হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে দিল্লি

Spread the love

বশীর আহমেদ: পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে দিল্লি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক কূটনৈতিক সূত্র এই বিষয়টি আমার দেশকে নিশ্চিত করেছে। তিব্বতের ধর্মীয় গুরু দালাইলামাকে যে ধরনের স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনাকেও সেই ধরনেরই স্টাটাস দেওয়া হয়েছে বলে জানান ওই সূত্রগুলো।

তবে শেখ হাসিনার ইস্যুটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর অর্থাৎ তিনি গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তি হওয়ায় তার ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা অবলম্বন করছে মোদি প্রশাসন। সাউথ ব্লক বা ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করা থেকে একেবারেই বিরত রয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এতটুকুই বলা হয়েছে যে, শেখ হাসিনা ভারতে আছেন এবং ভারতে থাকবেন। যদিও তারা একেবারে শুরুতে বলেছিল দিল্লি শেখ হাসিনার শেষ গন্তব্য নয়।

শেখ হাসিনাকে দিল্লির রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বাংলাদেশের সাবেক একজন পররাষ্ট্র সচিব আমার দেশকে বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেকটা বাধ্য হয়েই ভারত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে।

তিনি বলেন, শুরুতে ভারত চেয়েছিল ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে শেখ হাসিনাকে স্থায়ী করতে। তবে সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এরই মাঝে বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনার পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়। পাসপোর্ট বাতিল হওয়ায় শেখ হাসিনা কার্যত রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েন। ওই সময়েই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তে আসে। ভারত সরকার শেখ হাসিনার জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্টসও ইস্যু করেছে। এই ট্রাভেল ডকুমেন্টস অনেকটা পাসপোর্টের মতোই কার্যকর। কিন্তু এটা পাসপোর্ট নয়।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনার জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্টস ইস্যু করা তার রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের একটি বড় ইঙ্গিত।

শেখ হাসিনার দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ধরন সম্পর্কে সাবেক ওই শীর্ষ কূটনীতিক বলেন, তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামাকে যে ধরনের স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনার জন্যও তেমনটি করা হয়েছে বলে আমার ধারণা। এটা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ১৯৫৯ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু দালাইলামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পার্লামেন্টে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এটা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক নয়। দালাইলামাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে কমিউনিস্ট পার্টির কিছু নেতা তখন বিরোধিতা করেছিলেন।

তিনি বলেন, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কোনো ধরনের মতভেদ নেই। শেখ হাসিনাকে ভারতের একজন পরীক্ষিত মিত্র হিসেবেই বিবেচনা করে ভারতের সব রাজনৈতিক দল।

শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান এবং তার স্ট্যাটাস নিয়ে কঠোর গোপনীয়তা এবং নীরবতা বজায় রেখে চলেছে মোদি প্রশাসন। বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি সাউথ ব্লকের কোনো কর্মকর্তা। গত ১০ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি তার বাংলাদেশ সফর নিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রবিষয়ক সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির সদস্যদের। ওই ব্রিফিংয়ে অন্তত ৯ জন সদস্য শেখ হাসিনার স্ট্যাটাস সম্পর্কে জানতে চান। এখানেও কোনো উত্তর মেলেনি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি নীরবই ছিলেন, যা রীতিমতো নজিরবিহীন।

শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি ভারত কেন এতটা কঠোর গোপনীয়তায় রেখেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কূটনীতিক, যিনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন।

তিনি আমার দেশকে বলেন, আমরা সবাই জানি শেখ হাসিনা ভারতে কীভাবে আছেন। তিনি সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। অতীতেও তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়েই দিল্লি ছিলেন। কিন্তু ভারতের পক্ষে এখন বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শেখ হাসিনা ইস্যুটি এই মুহূর্তে ভারতের জন্য অত্যন্ত জটিল এবং স্পর্শকাতর।

শেখ হাসিনা এখন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত একজন আসামি উল্লেখ করে তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশই তাকে আশ্রয় দেবে না। ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে। এখন ভারত যদি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টি প্রকাশ্যে স্বীকার করে তাহলে ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়তে হবে তাদের। এছাড়া ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে তা আরও বেড়ে যাবে এবং বাংলাদেশের ভারতবিরোধী জনমত আরও তীব্র হবে। এসব বিষয় বিবেচনায় শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই ভারত চুপ থাকবে। আমরাও এক্ষেত্রে কোনো ধরনের চাপ দেব না।

দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়ুক তা চান না মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে এই মুহূর্তে ঠিক মাথা ঘামাতে চাইছে না ঢাকা।

পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দীনের কাছে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি আমার দেশকে বলেন, শেখ হাসিনা এখন দিল্লিতে আছেন এটাই আমরা জানি। তিনি সেখানে বসে যা যা করছেন তা আমরা পছন্দ করছি না এটাই শেখ হাসিনা সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য।

দিল্লির কূটনৈতিক বিশ্লেষকরাও বিষয়টিকে একটু আড়ালেই রাখতে চাইছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস এ ব্যাপারে বিবিসিকে বলেন, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক আশ্রয়ে নাকি অতিথি হিসেবে ভারতে আছেন সেটা বড় বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো শেখ হাসিনাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে ভারতে রাখা হচ্ছে কিনা। তিনি বলেন, ইংরেজিতে একটি কথা আছে- অ্যা রোজ ইজ অ্যা রোজ : অর্থাৎ গোলাপকে যে নামেই ডাক, সে গোলাপই থাকে। ঠিক তেমনি, শেখ হাসিনা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান বা অতিথি হিসেবে থাকুন তাতে তেমন কিছু যায় আসে না। তিনি ভারতের চোখে শেখ হাসিনাই থাকবেন।

উল্লেখ্য, গত ১৫ বছর ধরে ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনে সীমাহীন দুঃশাসন চালিয়ে অবশেষে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে উৎখাত হয়ে শেখ হাসিনা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যান ভারতে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে তিনি ওই দিন সন্ধ্যায় দিল্লির কাছে গজিয়াবাদের হিল্ডন বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছান। সেখানে তাকে স্বাগত জানান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। ভারতীয় বিমানবাহিনীর ওখানকার একটি মেসে ২/৩ দিন রাখার পর শেখ হাসিনাকে নিয়ে যাওয়া হয় কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনীর অজ্ঞাত এক সেফ হাউজে। সেখানেই তিনি এখন পর্যন্ত অবস্থান করছেন।

৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ভারতের জাতীয় সংসদে জানান, শেখ হাসিনার জন্য ভারত শেষ গন্তব্য নয়। খুব কম সময়ের নোটিশে শেখ হাসিনা সাময়িকভাবে আসার অনুমতি চান। ওই দিনই খবর আসে শেখ হাসিনার মার্কিন ভিসা বাতিল করা হয়েছে। মিডিয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই খবর। ২২ আগস্ট ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করে দেয়। পাসপোর্ট বাতিলের পর শেখ হাসিনা একপ্রকার রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়েন। এরপর ১১ অক্টোবর খবর প্রকাশিত হয় যে, ভারত সরকার শেখ হাসিনার জন্য ট্রাভেল ডকুমন্টেস ইসু করেছে। ওই সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যই প্রকাশ করেনি মোদি প্রশাসন। ১৭ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানান, শেখ হাসিনা এখন দিল্লিতে আছেন এবং দিল্লিতেই থাকবেন। এরপর ২৩ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। উল্লেখ্য, জুলাই বিপ্লবে প্রায় ২ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহতদের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। এই হত্যাযজ্ঞের মূল নির্দেশদাতা শেখ হাসিনা নিজেই।

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ায় পশ্চিমা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসিকে বলেন, শেখ হাসিনার জন্য পশ্চিমা কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া একেবারে দুরূহ। হাসিনার শাসনামলে বিশেষ করে ছাত্র-বিক্ষোভের সময়ে যা ঘটেছে তা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো খুবই মর্মাহত। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে শক্তি প্রয়োগ করেছে তা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল আপত্তি ছিল। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল বেপরোয়া শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকলেও শেখ হাসিনা সরকারকে কোনোভাবেই নিবৃত্ত করা যায়নি।

এখন শেখ হাসিনাকে দেখভালের দায়িত্ব ভারতেরই এবং ভারত সেই দায়িত্ব নিয়েছে। শেখ হাসিনা দীর্ঘ সময়ের জন্য ভারতেই থাকবেন এটাই এখন সবচেয়ে বড় সত্যি। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা ইসুতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হলেও তাকে আশ্রয় দেওয়া ছাড়া ভারতের সামনে আর কোনো পথ নেই। শেখ হাসিনাকে যদি ভারত এই মুহূর্তে আশ্রয় না দেয় তাহলে ভারতের বন্ধুত্বে আর কেউ কখনো বিশ্বাস করবে না। শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, বাংলাদেশ যখন শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানাবে তখন সেই অনুরোধ উপেক্ষা করা দিল্লির জন্য অনেকটাই সহজ হবে। – সৈজন্যে ঃ আমার দেশ


Spread the love

Leave a Reply