স্যার মো ফারাহকে ছোটবেলায় যুক্তরাজ্যে পাচার করা হয়েছিল
বাংলা সংলাপ রিপোর্টঃ চার বারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন স্যার মো ফারাহ। লুকানো বোমার মতো অনেক অজানা তথ্যের বিস্ফোরণ ঘটালেন নিজেই। বললেন, মো ফারাহ তার আসল নাম নয়। শিশু অবস্থায় অন্যায়ভাবে তাকে বৃটেনে নিয়ে আসা হয়েছে। এ জন্য হৃদয়ে অনেক ক্ষত, অনেক বেদনাকে ধারণ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র ‘ দ্য রিয়েল মো ফারাহ’তে জীবনের এসব ক্ষতের সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনি। প্রামাণ্যচিত্রটি আগামীকাল প্রচার হওয়ার কথা রয়েছে। এতে সবার সামনে তিনি প্রথমবার স্বীকার করেছেন মো ফারাহ তার আসল নাম নয়। তার আসল নাম হুসেইন আবদি কাহিন। অন্য একটি শিশু মোহাম্মদ ফারাহ’র নামে তিনি বৃটেনে প্রবেশ করেছেন।
আরও বলেছেন, আপনারা আমাকে যেভাবে চেনেন, আমি আসলে সে নই। এই স্বীকারোক্তির জন্য আমাকে যত মূল্য দিতে হয় তা দেবো। তবু বাস্তব কাহিনী জানিয়ে যাব সবাইকে।
মো ফারাহ চার সন্তানের পিতা। বয়স ৩৯ বছর। বলেছেন, বেশির ভাগ মানুষ আমাকে মো ফারাহ হিসেবে জানেন। কিন্তু এটা আমার নাম নয়। এটা বাস্তবতা নয়। আসল কাহিনী এটাই যে, আমি হুসেইন আবদি কাহিন নাম নিয়ে জন্মেছি সোমালিয়ার উত্তরে সোমালিল্যান্ডে। অতীতে আমি বলেছি, আমার পিতামাতা কখনো বৃটেনে বসবাস করেননি। তা সত্তে¡ও যখন আমার পিতাকে গৃহযুদ্ধে হত্যা করা হলো তখন আমার বয়স মাত্র চার বছর। আপনি জানবেন, এ অবস্থায় একটি পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। আরেকটি শিশু মোহাম্মদ ফারাহ নামে আমাকে বৃটেনে আনা হলো।
চারবার অলিম্পিক বিজয়ী হিসেবে তিনি স্বর্ণপদক পাওয়ার কারণে বৃটেন তাকে স্যার উপাধিতে ভূষিত করে। অলিম্পিকে চারটি স্বর্ণপদক বিজয়ী হিসেবে তিনিই প্রথম বৃটিশ। তিনি বলেছেন, তার সন্তানরা তাকে তার অতীতের সত্য প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করেছে। মো ফারাহ বলেন, আমার কাছে পরিবার মানে সব কিছু। আপনি জানেন পিতামাতা হিসেবে সব সময় আপনার সন্তানকে সততা শিক্ষা দিচ্ছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আমার ভিতর সব সময় ওই প্রাইভেট বিষয়টি থেকে গেছে, যা আসলে বর্তমানের আমি নই। আমাকে বলতে হবে, প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছিল। এই গোপন অধ্যায় দীর্ঘদিন আমি বুকে ধারণ করে চলেছি। এটা বহন করা কত যে কঠিন তা বোঝানো কঠিন। বিশেষ করে আমার সন্তানরা আমাকে মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করে- বাবা, কিভাবে এটা ঘটেছে? এক্ষেত্রে সব সময় আপনাকে উত্তর দিতে হয়, সবকিছুর। কিন্তু এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর তো আপনার মধ্যে তখন থাকে না। এ জন্যই আমি আমার সব কাহিনী প্রকাশ করে দিচ্ছি। কারণ, আমি স্বাভাবিক হতে চাই। এমন একজন মানুষ হতে চাই না, যার একার কাছেই সবটা রক্ষিত থাকবে।
স্যার মো ফারাহ’র স্ত্রী তানিয়া নেল। তিনি বলেছেন, ২০১০ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। তার ভাষায়, এ বছর আমার মনে হয়েছে তার (মো ফারাহ) সত্যিকার কাহিনীর প্রচুর অংশ অন্ধকারে আছে। এ জন্য আমি তাকে বার বার প্রশ্ন করেছি। জবাবে সে আমাকে সত্য কথা বলেছে।
বিবিসির ওপর প্রামাণ্যচিত্রে স্যার মো ফারাহ বলেছেন, শুরুতে যখন তাকে ইউরোপে নিয়ে আসা হয়, তখন তিনি ভেবেছিলেন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে বসবাসের জন্য তাকে সেখানে নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনি স্মরণ করেন, যখন তার বয়স ৯ বছর তখন বৃটেনে এক পাসপোর্ট চেকের অধীনে পড়তে হয়েছিল। সেখানে তাকে দেখানো হয় মোহাম্মদ নামে। মো ফারাহ বলেন, এই নামে আমার আত্মীয়দের সবার সঙ্গে সব রকম যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য ছিল। একবার যখন তার বাসায় পৌঁছলাম, তখন ওই বাসার ভদ্রমহিলা আমার পাসপোর্ট নিয়ে নিলেন। আমার সামনেই তা টেনে টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললেন। তারপর তা ছুড়ে ফেললেন ডাস্টবিনে। তখনই বুঝতে পারলাম, আমি বড় এক সমস্যায় পড়েছি।
মো ফারাহ আরও বলছেন, তিনি এক সময় হাউনস্নোতে নিজের শৈশবের বাড়ি সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে তার সঙ্গে পরিবারের একজন হিসেবে আচরণ করা হয়নি। স্যার মো ফারাহ তার শারীরিক প্রশিক্ষণ বিষয়ক শিক্ষক অ্যালান ওয়াটকিনসনকে একবার এই সত্য কথা বলেছিলেন। বসবাস করা শুরু করেন তার এক বন্ধুর মান কিনসি’র সঙ্গে। তিনি মো ফারাহর যথেষ্ট যত্ন নিতেন। ওই পরিবারে সাত বছর অবস্থানের পর বেরিয়ে আসেন তিনি। স্যার মো ফারাহর বৃটিশ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন অ্যালান ওয়াটকিনসন। এই প্রক্রিয়াকে দীর্ঘ এক প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেন তিনি। অবশেশে ২০০০ সালের ২৫ শে জলাই মো ফারাহ বৃটেনের একজন নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি পান।
নিজের প্রকৃত নাম ব্যবহার করে ছেলের নাম রেখেছেন হুসেইন। বলেছেন, আমি সব সময় সেই মোহাম্মদ ফারাহ নামের শিশুটির কথা ভাবি, যার নাম ব্যবহার করে বিমানে আমি আসন নিয়েছিলাম। আশা করি সেই প্রকৃত মোহাম্মদ ফারাহ সুস্থ আছেন। ভাল আছেন। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, আমি তার নামকে বয়ে বেড়াবো। এতে হয়তো এখন আমার ও আমার পরিবারের জন্য সমস্যা হতে পারে।