সিলেটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে নিহত ৬
রক্তাক্ত সিলেটের গোলাপগঞ্জ। দফায় দফায় সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হয়েছেন ৬ জন। গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন কমপক্ষে দু’শতাধিক। সিলেট নগর জুড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। এতে কমপক্ষে শতাধিক আহত হয়েছেন। এ অবস্থায় সিলেট জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। গোলাপগঞ্জে সংঘর্ষ শুরু ঢাকা দক্ষিণ বাজার থেকে। বেলা দুইটায় ওই এলাকা থেকে হাজারো শিক্ষার্থী ও জনতা বিক্ষোভ বের করে। স্থানীয় লোকজনও বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় বিজিবি’র একটি গাড়ি ওই এলাকায় গেলে সেটিতে হামলা চালায় বিক্ষোভকারী জনতা।
খবর পেয়ে সেখানে পুলিশ ছুটে যায়। তারা টিয়ারশেল, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষ শুরু হয়। ঢাকা দক্ষিণে কয়েক দফা সংঘর্ষে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। একপর্যায়ে পুলিশ ও বিজিবি’র সদস্যরা পিছু হটে স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে আসে। সেখানে দু’পুলিশ সদস্যের উপর হামলা করা হয়। এ সময় পুলিশের মোটরসাইকেলে আগুন দেয়া হয়। এ ঘটনার পর পুলিশ কয়েকশ’ রাউন্ড টিয়ারশেল, গুলি ও সাউণ্ড গ্রেনেড ছোড়ে। কয়েক দফা সংঘর্ষের সময় পুলিশ ওই এলাকায় নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এতে কমপক্ষে ওই এলাকায় অর্ধশতাধিক লোক গুলিবিদ্ধ হন। ধারাবহর গ্রামের মো. মকবুল আলীর ছেলে ব্যবসায়ী তাজউদ্দিন ও শিলঘাটের বাসিন্দা সানি আহমদ গুলিবিদ্ধ হলে তাদের স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা তাদের মৃত ঘোষণা করেন। গোলাপগঞ্জ স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুদর্শন সেন ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেছেন, আরও প্রায় ৫০ জন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। ঢাকা দক্ষিণে পুলিশ ও বিজিবির সঙ্গে সংঘর্ষের সময় স্থানীয় নিশ্চিন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ী নাজমুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এছাড়া গৌছ উদ্দিন ও মিনহাজ নিহত হন। সব মিলিয়ে গোলাপগঞ্জে ৫ জন মারা যান। রাতে আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে। ইকবাল নামে আরও একজনের অবস্থা গুরুতর। এদিকে- ঘটনার পর গোলাপগঞ্জ শহর বিক্ষোভকারীরা দখলে নেয়। এ সময় তারা লাশ নিয়ে পৌর শহর ও আশপাশ এলাকায় বিক্ষোভ করে। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে পৌর শহরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সময় কয়েকশ’ রাউন্ড গুলি ও টিয়ারশেল এবং সাউণ্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি আবুল কাহের শামীম ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এমরান আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, পুলিশ নির্বিচারে সাধারণ মানুষের উপর গুলি চালিয়েছে। এতে কয়েকশ’ আহত হয়েছেন। এদিকে, সিলেট নগরে গতকাল দিনভর দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। বন্দরবাজারের কোর্ট পয়েন্ট, করিমউল্লাহ মার্কেটের পেছনের গলি, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, বারুদখানা, জেলরোড, সুবহানীঘাট, উপশহর এলাকায় দফায় দফায় পুলিশ, ছাত্রলীগ ও বিক্ষোভকারী জনতার দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে বিক্ষোভকারী জনতা মেন্দিবাগে থাকা নির্বাচন অফিসের সামনে আগুন দেয়। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে পুলিশ গিয়ে ওই এলাকায় টিয়ারশেল, গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসার কারণে নির্বাচন অফিসের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন নির্বাচনী কর্মকর্তারা। পরে মেন্দিবাগের গ্যাস অফিসের সামনেও পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়।
সিলেট নগরে ঘটনার শুরু কোর্ট পয়েন্ট থেকে। শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছিল তারা কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান নেবে। এর প্রেক্ষিতে সকাল ১১টার দিকে শিক্ষার্থীসহ জনতা কোর্ট পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে ওই এলাকায় পুলিশ অ্যাকশনে নামে। টিয়ারশেল, গুলি ও রাবার বুলেট ছুড়ে পুলিশ কোর্ট পয়েন্টে থাকা শিক্ষার্থীদের দখলমুক্ত করতে চায়। এ সময় কোর্ট পয়েন্টে তুমুল সংঘর্ষ হয়। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে কেউ বন্দরবাজার অভিমুখে আবার কেউ জিন্দাবাজার অভিমুখে চলে আসেন। বন্দরবাজার অভিমুখে চলে যাওয়া শিক্ষার্থী জনতাকে ধাওয়া করতে করতে পুলিশ করিমউল্লাহ মার্কেটের পেছন পর্যন্ত চলে আসে। ওখানে কয়েক দফা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই এলাকায় পুলিশের টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডে গুরুতর আহত হন জেলা যুবদলের সিনিয়র নেতা লিটন আহমদসহ কয়েকজন। লিটন জানিয়েছেন, পুলিশের গুলিতে ওখানে ১০-১২ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। একজনের মাথার খুলি উড়ে গেছে। কোর্ট পয়েন্টে সংঘর্ষের সময় ৮ম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়।
পুলিশ ওখান থেকে কয়েকজন আটক করে নিয়ে গেছে। পরে নগরের জিন্দাবাজার এলাকায় অবস্থান নেয়া বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এ সময় কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা নগরের নয়াসড়ক এলাকা দিয়ে চলে যায়। এ ঘটনার পর দিনভর জিন্দাবাজার এলাকায় ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল। বিকাল ৪টার দিকে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা নয়াসড়ক এলাকায় অবস্থানের সময় মোটরসাইকেলে আসা ছাত্রলীগের দু’কর্মীকে মারধর করে। এ সময় তাদের মোটরসাইকেলে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একই সময় নগরের উপশহরের রোজভিউ’র সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় শিক্ষার্থী ও জনতা সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সন্ধ্যার একটু আগে নগরের কুমারপাড়া এলাকায় কুমারপাড়া আবাসিক এলাকায় যুবলীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারী জনতার কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। এ সময় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এলাকাবাসীর সাহায্য কামনা করেন বিক্ষোভকারী জনতা। কুমারপাড়া পয়েন্ট এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। আওয়ামী লীগের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, চলমান সহিংসতা ও নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করেছে সিলেটের আওয়ামী লীগ।
নগরীর বিভিন্ন পয়েন্ট দখল করে জামায়াত-বিএনপিকে প্রতিহত করে। বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। এর আগে ‘একদফা দাবিতে’ সকাল ১১টা থেকে কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা তাদের ফাঁকা গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। এ সময় আন্দোলনকারীদের হামলায় একাত্তর টিভির সিলেট প্রতিনিধি সুজাত, ক্যামেরাপার্সন তারেক আহমদ আহত হয় এবং পুলিশের ছিটাগুলিতে আহত হন চ্যানেল এস’র সিলেট প্রতিনিধি মঈন উদ্দিন মঞ্জু। বন্দরবাজার কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানাসহ নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থান নিয়ে নেয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাঁতী লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দের সরব উপস্থিতি ছিল। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, সিলেটে সংঘর্ষকালে ৫ জন পুলিশ গুরুতর আহত হয়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। জেলা পুলিশ জানায়, গোলাপগঞ্জেও কয়েকজন পুলিশ গুরুতর আহত হন। এ ছাড়া বিজিবি ও পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর ছাড়াও জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে বলে জানিয়েছেন জেলা পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তারা।
এমপি হাবিবের কার্যালয়ে হামলা: নগরীর স্টেশন রোডে সিলেট-৩ আসনের এমপি হাবিবুর রহমান হাবিবের অফিসে হামলা ভাঙচুর করেছে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনতা। সকালে আওয়ামী লীগের নেতারা ওই এলাকায় শোডাউন দেন। দুপুরের দিকে তারা চলে গেলে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনতা এসে ওই এলাকা দখলে নেয়। এ সময় তারা এমপি হাবিবের কার্যালয়ে হামলা ছাড়াও ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ গিয়ে টিয়ারশেল, লাঠিচার্জ চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।