১৫ মাসের যুদ্ধ গাজাকে যেভাবে ধ্বংস করেছে
১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে সংঘাত চলছে গাজায়। সহিংসতার অবসানের জন্য ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এই লড়াইয়ে?
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে আক্রমণের পর থেকে এই সংঘাতের শুরু হয়েছিল। হামাসের ওই হামলায় প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
এর প্রতিশোধ নিতে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরায়েল। সেখানে মানবিক সংকট এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।
হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযান চলাকালে ৪৬ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, তারা হামাসের যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে এই হামলা চালিয়েছে এবং বেসামরিক মানুষদের হতাহতের ঘটনা এড়ানোর চেষ্টা করেছে।
ইসরায়েলের অভিযানের জবাবে পাল্টা রকেট হামলাও চালায় হামাস।
বিবিসি ভেরিফাই এই সংঘর্ষের ফলে গাজায় যে ক্ষতি হয়েছে তার পরিমাণ বিশ্লেষণ করেছে।
নিহত-আহত
গাজার স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা ৪৬ হাজার ৭৮৮ জনের মৃত্যুর হিসাব পেয়েছেন। হাসপাতাল এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এই সংখ্যা তৈরি করেছেন তারা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৪ সালের ৭ই অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ সংঘাতের এক বছরে শনাক্ত হওয়া মৃতদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ ছিল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।
তবে নভেম্বরের জাতিসংঘের বিশ্লেষণে নিহতের মধ্যে নারী এবং শিশুর সংখ্যা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরো বলেছে, এক লাখ ১০ হাজার ৪৫৩ জন ফিলিস্তিনি এই সংঘর্ষে আহত হয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তেসরা জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে জানায়, এই আহতদের মধ্যে ২৫ শতাংশের আঘাত এতোটাই গুরুতর যে তাদের জীবন আর আগের অবস্থায় ফিরবে না।
মেডিসান সান ফন্তিয়েখ (এমএসএফ)-এর সমন্বয়ক কারিন হাস্টার বিবিসি ভেরিফাইকে বলেছেন, দীর্ঘ সময় ধরে আহত রোগীদের ঠিকমতো দেখাশোনা করার ক্ষেত্রে গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ‘ভয়াবহ’ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে সম্প্রতি একটি প্রবন্ধে বলা হয়, নিহতের সংখ্যা মন্ত্রণালয়ের হিসাবের চাইতেও উল্লেখযোগ্য হারে বেশি হতে পারে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যখন নিহতের সংখ্যা গণনা করে তখন তারা সাধারণ নাগরিক এবং যোদ্ধাদের আলাদা কোনো হিসাব করে না।
তবে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ দাবি করেছে, তারা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৭ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তারা কীভাবে এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছে তা প্রকাশ করেনি।
অবকাঠামো এবং হাসপাতাল
এই সংঘাতে গাজার অবকাঠামোগত ক্ষতির মাত্রা ব্যাপক। ওপরে জাবালিয়া এলাকার একটি পাড়ার দুই সময়ের ছবি তুলে ধরা হয়েছে।
একটি সংঘর্ষের আগে এবং আরেকটি গত সপ্তাহে তোলা। যেখান থেকে সংঘাতের ভয়াবহতার ধারণা পাওয়া যায়।
সিএনওয়াই গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের অধ্যাপক কোরি শের এবং ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জামন ভ্যান ডেন হোক স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে গাজার ক্ষয়ক্ষতির পরিসর যাচাই করেছেন।
১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতির বিশ্লেষণে তারা অনুমান করেছেন, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গাজার ৫৯ দশমিক আট শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
ইসরায়েল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শহুরে এলাকায় বোমাবর্ষণ করেছে এবং কিছু অবকাঠামোয় একাধিকবার হামলা চালানো হয়েছে।
জাতিসংঘের স্যাটেলাইট সেন্টারের (ইউএনওস্যাট) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডিসেম্বরের শুরুতে গাজার ৬৯ শতাংশ ভবন ও স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেইসাথে গাজার রাস্তাঘাটের ৬৮ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে।
জাতিসংঘ আরো জানিয়েছে যে অনেক হাসপাতাল এবং এর আশেপাশের এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একাধিক উদাহরণ পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘের তথ্যে বলা হয়েছে গাজার ৫০ শতাংশ হাসপাতাল এখন বন্ধ গেছে। বাকি হাসপাতালগুলোয় আংশিকভাবে কাজ চলছে।
যার মানে হলো, হাসপাতালগুলো খোলা আছে ঠিকই কিন্তু তারা দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং জটিল আঘাতের কোনো চিকিৎসা দিতে পারছে না।
ইসরায়েল শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছে যে হামাস হাসপাতাল এবং এর আশেপাশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা না থাকার ব্যাপক সমালোচনা করেছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী চলমান সংঘাতে অন্তত এক হাজার ৬০ জন চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন।
গাজার ছয়টি পাবলিক কমিউনিটি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং একমাত্র ইনপেশেন্ট সাইকিয়াট্রিক হাসপাতালও এখন আর চালু নেই বলে সেভ দ্য চিলড্রেন বিবিসি ভেরিফাইকে জানিয়েছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় দশ লাখ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন যা মোকাবিলা করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
মিসেস হাস্টার বিবিসি ভেরিফাইকে বলেছিলেন যে অনেক বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা এখন দক্ষ কর্মী এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়া চলছে।
শিক্ষার ক্ষয়ক্ষতি
গাজার শিক্ষার খাতেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আইডিএফ জানায়, তারা জুলাই মাসের মাঝামাঝি থেকে হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে ৪৯টি স্কুল ভবনে হামলা চালিয়েছে।
ডিসেম্বরের শুরু থেকে ১৩টি স্থানে এ ধরনের হামলার যাচাইকৃত ফুটেজ পেয়েছে বিবিসি ভ্যারিফাই। এই স্থানগুলো তখন আর স্কুল হিসেবে চালু ছিল না। বরং বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু স্কুল ভবনে হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে তা গাজায় শিক্ষা স্বাভাবিক করতে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।
বিবিসি দেখিয়েছে ইসরায়েল তাদের সামরিক অভিযান শুরুর পর পর কীভাবে শত শত পানির লাইন এবং স্যানিটেশন সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করে দিয়েছে।
অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ অর্থাৎ মানুষের বাড়িঘর থেকে শুরু করে জনসেবা কেন্দ্র পুনরায় নির্মাণ করাই হবে সামনের বছরগুলোয় একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
মে মাসে জাতিসংঘ অনুমান করেছিলো যে গাজা পুনর্গঠনে ৪০ বিলিয়ন বা চার হাজার কোটি ডলার খরচ হতে পারে।
ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তার সমন্বয় অফিস-ওসিএইচএ ধারণা করছে, গাজায় অন্তত ১৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে যা কিনা গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ।
অর্থাৎ এই মানুষেরা গাজায় তাদের বাড়ি ছেড়ে গাজার অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ একাধিকবার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছে।
বিবিসি ভেরিফাই শুরু থেকেই গাজার এই মানুষদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নেয়ার আদেশ নির্দেশগুলো পর্যবেক্ষণ করছে।
গাজার ২৩ লাখ মানুষের প্রায় সবাইকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে হয়েছে, কারণ ইসরায়েল টানা আক্রমণ চালিয়েছে এবং বড় আবাসিক এলাকাগুলো দ্রুত খালি করার নেওয়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছিলো।
সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে অক্টোবর থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত গাজার উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা থেকে মানুষকে সরে যেতে বলা হয়। কারণ ইসরায়েল উত্তর গাজায় বড় আকারে হামলা চালায়।
এমনকি মানবিক অঞ্চল (হিউমেনিটেরিয়ান জোন) যেখানে ফিলিস্তিনিদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যেতে বলেছিল আইডিএফ, সেখানেও তারা বহু বিমান চালায়।
নীচের এই ছবিতে গাজার আল-মাওয়াসির বদলে যাওয়া দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। যেটা কিনা একটি মানবিক অঞ্চল ছিল। ছবিতে গাজায় বাস্তুচ্যুতির প্রভাব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
নিচের ছবিতে যুদ্ধের আগে এবং জানুয়ারির শুরুর সময়কার একই এলাকার অবস্থা দেখানো হয়েছে।
আগে যেখানে খালি কৃষিজমি ছিল, এখন সেখানে হাজার হাজার তাঁবু ও অস্থায়ী কাঠামো দেখা যাচ্ছে।
ত্রাণের অভাব
জাতিসংঘের ধারণা, ৯১ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে আছে।
আইপিসি নামের একটি গ্রুপ যারা সরকার, দাতব্য সংস্থা এবং এজেন্সির সাথে কাজ করে, তারা জানিয়েছে যে – উত্তর গাজায় সাম্প্রতিক অভিযানগুলোর পর সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এই সংকটগুলোর মধ্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো কৃষিজমির ক্ষতি। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো জানিয়েছে যে, গাজার ৬৭ দশমিক ছয় শতাংশ কৃষিজমি গোলাবর্ষণ, যানবাহনের চলাচল ও অন্যান্য সংঘর্ষজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত কয়েক মাসে গাজায় পৌঁছানো ত্রাণ সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হরে কমে গেছে। আগে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় ঢুকত।
কিন্তু ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ত্রাণ আসা কমে গিয়েছে যা এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
ত্রাণ ঢুকলেও অনেক সময় তা সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারে না। ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন, অপরাধী চক্রগুলো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর সময় তা আটকে ফেলে এবং জিনিসপত্র লুট করে। কারণ সেখানে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।
জাতিসংঘের ধারণা, প্রায় ১৯ লাখ মানুষের জরুরি আশ্রয় এবং প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সামগ্রীতে প্রয়োজন।
যুদ্ধবিরতি হয়তো ত্রাণ পৌঁছানো সহজ করবে, কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, গাজা কীভাবে আবার গড়ে তোলা হবে। ১৫ মাসের ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর গাজা পুনর্গঠনে ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।