সারা দেশে সহিংসতা ও গুলিতে নিহত ১৪২
সোমবার দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ, গুলি ও সহিসংতার ঘটনায় গতকাল ১৪২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকায় ১১ জন ও বিভিন্ন জেলা থেকে ১৩১ জনের মরদেহ রয়েছে। নিহতদের মধ্যে অনেকেই পুলিশের গুলি, বিক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনি ও অগ্নিসংযোগে পুড়ে মারা যান। তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মী ও পুলিশ সদস্য রয়েছেন। আমাদের ঢাকা মেডিকেল প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গতকাল ঢামেকে ৭টি মরদেহ আনা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে ৪ জনের মরদেহ ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এদিকে আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন জেলায় সহিংসতার ঘটনায় গতকাল ১৩১ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরমধ্যে সাভারে ৩৩, যশোরে ২৪, সাতক্ষীরায় ১৪, গাজীপুরে ৮, নোয়াখালীতে ৭, কুমিল্লায় ৬, লালমনিরহাটে ৬, সিলেটে ৫, চুয়াডাঙ্গায় ৪, নাটোরে ৪, বাগেরহাটে ২, রাজশাহীতে ১, বাইপাইলে ১, ফেনীতে ৩, বরিশালে ৩, চট্টগ্রামে ২, বগুড়ায় ২, হিলিতে ২, নড়াইলে ২, জগন্নাথপুরে ১, শাহজাদপুরে ১, শাহরাস্তিতে ১ জন রয়েছেন। এদিকে সোমবারের সহিংসতার ঘটনায় সারাদেশে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়।
সাভার-আশুলিয়ায় গুলি ও সহিংসতায় নিহত ৩৩
স্টাফ রিপোর্টার, সাভার থেকে জানান, সাভার-আশুলিয়ায় বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় সাভারে পুলিশসহ অন্তত ৩৩ জন নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে ২৭ জন নিহত হয়েছেন।
বাকি ৬ জনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। এদের মধ্যে পুলিশ সদস্যও রয়েছে বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার সকালে সাভার-আশুলিয়ার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মঙ্গলবার সকালে আশুলিয়ার বাইপাইলের কাছে ফুটওভারব্রিজে দু’জনের লাশ ব্রিজের রেলিংয়ের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলানো রয়েছে। ঝুলন্ত লাশ দুটি আশুলিয়া থানা-পুলিশের বলে জানান স্থানীয়রা। এ ছাড়া বাইপাইলে একটি পোড়া লেগুনা গাড়িতে তিনটি লাশও রয়েছে যা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। এর আগে সোমবার সাভারের এনাম মেডিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৩ জন, নারী ও শিশু হাসপাতালে ৩ জন, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজে ৯ জন ও হাবিব ক্লিনিকে ২ জনসহ মোট ২৭ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আশুলিয়া থানার সামনে ৪ জন ও আশুলিয়া থানার লাশ ঘরের সামনে ২ জনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মোট ৩৩ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। তবে এই সংখ্যা বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় রমজান আলী (৩৫), শ্রাবণ গাজী (২১), তৌহিদুর রহমান (২৮), মুজাহিদ (২৪), রাসেল (২৮), নাফিজা, সাফওয়ান, নিশান, মুন্না, রফিক, সজীব, রানা, আলামিন ও আবদুল কাইয়ুম। বাকিদের নাম- পরিচয় পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, একদিনে পুলিশের গুলিতে এত মানুষের মৃত্যু বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় চলছে স্বজন হারানোদের আর্তনাদ। এখনো বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পড়ে আছে অজ্ঞাতনামা অনেকের লাশ। বিক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে দিয়েছে সাভার মডেল থানা ও আশুলিয়া থানা। আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি, অফিস ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে এখনো জ্বলছে আগুন। সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার ইউসুফ আলী বলেন, চিকিৎসা নিতে গিয়ে হাসপাতালেই গুলিবিদ্ধ এক নারীসহ ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া দুই শতাধিক গুলিবিদ্ধ রোগীকে আমরা চিকিৎসা দিয়েছি। পরিচয়হীন একজনের লাশ এখনো পড়ে আছে। কিন্তু থানা পুড়িয়ে দেয়ায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না।
আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালের ব্যবস্থাপক হারুন অর রশীদ বলেন, ‘নিহত তিনজনের মধ্যে দু’জনের লাশ স্বজনরা নিয়ে গেছেন। অজ্ঞাতনামা একজনের লাশ হাসপাতালে পড়ে থাকলেও থানায় খবর দেয়ার উপায় নেই। অজ্ঞাতনামা এই মরদেহ নিয়ে আমরা বিপাকে পড়েছি। ১৮ ঘণ্টা ধরে পড়ে থাকা লাশে পচন ধরেছে, দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। সাভার গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক শেখ কবির জানান, তিনজনের লাশ হাসপাতালে পড়ে ছিল। গত সোমবার দিবাগত গভীর রাতে তাদের পরিচয় শনাক্ত করে স্বজনরা লাশ নিয়ে যান। কারও মাথায়, কারও পেটে গুলি লেগেছে। এ ছাড়াও অর্ধশতাধিক ভর্তি রয়েছেন। ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিকে ঘিরে সোমবার বেলা ১১টার পর থেকেই আশুলিয়ার বাইপাইল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে চলে পুলিশের নির্বিচার গুলি।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ থেকে পালানোর খবরে অতি উৎসাহী কর্মকর্তারাও গাঢাকা দেয়ায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে পুলিশ। ফলে নিরাপত্তার সব দায়িত্ব ছেড়ে নিজেদের জীবন নিয়েই সংকটে পড়েন পুলিশ সদস্যরা। প্রাণ বাঁচাতে শুরু হয় সাভার-আশুলিয়ায় পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণ। বিকাল ৩টার পর থেকে প্রাণ বাঁচাতে সাভারের পুলিশ পিছু হটলে বিক্ষুব্ধ জনতাও তাদের ধাওয়া করে। এ সময় আত্মরক্ষার্থে পুলিশ থানা রোডের পুলিশ হাউজিংয়ের বহুতল ভবনে আশ্রয় নিয়ে জনতাকে লক্ষ্য করে ভবনের উপর থেকে গুলি ছুড়লে গুলির মুখেই জনতা ওই ভবনে উঠে পড়ে। শিশু থেকে বৃদ্ধ এমনকি শিক্ষার্থীরা গুলিবিদ্ধ হয়ে আসতে থাকেন বিভিন্ন হাসপাতালে আবার অনেকের মৃত্যু হয় ঘটনাস্থলেই।
বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরাওয়ের উদ্দেশ্যে হামলা চালানো শুরু করলে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। এভাবে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে কাটাতে হয় সাভার মডেল থানা পুলিশের সদস্যদের। জীবন বাঁচাতে জনতার স্রোত লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে পুলিশ সদস্যরা সাভার থানা রোড হয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে সাভার সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। এর আগে সাভার-আশুলিয়া, মডেল থানায় অবস্থানরত পুলিশরা ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সরজমিন দেখা যায়, হেমায়েতপুরে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়রম্যান ফকরুল আলম সমরের বাসা, ঋষিপাড়ায় সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজীবের রাজ প্যালেস, ইমান্দিপুরে কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আবু আহমেদ নাসিম পাভেলের বাসা, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক, সভাপতি নিজাম উদ্দিন আহমেদ টিপুর বাড়িতেও আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। সন্ধ্যার দিকে সাভার মডেল থানার একশ’ গজ সামনে আন্দোলনকারী জনতা আগুন ধরিয়ে দেয়।
এসময় আন্দোলনকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশও গুলি ছোড়ে। এতে অন্তত ১০ জন গুলিবিদ্ধ হয় এবং রফিকুল নামে এক যুবক নিহত হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পুলিশ সদস্যরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যান। পরে আন্দোলনকারীরা থানা ও পোস্ট অফিসের ভেতরে ঢুকে আগুন দিয়ে লুটপাট ও ভাঙচুর চালায়। এ সময় সাভার প্রেস ক্লাবেও ভাঙচুর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সাভার পৌর কমিউনিটি সেন্টারে থাকা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সদের মালামাল, রেশন লুটপাট করে আগুন ধরিয়ে দেয় জনতা। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, আশুলিয়া থানা ও থানার সামনে পাঁচ লাশের তিনটি পুলিশের বলে সাংবাদিকদের কাছে জানতে পেরেছি। এদিকে মঙ্গলবার বিকাল থেকে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বিজয় মিছিল ও আনন্দ র্যালি করেছে।