সিলেটে তীব্র বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, প্রশাসনের প্রস্তুতিতে গড়িমসি ছিল কেন ?

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ সিলেট ও সুনামগঞ্জে জুন মাসে বন্যা হবে বলে ধারণা করা হলেও তার মাত্রা যে এতো ভয়াবহ হবে, সেটা ভাবতেও পারেন নি বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।

ফলে এতো ভয়াবহ বন্যার জন্য প্রস্তুতি নেয়াও সম্ভব হয়নি।

সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলায় বহু বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে অন্তত ৪৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বহু এলাকায় এখনো ত্রাণ সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি।

উপকেন্দ্রে পানি উঠে যাওয়ায় গত দুদিন ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে সুনামগঞ্জ জেলা ও সিলেট জেলার বহু এলাকা।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, আগামী দুদিন বা তিনদিন পর সেখানকার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে তারা ধারণা করছেন।

ভয়াবহ এই বন্যায় ভারতের আসাম ও মেঘালয়ে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

পূর্বাভাস কি দেয়া হয়েছিল?
বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র দেশের শতাধিক নদী পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এসব নদীর পানি বাড়া কমার ওপর ভিত্তি করে তারা বন্যার বিষয়ে পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।

এবারও সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যার আগাম সতর্ক বার্তা দেয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন এই কেন্দ্রের কর্মকর্তারা।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”একটা বন্যা হবে, সেটা অবশ্যই আমরা আগে আঁচ করতে পেরেছিলাম। তবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যে এতো বেশি হবে, সেটা আমাদের আইডিয়া ছিল না। ভারী বৃষ্টি যে হবে, সেই ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। জুন মাসের শুরু থেকেই আমাদের যে ওয়ার্নিং রিপোর্টগুলো ছিল (বন্যার পূর্বাভাস), সেখানে প্রতিদিনই আমাদের এই ধরনের ইঙ্গিত ছিল।”

”আমাদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে সতর্ক বার্তা দেয়া, সেই দায়িত্ব আমরা ঠিকমতো পালন করেছি,” তিনি বলছেন।

বাংলাদেশে জুন মাসে যে প্রবল বন্যা দেখা দিয়েছে, সেটি ওই এলাকায় এই বছরের মধ্যে তৃতীয় দফার বন্যা। এর আগে এপ্রিল ও মে মাসে দুই দফা বন্যা হয়েছিল, যদিও সেবার ততটা ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি।

কিন্তু সেই বন্যা এবং জুন মাসের মেঘালয় ও আসামে অতিবৃষ্টি, সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ করে তুলেছে বলে বলছেন আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া।

তবে বন্যা হওয়ার আগাম সতর্কবার্তা দেয়ার সক্ষমতা থাকলেও, সেই বন্যা কত বড় বা তীব্র হবে, তা বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলতে পারেনা বলে কর্মকর্তারা বলছেন।

”আমরা শুধু বলি, প্রচুর বৃষ্টি হবে এবং সেই বৃষ্টির জন্য কোন কোন নদীর কি কি রেসপন্স হবে, সেটা বলাই আমাদের কাজ। সবসময় একেবারে ঠিক হয় না, কম-বেশি হতে পারে ,” বলছেন মি. ভুঁইয়া।

কী ধরনের প্রস্তুতি ছিল?
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এপ্রিল ও মে মাসের মতো জুন মাসেও বন্যার ব্যাপারে তারা শুরু থেকেই সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন।

কিন্তু সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের প্রস্তুতির অভাব দেখা গেছে। শুধু উপজেলাগুলো নয় সুনামগঞ্জ জেলাটিও দেশের অন্য এলাকা থেকে কয়েকদিন ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যা শুরুর কয়েকদিন পরেও অনেক এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো বা উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করা যায়নি।

সিলেটের গোয়াইনঘাটের সালুটিকরের একজন বাসিন্দা মজিবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, ”আমার ঘর তলিয়ে গেছে। মাচা করে ঘরের মধ্যেই কোনরকমে আছি। খাবার নেই, কোথাও খাবার পানিও পাচ্ছি না।”

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে বন্যার কারণে জেলা শহরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে শহর থেকে বন্যার সহায়তাও আসছে না। এখানকার একজন বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলছেন, ”দুইদিন ধরে মা, স্ত্রী আর ছোট বাচ্চাকে নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে আছি। প্রথমদিন মুড়ি খেয়েছিলাম, এখন আর কোন খাবারও নেই।”

এখনো তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে কোন সহায়তা এসে পৌঁছায় নি বলে তিনি বলছেন।

এসব এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করার কাজ শুরু করেছে সেনাবাহিনীও।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, যেভাবে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে, তা তাদেরকেও অবাক করেছে।

”আবহাওয়া অধিদপ্তর পূর্বাভাস দিতে থাকে। কিন্তু এক রাতে বৃষ্টি হয়ে চার ফিট পর্যন্ত পানি হয়ে গেছে। সিলেট অঞ্চলের মানুষও এরকম ভাবতে পারেনি। গত ১০০ বছরের মধ্যে এরকম হয়নি। ভারতে অনেক বছর পর এরকম বৃষ্টি হয়েছে, তাদের ওখানেও বন্যা হয়েছে। এসব পানি তো আমাদের এখানে চলে আসছে,” তিনি বলছেন।

তিনি বলছেন, এখন তারা সিলেট ও সুনামগঞ্জের জেলা শহর থেকে উপজেলাগুলোয় যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছেন। সেখানে উদ্ধার কার্যক্রমের পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণও শুরু হয়েছে।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি অঞ্চলে গত চারদিনে তিন হাজার মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এরকম ধারাবাহিক বৃষ্টি হয়েছে ১৯৯৫ সালে একবার, তিনদিনে ২৭৯৮ মিলিমিটার আর ১৯৭৪ সালে ২৭৬০ মিলিমিটার। এরকম খুব কম দেখা গেছে বলে গবেষকরা বলেছেন।

এবারের বন্যার পেছনে এই বৃষ্টিকে প্রধানত দায়ী করছেন গবেষকরা।

এবার অতিবৃষ্টির কারণে ভারতের মেঘালয় ও আসামে বন্যা ও ভূমিধ্বস মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দেশটির সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে। সেখানেও ৩০ লাখের বেশি মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকা শুরু হয়েছে। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে এসে মেশে। সেখান থেকে ভৈরব বা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়। তবে সুনামগঞ্জের বন্যার পানি বা মেঘালয়ের পানি ছড়িয়ে পড়ছে হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারেও।

সেখানে এর মধ্যেই বন্যা দেখা দিয়েছে। সেসব এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মি. হোসেন।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া বলেন, ”ভয়াবহ বা তীব্রতা যে হঠাৎ করে হবে, সেটা মনে করার কারণ ছিল না। কারণ এপ্রিল আর মে মাসে এখানে বন্যা হয়েছিল। সেসব পানি সরে গিয়েছিল। এবার যেটা হয়েছে, সেই পানি সরতে পারেনি। সেই সঙ্গে মেঘালয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হয়েছে। সেসব কারণে বন্যাটা হঠাৎ করে প্রবল হয়ে গেছে।”

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ আতিকুল হক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”বন্যা হতে পারে, অতিবৃষ্টি হতে পারে, সেই পূর্বাভাস ছিল। কিন্তু এটা একটা অস্বাভাবিক বন্যা। প্রতিবছর মে মাসের শুরুর দিকে একটা ফ্ল্যাশ ফ্লাড আমরা দেখি।”

”এবারও আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে একটা সতর্কীকরণ দেয়া হয়েছিল যে, উজানে অতি বৃষ্টিপাত হতে পারে। কিন্তু বৃষ্টিপাতের লেভেল কতো হতে পারে, সেটা তারাও বলেনি, আমরাও প্রেডিক্ট করিনি। আমার বৃষ্টিপাতের জন্য ত্রাণসামগ্রী মজুদ করে রেখেছি, আমাদের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু বৃষ্টিপাতের মাত্রাটা আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে,” বলছেন মি. হক।

বন্যার পূর্বাভাস কতটা চ্যালেঞ্জিং?
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইন্সটিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ”একটা পূর্বাভাস দিয়েছিল যে বন্যা হবে, কিন্তু এইরকম রেকর্ড বন্যা হবে, সেরকম কোন পূর্বাভাস আমি দেখিনি। বলা হয়েছিল বৃষ্টি হবে, পানির লেভেল বাড়বে এবং ডেঞ্জার লেভেল ক্রস করবে। কিন্তু এবার একদিনের মধ্যে বৃষ্টি হয়ে পানি নেমে এসেছে।”

তিনি বলছেন, এ ধরনের ফ্ল্যাশ ফ্লাডের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হয় না। কারণ এতো দ্রুত পানি আসে যে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি হয়।

বিশেষ করে হাওর এলাকায় এটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে তিনি বলছেন।

”বন্যার পেছনে আরও কয়েকটি কারণ কাজ করছে। কয়েকদিন আগে এখানে আরও দুইটি বন্যা হয়েছে। নদী ও হাওরে অনেক পানি ছিল। তার সঙ্গে নতুন পানি যোগ হয়ে বন্যা পরিস্থিতি রাতারাতি অবনতি করেছে,” তিনি বলছেন।

বাংলাদেশে বন্যার ক্ষেত্রে ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাস দেয়া হয়। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ বা ভারতের উজানে অতিবৃষ্টি হলে তা সব হিসাবনিকাশ বদলে দিতে পারে।

অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলছেন, প্রতিবছর এই সময়ে হাওরে স্বাভাবিকভাবে পানি আসে। ফলে হাওরে পানি আসতে শুরু করায় কেউ উদ্বিগ্ন হননি। কিন্তু যেভাবে রাতারাতি পানি বেড়ে গেছে, সেটা খুবই বিরল।

এমনকি চেরাপুঞ্জি ঘেঁষা সুনামগঞ্জ হাওরে শত বছরের মধ্যে এরকম ভয়াবহ বন্যার তথ্য নেই গবেষকদের কাছে।

এ ধরনের আকস্মিক বন্যার বিষয়ে উন্নত দেশগুলোতেও আগাম পূর্বাভাস দেয়ার প্রযুক্তি নেই বলে তিনি বলছেন। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীনেও এরকম আকস্মিক বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি বা হতাহতের উদাহরণ রয়েছে বলে তিনি বলছেন।

মি. ইসলাম আশা করছেন, ভবিষ্যতে আরও প্রযুক্তি ব্যবহার করে, ভারতের সঙ্গে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে আরও আগে থেকে ফ্ল্যাশ ফ্লাডের ব্যাপারে আগে থেকে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হবে।

”এখান থেকে যদি আমরা কিছু শিখতে পারি, তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে ফ্ল্যাড ম্যানেজমেন্টের ব্যাপারে আমরা আরও ভালোভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবো, ” বলেন তিনি।


Spread the love

Leave a Reply