হুথিদের উপর আবারও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিমান হামলা

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্টঃ ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের উপর নতুন করে বিমান হামলা চালিয়েছে দুই মিত্র দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এ নিয়ে গত দেড় মাসে চতুর্থ বারের মতো যৌথ হামলা চালালো দেশ দু’টি।

শনিবারের এই বিমান হামলায় হুথিদের অন্তত ১৮টি স্থাপনা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের সদর দপ্তর পেন্টাগন।

হামলার লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল হুথিদের ব্যবহৃত হেলিকপ্টার, ড্রোন, রাডার, অস্ত্র গুদাম এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং নিউজিল্যান্ড এই হামলাকে সমর্থন দিয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

যুক্তরাজ্য জানিয়েছে, মিত্রদের সাথে মিলে তারা হুথিদের ক্ষমতাকে “আরও অবনমিত করার লক্ষ্য নিয়ে” কাজ করে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন বলেছেন যে, তার দেশ বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌ রুটে জীবন ও বাণিজ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না।

গত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে লোহিত সাগরের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রুটে চলাচলকারী মালবাহী জাহাজে হামলা চালিয়ে আসছে ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা।

মূলত ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলোর পণ্যবাহী জাহাজকে লক্ষ্য করেই হামলা চালাচ্ছে তারা।

হুথিদের এই হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় গত ১১ই জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে যৌথ হামলা চালিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

লোহিত সাগরের নৌ রুট বিশ্বের সবচেয়ে ব্যস্ততম বাণিজ্যিক রুট গুলোর একটি।

কিন্তু হুথিরা হামলা শুরু করার পর বড় কোম্পানি গুলোর অনেকেই ওই রুট থেকে তাদের পণ্যবাহী জাহাজ সরিয়ে নিয়েছে।

ফলে সারা বিশ্বেই পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে৷

একটি যৌথ বিবৃতিতে পেন্টাগন বলেছে যে, শনিবার ইয়েমেনের আটটি স্থানে হুথিদের ভূগর্ভস্থ অস্ত্র গুদাম, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে “জরুরি এবং আনুপাতিকভাবে হামলা” চালানো হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌ রুটে চলাচলকারী বাণিজ্যিক নৌযান এবং নিরীহ নাবিকদের জীবনকে যারা হুমকির মুখে ফেলছে, সেই হুথিদের ক্ষমতাকে অবনমিত করার লক্ষ্যে তাদের ব্যবহার অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে ধ্বংস করতেই নির্ভুলভাবে হামলা চালানো হয়েছে।”

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, “নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে এখন পর্যন্ত হুথিরা ৪৫টিরও বেশি পণ্যবাহী জাহাজ ও অন্যান্য নৌযানে হামলা চালিয়েছে।”

“এতে বিশ্ব অর্থনীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়েছে। কাজেই এটি আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার দাবি রাখে।”

আর সেজন্যই অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, কানাডা, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস এবং নিউজিল্যান্ডের সমর্থনে হুথিদের উপর এই বিমান হামলা চালানো হয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই বিবৃতি প্রকাশের কিছুক্ষণ পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন জোর দিয়ে বলেছেন যে, আমেরিকা “বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নৌ রুটে জীবন ও বাণিজ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না।”

অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী গ্রান্ট শ্যাপস বলেছেন, “সমুদ্রে জীবন ও নৌ চলাচলের স্বাধীনতা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য।”

“তাই আমাদের রয়্যাল এয়ার ফোর্স ইয়েমেনে হুথিদের সামরিক লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে নির্ভুলভাবে হামলা চালিয়েছে।”

এর আগে, গত শুক্রবার মার্কিন সেনাবাহিনী জানিয়েছিল যে, তারা হুথিদের সাতটি জাহাজবিধ্বংসী মিসাইল ধ্বংস করেছে।

মিসাইলগুলো হামলা চালানোর উদ্দেশ্যে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল বলেও জানিয়েছিল তারা।

গত সপ্তাহের শুরুর দিকে, ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা যুক্তরাজ্যে নিবন্ধিত একটি পণ্যবাহী জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।

এ ঘটনার পর জাহাজটির নাবিক ও অন্যান্য কর্মীরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে জাহাজ ফেলে রেখে চলে যায়।

হুথিদের নিয়ন্ত্রণেই ইয়েমেনের অধিকাংশ জনবহুল এলাকা
হুথিদের নিয়ন্ত্রণেই ইয়েমেনের অধিকাংশ জনবহুল এলাকা

হুথিরা কেন জাহাজে হামলা করছে?

পেন্টাগন জানিয়েছে যে, গত ১৯শে নভেম্বর থেকে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা দক্ষিণ লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মধ্যে পণ্য পরিবহনকারী জাহাজগুলোতে কমপক্ষে অন্তত ৪৫টি হামলা চালিয়েছে।

হুথিদের দাবি, এই হামলাগুলো তারা করেছে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে।

তারা বলছে যে সমস্ত জাহাজের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক আছে তারা সেসব জাহাজকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে।

কিন্তু সমালোচকরা বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে যেসব জাহাজে তারা হামলা করেছে সেসব অনেকগুলোর সাথে ইসরায়েলের কোন সম্পর্কই নেই।

তারা বলছে হুথিরা আসলে গাজার বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াচ্ছে, নিজেদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করছে এবং ইরানের কাছে প্রমাণ দিচ্ছে যে তারা তাদের কার্যকরী মিত্র হিসেবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

ছোট নৌকায় করে এসে বড় বড় জাহাজে হামলা চালাচ্ছে হুথিরা
ছোট নৌকায় করে এসে বড় বড় জাহাজে হামলা চালাচ্ছে হুথিরা

হুথিদের সামরিক সক্ষমতা কেমন?

লোহিত সাগরে জাহাজে হুথিদের সাম্প্রতিক হামলায় দেখা গিয়েছে তারা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ব্যালিস্টিক মিসাইল, ড্রোন (ইউএভি) ও চালকবিহীন জাহাজ (ইউএসভিস) ব্যবহার করেছে।

এছাড়া শুরুর দিকে হামলায় দেখা যায় হুথিরা ছোট ছোট নৌকা বা হেলিকপ্টার নিয়ে বড় জাহাজে উঠে পড়ছে ও সেটা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।

ইউএভি বা তথাকথিত “কামিকাজে ড্রোন”- যেটা হুথিরা ব্যবহার করছে, ধারণা করা হচ্ছে এগুলো কাসেফ ড্রোন, সেই সাথে আছে অনেক দূর পর্যন্ত হামলায় সক্ষম সামাদস যুদ্ধবিমান – লেজের দিকে যেটায় ভি আকৃতির পাখা থাকে।

এই অস্ত্র হুথিরা ব্যবহার শুরু করে আসছে সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের সংঘাতে।

দ্য ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি বলছে, বিভিন্ন ধরনের জাহাজ বিধ্বংসী ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে হুথিদের, যেগুলো ৮০ কিলোমিটার থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম। এর মধ্যে আছে সায়াদ এবং সেজ্জিল মিসাইল।

এই থিঙ্কট্যাঙ্ক মনে করে হুথি গোষ্ঠীর কাছে এমন জাহাজ বিধ্বংসী ব্যালিস্টিক মিসাইলও আছে যা ৩০০ কিলোমিটার দূর থেকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

এই মিসাইলগুলোর অবস্থান নির্ণয় করাও কঠিন কারণ তারা খুব দ্রুতগতির হয় এবং মূহুর্তের মধ্যে আক্রমণ করতে পারে। তবে এর জন্য দরকার হয় “ড্রোন, অন্য জাহাজ বা অস্ত্রের মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে বিশদ তথ্য।”

সমুদ্র ইতিহাসবিদ সাল মারকোগলিয়ানো বিবিসিকে বলেন, ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ এই দুই ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রই ড্রোনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী, কারণ “তাদের সাথে বড় যুদ্ধাস্ত্র থাকে এবং আরও বেশি গতিশক্তি থাকে।”

মারকোগলিয়ানো বলেন, একমুখী ড্রোনগুলো সংখ্যায় অসংখ্য কারণ এগুলো খুবই সস্তা এবং সহজেই ব্যবহার করা যায়, তবে একটু ধীরগতির।

এই ড্রোনগুলো ঠিক পানির উপর জাহাজের ভেসে থাকা জায়গা বরাবর আঘাত করে এবং তা থেকে আগুন ধরে যাওয়াটা হল সবচেয়ে দুশ্চিন্তার।

তবে মারকোগলিয়ানোর বিশ্বাস ‘সবচেয়ে ভয়ের’ হল ইউএসভিস বা চালকবিহীন জাহাজ, “কারণ এটি পানির উপরে জাহাজে আঘাত করে, যার মাধ্যমে এটি ফুটো হয়ে ভেতরে পানি ঢোকে এবং জাহাজটি ডুবে যায়।”

ইউএস নেভি বলছে চলমান সংঘাতে হুথিরা প্রথম এই চালকবিহীন জাহাজটি বিস্ফোরণ সহকারে ব্যবহার করে গত চৌঠা জানুয়ারি এবং সেটি জাহাজ চলাচলের আন্তর্জাতিক লেনে এসে বিস্ফোরিত হয়।

“সৌভাগ্যক্রমে কোন হতাহত হয়নি বা কোন জাহাজকেও এটি আঘাত করতে পারেনি, কিন্তু এই একমুখি ইউএসভিস ব্যবহারের সূচনাটা চিন্তার কারণ,” বলেন ইউএস নেভি কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল ব্রাড কুপার।

তিনি বলেন, এরকম আক্রমণ তাদের “নতুন সক্ষমতা” সম্পর্কে জানান দেয়।

তবে সৌদি সরকার জানাচ্ছে, হুথিরা এই এইএসভিস প্রথম ব্যবহার হয় ২০১৭ সালে জানুয়ারিতে সৌদি বাহিনীর আল-মদিনার উপর একটা হামলায়, আর এরপর “২০২০ সালে মার্চে এডেন উপসাগর দিয়ে একটা তেলবাহী জাহাজ ইয়েমেন যাওয়ার পথে সেটার উপর হামলার একটা ব্যর্থ চেষ্টা চালায় তারা।”

সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ইরান হুথি বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করছে
সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ইরান হুথি বিদ্রোহীদের অস্ত্র সরবরাহ করছে

হুথিদের পেছনে কারা?

হুথিরা ইরানের দ্বারা সমর্থিত এবং তারা নিজেদের তথাকথিত “এক্সিস অফ রেসিসট্যান্স” বা প্রতিরোধ বলয়ের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে আছে লেবাননের হেজবুল্লাহ, সিরিয়ার আসাদ সরকার, গাজায় হামাস এবং ইরান সমর্থিত অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতিপক্ষ শক্তি।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্য সরকার জানায় তারা জাতিসংঘের কাছে “এমন প্রমাণ উত্থাপন করেছে যা ইরানের সাথে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপর হামলায় হুথিরা যে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ব্যবহার করেছিল তা চোরাচালানের একটা সংযোগ পাওয়া যায়।”

যুক্তরাজ্য সরকার জানিয়েছে, দ্য রয়্যাল নেভি শিপ এইচএমএস মনট্রোজ ২০২২ সালের শুরুর দিকে দুবার ইরানিয়ান অস্ত্র জব্দ করে যা স্পিডবোটে করে দক্ষিণ ইরানের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় চোরাচালানকারীরা বহন করছিলো।

তারা বলছে এসব আটককৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল স্থল থেকে আকাশে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের ইঞ্জিন এবং একটা নজরদারিতে ব্যবহৃত একটি বাণিজ্যিক কোয়াডকপ্টার ড্রোন।


Spread the love

Leave a Reply