।”
উল্লেখ্য যে, এর আগে গত নভেম্বরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছিলেন যে, অতীতের ধারাবাহিকতায় আগামী বছরেও টঙ্গীর তুরাগ তীরে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
এর মধ্যে প্রথম পর্বে ৩১শে জানুয়ারি থেকে দোসরা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা ইজতেমায় অংশ নিবেন ‘জুবায়েরপন্থীরা’।
এরপর দ্বিতীয় পর্বে সাতই ফেব্রুয়ারি থেকে নয়ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ইজতেমায় ‘সাদপন্থীরা’ অংশ নিবেন।
কিন্তু মঙ্গলবারের ঘটনার পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে আগামী বছর কি শান্তিপূর্ণভাবে ইজতেমা করা সম্ভব হবে?
“তাবলীগের দুই গ্রুপকেই অনমনীয় অবস্থান থেকে এসে ছাড় দিতে হবে এবং তাহলেই কেবল সুন্দর, সুশৃঙ্খল ইজতেমা উপহার দেয়া যাবে,” বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মি. চৌধুরী।
সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ
তাবলীগ জামাতের দু’পক্ষের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনার প্রেক্ষাপটে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠ ঘিরে তিন কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল এবং দুই জনের বেশি জমায়েত হওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে পুলিশ।
সেই সঙ্গে ইজতেমা মাঠে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে গাজীপুর মহানগর পুলিশ।
বুধবার গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
বুধবার দুপুর দুইটা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে বলে গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে, ঢাকার কামারপাড়া, আব্দুল্লাহপুর, উত্তরা সেক্টর-১০ এবং তুরাগ নদীর দক্ষিণ, পশ্চিম এলাকায় যে কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)।
পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে বলে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন ডিএমপি’র গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।
“তাবলীগ জামায়াতের দুই পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘিরে যেন আর কোনও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়, তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে,” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. রহমান।
অন্যদিকে, গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমার ময়দানে সংঘর্ষের ঘটনায় চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে জানান, বুধবার সকাল থেকেই ওই এলাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
বিভক্তির শুরু হয়েছিল যেভাবে
মোহাম্মদ সাদ কান্দালভীর একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ২০১৭ সালে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক তাবলীগ জামাতের নেতাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল। এরপর থেকে বাংলাদেশে দুই গ্রুপ আলাদা হয়ে দুই পর্বে ইজতেমা আয়োজন করেছেন এবং তাতে অংশ নিচ্ছেন।
এই তাবলীগ জামাতের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে, যখন ঢাকায় তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরের বছর কাকরাইল মসজিদের দখল নিয়ে সংঘর্ষ হয়েছিলো দু’পক্ষের মধ্যে।
২০১৮ সালের জুলাই মাসে তাবলীগ জামাতের সাদ বিরোধী অংশকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন নেতা প্রয়াত আহমদ শফী, যিনি মাওলানা শফী নামে পরিচিত ছিলেন।
জুবায়েরপন্থী নেতা শাহরিয়ার মাহমুদ বলছেন, সাদ কান্দালভীর কিছু বিতর্কিত বক্তব্যই আলেম ওলামাদের ক্ষুব্ধ করেছে। এগুলো প্রত্যাহার করে তওবা না চাইলে তাকে এখনো বাংলাদেশে গ্রহণ করা হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“তারা এখন হেফাজতের কথা বলছে। কিন্তু পাকিস্তানে তো হেফাজত নেই। সেখানে কেন সাদ কান্দালভী যেতে পারেন না। তাকে ভুল স্বীকার করতে হবে। তওবা করতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. মাহমুদ।
মি. কান্দালভী তাবলীগ জামাতে কিছু সংস্কারের প্রয়োজনের কথা বলে আসছিলেন আগে থেকেই। এ নিয়ে ২০১৭ সালেই ভারতে তাবলীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিভক্তির সূত্রপাত হয়।
তার একটি বক্তব্য ছিল যে “ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়”। অনেকেই মনে করেন যে এই বক্তব্যের মাধ্যমে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ড পরিচালনার বিনিময়ে অর্থ নেয়ার বিপক্ষে বলা হয়েছে।
সাদ কান্দালভী ওই সময়ে আরও বলেছিলেন, “মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদ্রাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত, যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।”
এসব বক্তব্য দারুল উলুম দেওবন্দ অনুসারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করে এবং তাদের বক্তব্য কান্দালভীর কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া’ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।
সাদ বিরোধীরা বলছেন যে, তাদের বিরোধিতার মূল কারণ হলো সাদ কান্দালভী নবীকে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিতর্কিত বক্তব্য রেখেছেন।
এদিকে, সাদ অনুসারী অংশের নেতা সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম বলছেন সাদ কান্দালভি কোনো বিতর্কিত মন্তব্য করেননি। তিনি যৌক্তিক কথা বলেছেন এবং ধর্ম নিয়ে যেন ব্যবসা না হয় সেটি বলেছেন।
“তৃতীয় পক্ষ এখানে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। তাবলীগ জামাত নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তারা। আমাদের বাধা দিলে আমরা সরকারের সাহায্য চাইবো। সহিংসতা আমরা চাই না। কিন্তু আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। অসংখ্য অনুসারী আমাদের। তাদের আটকে রাখা যাবে না,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. ইসলাম।