“সিলেটে মেয়ের বাড়ি ইফতারির রেওয়াজ” আজ অনেকটা প্রশ্নবিদ্দ!
সিলেটের শত বছরের প্রাচিন ঐতিহ্য- রমজান মাসে ইফতারি। রমজান মাস আসলেই মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রচলন যা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় “পুড়ির বাড়ি ইফতারি” বুঝায়।
যুগযুগ ধরে সিলেটে রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ-একটা আদি প্রথা। নতুন বিয়ে হলে মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে প্রথম রমজানে একবার, রমজানের মাঝখানে আরেকবার এবং রমজানের শেষ দিকে নতুন জামাই-এর জন্য কিছু গিফট, জামা-কাপড় সহ তিনবার ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। অঞ্চল ভেদে এর ভিন্নতাও রয়েছে, অনেক এলাকায় শুধু একবার ইফতারি দেওয়া হয়। প্রথম রমজানে নতুন জামাই-এর জন্য বিভিন্ন ইফতার সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে বড় থালা দেওয়া হয়। আর এই থালা কিনার জন্য প্রথম রমজানে সিলেটের বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট এবং মিষ্টির দোকান গুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় থাকে। পুরো রমজান মাস জুড়ে ইফতারি দেওয়ার ধুমধাম থাকে।
রমজান মাসে মেয়ের শ্বশুর-বাড়ি ছাড়াও ফুফু, ভাগ্নী এবং ভাতিজিদের বাড়িতেও ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ আছে। ফুফুরা বুড়ো হয়ে গেলেও উনাদের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রচলন এখনও আছে। মেয়ে জামাই নিয়ে যদি বিদেশ থাকেন তারপরও সম্মান রক্ষার্থে বাবা-মা মেয়ের শশুর-বাড়িতে ইফতারি পাঠিয়ে থাকেন। অনেক সময় মামা, চাচারা বিদেশ থেকে দেশে গেলে ভাগ্নি এবং ভাতিজির বাড়িতেও ইফতারি নিয়ে যান। আমরা ছোটবেলায় মায়ের ইফতারির জন্য অপেক্ষা করতাম, কখন যে মামা ইফতারি নিয়ে আসবেন। চাচিদের ইফতারির জন্যও অপেক্ষা করতাম। রমজান মাস আসলেই দেখতাম বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন ইফতারি নিয়ে। হাতে লম্বা লিস্ট, কার কার বাড়িতে ইফতারি দেওয়া হবে সেখানে সবার নাম লিথা থাকতো । ফুফু, মেয়ে, সব ভাগ্নী এবং ভাতিজী কারো নাম লিস্ট থেকে বাদ পড়ত না। সবার বাড়িতে ইফতারি পাঠানো হতো। ছোটবেলা পাঁচ-সাত মাইল পায়ে হেটে বড় বোনের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার কথা আজও মনে পড়ে। আগের দিনে বর্ষার সময় নৌকা বোঝাই করে ইফতারি নিয়ে যাওয়া হতো। আগের দিনে বোনদের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার সময় ছোট ভাই-বোন-রা যেত এবং আসার সময় দুলাভাই তাদের গিফট হিসেবে টাকা-পয়সা, এবং জামা-কাপড় দিতেন। সিলেটে মেয়ের বিয়েতে একজন উকিল বাবা থাকেন, সেই উকিল বাবাও মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার রেওয়াজ আজও আছে। সময়ের সাথে সাথে এখন ইফতারি দেওয়ার ধরনও অনেকটা বদলে গেছে!
সিলেটের ইফতার সামগ্রী অনান্য অঞ্চলের তুলনায় একটু ভিন্ন। সিলেটের ইফতারির আইটেম অনেকটাই ট্রাডিশনাল। আখনি হলো সিলেটের ইফতারের প্রধান ঐতিহ্য। আখনি কিংবা খিচুড়ি ছাড়া ইফতারের কথা চিন্তাই করা যায় না। সিলেটে ভুনা খিচুড়ি বা পাতলা খিচুড়ি দু’টিই খুবই প্রসিদ্ধ। আখনি অনেকটা তেহারীর স্টাইলে রান্না করা হয়।
আখনি, খিচুড়ির সঙ্গে জিলাপি, ছোলা, পিঁয়াজু এবং মিষ্টান্নতো আছেই। মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে সিলেটের স্পেশাল হচ্ছে আমিত্তি এবং খাজা। আরেকটি পপুলার আইটেম হল বাখরখানি। রমজান মাসে সিলেটে বাখরখানি খুবই জনপ্রিয়। ইফতারের সময় কিংবা রাতে চায়ের সঙ্গে বাখরখানি খাওয়ার প্রচলন আবহমানকাল
ধরে চলে আসছে।
রমজান হল রহমত-বরকতের মাস, সিয়াম-সাধনার মাস। রমজান মাসে কাউকে ইফতার খাওয়ানো অনেক বড় একটি ছওয়াবের কাজ। মেয়ের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনরা উনাদের সামর্থ্য অনুযায়ী হাসিমুখে যদি মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে ইফতারি দেন তাতে দোষের কিছু নেই। নিঃসন্দেহে, এটি একটি ভালো কাজ। ইফতারি দেওয়ার মাধ্যমে আত্মীয়তার বন্ধন আরো মজবুত হয়। পারস্পরিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় হয়। ভাই-বোনের মধ্যে অনেক দিন পর মিলন ঘটে।
রাসুল (সা.) বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার জন্য রোজাদারের প্রতিদান সমান প্রতিদান দেওয়া হবে এবং রোজাদারের প্রতিদান থেকেও কোনো প্রতিদান কমানো হবে না।’
[তিরমিজি, হাদিস : ৮০৭]
‘তবে এখন আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ইফতারি নিয়ে নানা ধরনের অপসংস্কৃতি চলছে। বিশেষ করে সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে মেয়ের শশুর বাড়িতে প্রথম রমজানে, দশ রমজানের পরে এবং শেষ রমজানের আগে ইফতার প্রদানের প্রচলন রয়েছে। এর কোনো যৌক্তিকতা ইসলামে ধর্মে নেই। চাহিদামতো ইফতার সামগ্রী না পেলে কিংবা দেরীতে ইফতারি গেলে মেয়েকে কটু কথা বা গালমন্দ শুনতে হয়। যা ইসলাম ধর্ম কোনোভাবেই সমর্থন করে না। চরম দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে মুসলিম সমাজ ব্যবস্থায় রমজান মাসে মেয়ের শশুর বাড়িতে ইফতারি প্রদান নিয়ে বর্তমানে যে নিয়ম চলমান রয়েছে তা ইসলামের নামে অপসংস্কৃতি ছাড়া আর কিছু নয়। এই প্রথায় ধনী পিতা কর্তৃক নিজের আদরের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা মনে হলেও মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা-ভাইয়ের জন্য নানা সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে ইফতারি নিয়ে অনেকটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, কে কত বেশি দিতে পারে! অনেক পরিবার বিশেষ করে বিত্তবানদের কাছে মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে ইফতারি দেওয়ার প্রথা ঐতিহ্য মনে হলেও অনেক মধ্যবিত্ত এবং গরীব পরিবার খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়।
সিলেটে যৌথ পরিবারের সংখ্যা বেশি। রমজান মাস আসলেই যৌথ পরিবারের বউরা বেশি দুশ্চিন্তায় থাকেন। যৌথ পরিবারে যদি তিন বউ থাকেন আর প্রথম দুই বউ-এর বাপের বাড়ির অবস্থা যদি ভালো হয়। তাহলে উনাদের বাপের বাড়ি থেকে বিভিন্ন ধরনের ইফতার সামগ্রী আসে। ইফতারি উপলক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হয়। খুবই ধুমধাম করে ইফতারির আয়োজন করা হয়। পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে ইফতারি বিতরণ করা হয়। ছোট বউ এর বাপের বাড়ির অবস্থা যদি ভালো না হয়। পিতা-মাতা অনেক কষ্ট করে চলেন। সংসার কোনরকম চলে। আর সেজন্য ইফতারি পরিমানে যদি একটু কম আসে বা ইফতারি আসতে একটু দেরী হলে অনেক সময় শ্বাশুরি এবং ননদদের কটু কথা শুনতে হয়। কটু কথা না শুনার জন্য অনেক সময় মেয়ে তার বাবা-মা’কে আগে থেকেই বলে দেয় যে, বেশি করে যেন ইফতারি নিয়ে আসেন। মেয়ের সম্মান রক্ষার্থে, মেয়ের মুখ পরিবারের সবার কাছে যাতে উচু থাকে সেজন্য অনেক গরীব পিতা-মাতা তাদের শেষ সম্বল গরু-ছাগল বিক্রি করে কিংবা কারো কাছ থেকে টাকা ঋণ করে মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে ইফতারি দিয়ে থাকেন। যা ইসলাম কখনও সমর্থন করে না। অনেক সময় শ্বাশুড়িদের মুখে শুনা যায় “কিতা-গো তোমার বাফর বাড়ি থাকি দেকি আবো ইফতারি আইলো না” (তোমার বাবা-মা এখনোও ইফতারি পাঠালেন না)। আবার অনেক শ্বাশুড়ি বউকে উদ্দেশ্য করে বলতে শুনা যায়, “ওগো তোমার মা-বাফে দেকি ইবার ইফতারি খম দিলা, আমরা সবর ফুইছেনা।” (তোমার বাবা-মা এইবার খুবই কম ইফতার দিলেন, যা সবার জন্য পর্যাপ্ত ছিল না)। এটা একধরনের মানসিক অত্যাচার, ও জুলুম।
সামর্থ্য অনুযায়ী খুশি মনে মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে ইফতারি দিতে ইসলাম কখনো বাধা দেয়না। ইসলামের দৃষ্টিতে ইফতারি দেওয়াটা অত্যাবশ্যকীয় নয়। আমরা এটাকে বাধ্যতামূলক বানিয়ে ফেলেছি, যা এক ধরনের জুলুম!
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘দুটি পাপের শাস্তি আল্লাহ তাআলা আখিরাতের পাশাপাশি দুনিয়ায়ও দিয়ে থাকেন। তা হলো, জুলুম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার শাস্তি।’ [তিরমিজি : ২৫১১]
খুবই দুঃখজনক হলেও সত্যি যে অনেক পিতা-মাতার সামর্থ্য না থাকায় মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে
বাড়িতে ইফতারি দিতে অপারগতা, দেরীতে ইফতারি পাঠানো, কিংবা ইফতারি পরিমানে কম দেওয়া, এগুলো নিয়ে অনেক মেয়েকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়! এমনকি মৃত্যু পর্যন্তও ঘটে!
২০২১ সালে ০৮ মে শনিবার সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার উসমানপুর ইউনিয়নে রমজান মাসে ইফতার সামগ্রীতে স্বামীর জন্য পৃথক থালা সাজানো না থাকা এবং ঈদুল ফিতরে নতুন জামা-কাপড় না দেওয়ায় স্বামী ও শাশুড়ির নির্যাতনে সাত মাসের অন্তঃসত্তা শরিফা বেগমের (২০) মৃত্যু হয়।
আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল ২০১৯ সালে ১১ মে, ইফতারি নিয়ে শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার জের ধরে সিলেটের জৈন্তাপুরে এক নববধূ আত্মহত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিল। সিলিং ফ্যানের সাথে রশি দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেন নববধূ হেলেনা বেগম (২০)।
যে ঐতিহ্যের কারণে অনেক মা-বাবা রমজান মাস আসলেই দুশ্চিন্তায় থাকতে হয। অনেক বাবা মেয়ের বাড়িতে ইফতারি দেয়ার জন্য শেষ সম্বল গরু-ছাগল বিক্রি করতে হয়, অন্যের কাছ থেকে টাকা ঋণ করতে হয়। রমজান মাসে অনেক মা-বোনের চেহারা মলিন হয়ে যায়। অনেকে নিরভে নিভৃতে চোখের জল ফেলেন! যে প্রথার কারণে অনেকের সুন্দর সংসার ভেংগে তছনছ হয়ে যায়। যে ঐতিহ্যের কারণে হেলেনার মত মেয়েকে আত্মহত্যা করতে হয়। এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু খুবই দুঃখজনক!
কিছু কিছু লোভী জামাই, ননদ এবং স্বার্থন্বেষী শ্বাশুড়িরদের কারণে সিলেটের শত বছরের প্রাচিন ঐতিহ্য “পুড়ির বাড়ি ইফতারি“ আজ অনেকটা প্রশ্নবিদ্ধ!
সামান্য একটু ইফতারির জন্য আপনি আপনার স্ত্রীকে অপমান করেন। কাংগালের মত বসে থাকেন একটু ইফতারী খাওয়ার জন্য। ইফতারি পরিমাণে একটু কম হলে বা ইফতারি দিতে একটু দেরী হলে আপনি, আপনার বোন, আপনার মা স্ত্রীকে কটু কথা বলেন, অপমান করেন, অপদস্ত করে, অত্যাচার করেন! আপনি সবার কাছে প্রশংসা কুড়াতে চান, সম্মান নিয়ে থাকতে চান। আপনার স্ত্রীকেও সম্মান করা এবং সবার সামনে স্ত্রীর সম্মান যাতে ক্ষুন্ন না হয় সেটা দেখার দায়িত্বও আপনার।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন -‘আর তোমরা তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। আর যদি তাকে তোমার অপছন্দও হয়, তবু তুমি যা অপছন্দ করছ আল্লাহ তাতে সীমাহীন কল্যাণ দিয়ে দেবেন।’ [সুরা : নিসা, আয়াত : ১৯]
যদি দেখেন শ্বশুর-বাড়ির অবস্থা ভালো না। উনারা কষ্ট করে সংসার চালাচ্ছেন। সামান্য আয়ে কোন রকম সংসার চলছে। পরিষ্কারভাবে বলে দিন যে- কোন ইফতারি লাগবে না। আর এই কাজটা করতে হবে আমাদের মত জামাইদের-কে। প্রয়োজনে আপনি আপনার মা, বাবা, বোনকে বুঝিয়ে বলুন। না বলতে শিখুন। একজন বাবা-মা অনেক কষ্টে লালন-পালন করে ছোট থেকে বড় করে কলিজার টুকরা মেয়েটাকে আপনার কাছে সপর্দ করল। আপনি আর কি চান? সামর্থ্য থাকলে বাজার থেকে দামী ইফতার সামগ্রী কিনে শ্বশুর- বাড়ি দিয়ে আসুন। তাতে অনেক ছওয়াব হবে। মনে রাখবেন, “জামাই” বাবু আপনিও একদিন মেয়ের বাবা হবেন আর “ননদ” আপনিও একদিন মেয়ের মা হবেন! আর শাশুড়ি আপনারওতো হয়তোবা মেয়ে আছে!
“পুড়ির বাড়ি ইফতারি” অর্থাৎ মেয়ের শ্বশুর-বাড়িতে ইফতারি এটা সিলেটের শত বছরের ঐতিহ্য। এই ইফতারি দেওয়ার রীতি-নীতি আবহমানকাল ধরে চলে আসছে। এই ঐতিহ্যকে ধারণ এবং লালন করতে গিয়ে যেন কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে, ইফতারি নিয়ে যেন কোন বোন-কে আর কটু কথা শুনতে না হয়, কোন গালি শুনতে না হয়, কোন বাবা কিংবা ভাই-কে যেন গরু বা ছাগল বিক্রি করতে না হয়, টাকা যেন ঋণ করতে না হয়, কোন বোন-কে যেন আর আত্মহত্যা করতে না হয়, সেজন্যে আমাদের সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আর এজন্য আমাদের জামাইদেরকে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। এই ফেতনার যুগে আল্লাহ আমাদের সবাইকে যেন সঠিকভাবে বুঝার তৌফিক দান করেন।