হ্যাপির বদলে যাওয়া মেনে নেয়নি পরিবার
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃনাজনীন আক্তার হ্যাপি। বহুল আলোচিত এক নায়িকা। ক্রিকেট তারকা রুবেল হোসেনের সঙ্গে যার প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সর্বত্র। বিষয়টি গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত। ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেছিলেন হ্যাপি। যদিও শেষ পর্যন্ত অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। এসব কিছুর পরও নায়িকা হ্যাপি ব্যস্ত ছিলেন শুটিং, অভিনয় নিয়ে। নায়িকা হওয়া ছিল শৈশবের স্বপ্ন। স্বপ্নের জগতে বিচরণ করেছেন হ্যাপি। একে একে অনেক ফিল্মে কাজ করার প্রস্তাব এসেছে। কাজও করেছেন বেশ কয়েকটি ফিল্মে। কিন্তু স্বপ্নের সেই শোবিজ জগৎ ছেড়ে আমূল বদলে গেছেন হ্যাপি। এ খবর এরই মধ্যে বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে ঠাঁই পেয়েছে পাশ্চাত্যের মিডিয়াতেও। এখন তার নাম আমাতুল্লাহ। বদলে গেছে তার জীবনের চলার পথ। হ্যাপির দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়ে ‘হ্যাপি থেকে আমাতুল্লাহ’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেছে মাকতাবাতুল আযহার। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সাদিকা সুলতানা সাকী ও সম্পাদনা করেছেন আবদুল্লাহ আল ফারুক।
নিজের নাম প্রসঙ্গে হ্যাপি বলেছেন, ‘আমার বর্তমান নাম আমাতুল্লাহ। এ নামের অর্থ হলো আল্লাহর বান্দি। আল্লাহ তাআলা যখন আমাকে বুঝ দিলেন তখন আমার মনে ‘হ্যাপি’ পার্সনটার প্রতি ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে। আসলে হ্যাপি পার্সন না, হ্যাপি যে কাজগুলো করতো তার প্রতি আমার ঘৃণা জন্মাতে লাগলো। আমি বুঝতে পারলাম অন্য কোনো পরিচয় নয়। আমার একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত- আমি আল্লাহর বান্দি।’ আমাতুল্লা নামে ডাকলেই তিনি খুশি হন বলে জানান।
চলচ্চিত্র জগতে নারীর অবস্থান সম্পর্কে কঠোর সমালোচনা করেছেন একসময়ের মডেল ও নায়িকা হ্যাপি। তিনি বলেছেন, ‘মডেল মানেই পণ্য। কারণ, একজন মডেল যখন কোনো বিজ্ঞাপন করে তখন সে তার চেহারা, অঙ্গ ও অভিনয় দিয়ে মানুষকে সেই বস্তুর দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে। এর বিনিময়ে সে টাকা পায়। আমি আমার জীবনে এটাই দেখেছি যে, একজন নায়িকা যখন সিনেমায় অভিনয় করে তখন সে কম হোক, বেশি হোক, অভিনয়ের পারিশ্রমিক পায়। তাকে যেই পারিশ্রমিক দেয়া হয় সেটা প্রযোজক তুলে নেন সিনেমার টিকিট বিক্রির মাধ্যমে। সিনেমা হলে এসে দর্শকরা তার শরীর দেখার বিনিময়ে টাকা দিচ্ছে।… যে মেয়ে নিজেকে যত সুন্দর পণ্য হিসেবে প্রদর্শন করতে পারবে সে তত বেশি টাকা পাবে। আমি চলচ্চিত্রকে সবচেয়ে জঘন্য মনে করি এ কারণে যে তারা মেয়েকে শুধু পণ্য হিসেবেই দেখে।’
পরিবারে ধর্মীয়চর্চা সেভাবে ছিলো না জানিয়ে হ্যাপি বলেছেন, ‘শৈশবে আমার ইসলাম সম্পর্কে ধারণা ছিল খুবই অল্প। আমরা মনে করতাম, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, ভালো কাজ করা- এতটুকুর মাঝেই ইসলাম সীমাবদ্ধ।… প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজপড়া যে ফরজ, পর্দা পালন করা যে ইসলামের আবশ্যিক বিধান- এমনটি আমি আমার পরিবারে কখনও দেখিনি’। হ্যাপি তাতে উল্লেখ করেছেন ছোটবেলা থেকেই তিনি সংস্কৃতিমনা ছিলেন। পরিবারও এ বিষয়ে শতভাগ সহযোগিতা করেছে। বলেন, ‘ছোটকাল থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল নায়িকা হব। আমি সব সময় নিজেকে নায়িকা ভাবতাম।’ এর পরপরই তিনি ‘আসতাগফিরুল্লাহ; উচ্চারণ করে বলেন, ‘টিভিতে গান বাজলেই আমি নাচা শুরু করতাম। এমনকি ঘুমের ভেতরও আমি গান গাইতাম।’
ঢাকার একটি কলেজ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন হ্যাপি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া হয়নি। ভর্তি হয়েছেন মাদরাসায়। হঠাৎ করেই ধর্মের দিকে ধাবিত হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি কখনও দ্বীন শেখার মতো স্পেস পাইনি। আমি যেই পরিবেশে ছিলাম, যে সমাজে বড় হয়েছি, যে পরিবারে বেড়ে উঠেছি সেখানে কোনো দ্বীনদার ছিল না।…আমার আগের ওই জীবটনা এমন ছিল যে, আমি দিনভর শুটিং করতাম, ঘুরাঘুরি করতাম। আর বাসায় ফিরে রাত জেগে জেগে ইউটিউবে ভিডিও দেখতাম।’ এরকম একটি রাতের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি ইসলামি ভিডিও’র লিঙ্ক এলো। কেউ কোনো একটা ভালো কাজ করেছে, তার উপর ভিডিও করে কেউ ছেড়ে দিয়েছে।… আমি যখন ওই ভিডিও দেখছিলাম তখন মনে হলো উপর থেকে কেউ আমাকে ইসলামে আসতে উদ্বুদ্ধ করছে। আমি কৌতূহল নিয়ে ভিডিওটা দেখলাম। তবে সেখানে তেমন কিছু ছিল না। ওই ভিডিওটা দেখার পর আরেকটি ভিডিও’র সাজেশন এলো। ভিডিওটি হলো হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জীবনের ওপর একটি ইরানি চলচ্চিত্র।… ওটা দেখা শুরু করার পর প্রথম থেকেই ভালো লাগতে শুরু করলো। ওটা দেখার পর আমার মনে হলো, সিনেমাটি খুব ভালো লাগছেতো। তখন রাত প্রায় এক দেড়টা বাজে। বাসার সবাই ঘুমিয়ে আছে। আমি একা আমার রুমে সিনেমা দেখছি। ওই সিনেমার ডায়ালগেই কুরআনের আয়াত ব্যবহৃত হয়েছে। কিছু আয়াতের অর্থ এরকম ছিল যে ‘তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে মাফ চাও। তিনি তোমাদের মাফ করবেন।… এরকম কিছু কিছু কথা আমাকে টাচ করতে লাগলো।’ এ প্রসঙ্গে হ্যাপি আরো বলেন, ‘আর ওই সময়টা এমন ছিল যে, আমার জীবনের কিছু বিষয় নিয়ে আমি প্রচণ্ড আপসেট ছিলাম। আমার কাছে মনে হতো জীবনের কোনো মানে নেই। সবকিছু মিলিয়ে মানসিকভাবে দুর্বিষহ অবস্থায় ছিলাম।… আমি যখন ওই ইরানি মুভি দেখলাম তখন সেখানে ব্যবহৃত ডায়লগে কুরআনের এমন কিছু আয়াত শুনলাম যা আমি আগে কখনো শুনিনি। আমার জীবনে কুরআনের আয়াত শোনার এটাই প্রথম ঘটনা। কুরআনের প্রতিটি আয়াত আমার মনের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল।’ তারপর হযরত আদম (আ.) জীবনীর ওপর নির্মিত একটি ও হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনীর ওপর নির্মিত ‘দ্যা মেসেজ’ সিনেমাটি দেখেন তিনি। তিনি বলেন, ‘দেখার পর মনে হলো আমি এখন যেভাবে জীবন যাপন করছি এটা কেমন জীবন? এ মুহূর্তে যদি আমি মারা যাই তা হলে আমার কি হবে? তখন মনে হচ্ছিলো আমার নাক, কান দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছে। আমি প্রচণ্ড অস্থিরতা অনুভব করছিলাম। আমি যে বেপর্দাভাবে ঘুরছি।… এই যে আমি সিনেমা করছি। খারাপ জায়গায় আছি। আমি মরে গেলে এই খারাপ কাজগুলোর জন্যে আমার কী শাস্তি হবে? জীবনে আমি কত রকম গুনাহ করেছি, সেই গুনাহগুলো আমার ভাবনায় চলে এলো। এসব কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এবার আমাকে তওবা করতে হবে।’ তারপর তওবা করলেন হ্যাপি। নামাজ শিক্ষা থেকে কয়েকটা দোয়া মুখস্থ করে নামাজ পড়লেন। অবশ্য সুরা ফাতেহা ও ইখলাস আগেই পারতেন বলে উল্লেখ করেছেন। প্রথম সেজদায় গিয়ে অঝোরে কেঁদেছেন। অনেক শান্তি অনুভব করেছেন বলে জানান তিনি। তখনি সিদ্ধান্ত নেন সিনেমায় কাজ করবেন না। তখন একটি সিনেমার শুটিং চলছিল। ১২টি সিনেমার প্রস্তাব ছিল তার। তখনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন ‘আজ থেকে আমি মিডিয়া ছেড়ে দিয়েছি। এখন থেকে আর সিনেমাতে কাজ করব না।’ এতে নানা সমালোচনার সম্মুখীন হন। ফোন নম্বর পরিবর্তন করেন। সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। কুরআন, হাদিস ও ইসলামি বই পড়তে শুরু করেন। বোরকা পরেন। তালীমে যাওয়া শুরু করেন। তবে মুভি বা ভিডিও দেখে দ্বিন শিক্ষা সঠিক না জানিয়ে তিনি কুরআন, হাদিস পড়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
বদলে যাওয়া প্রসঙ্গে হ্যাপি জানান, অনেকের মতো তার এই বদলে যাওয়া মেনে নেয়নি পরিবার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার আম্মু আমাকে খুব টর্চার শুরু করলেন। বাসার সবাই তখন আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করত যে, আমি যেন এ বাসা থেকে বের হয়ে যাই।… এমনি তারা আমার গায়েও হাত তুলেছে। তারা আমার এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছিল না। …পরিবারের কেউ আমাকে বুঝাতে এলে আমি তাদের বলতাম ‘আল্লাহ তাআলা কী বলেছেন আমি সেটা শুনব। আল্লাহ আমাকে পর্দা করতে বলেছেন, পরপুরুষের সামনে যেতে নিষেধ করেছেন।… আমাকে মেরে ফেললেও আমি সিনেমায় যাব না।’ তারপর থেকে হ্যাপিকে দিয়ে ঘরের ফ্লোর পরিষ্কার থেকে বিভিন্ন কাজ করানো হতো শাস্তি হিসেবে। ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না। তারপর বাসা থেকে বের হয়ে যান হ্যাপি। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য একটি আবাসিক মহিলা মাদরাসায় ভর্তি হন। ক্ষুব্ধ মা-বাবা খোঁজ নেন না। একদিন মাকে দেখার জন্য বাসায় যান। টাকার অভাবে মিরপুর থেকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছেন। মাদরাসার ২৮ দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন হ্যাপি। সেই পোস্ট পড়ে এক যুবক মাদরাসায় গিয়ে শিক্ষকদের মাধ্যমে হ্যাপিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। নিয়মিত তাবলীগে যান। শেষ পর্যন্ত ওই শিক্ষকের সঙ্গে ঘর বেঁধেছেন হ্যাপি। স্বামীর প্রশংসা করে হ্যাপি বলেছেন, ‘তার মুখে আমার অতীতের একটা কথাও আজ পর্যন্ত শুনলাম না। তিনি শুধু তার স্ত্রী আমাতুল্লাহকেই চিনেন…।’ হ্যাপি জানিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত তালিমের মাধ্যমে তার মাও নামাজ ও পর্দা শুরু করেছেন। হ্যাপি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেছেন, ‘আখিরাতের সবগুলো স্তর আমি যেন অনায়াসে পেরোতে পারি, এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।’