আমেরিকার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রাজনৈতিক জীবন
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ শুরুটা কঠিনই হয়েছিল জো বাইডেনের জন্য। ফেব্রুয়ারির শীতে আইওয়া ককাসের ভোটের ফলাফল দেখে মুষড়ে পড়েছিলেন। ২০২০-র প্রেসিডেন্ট পদে তার প্রার্থী হবার সম্ভাবনা শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা তা নিয়েই বড় রকম সংশয় দেখা দিয়েছিল।
এক কথায়, গত ফেব্রুয়ারিতেও তিনি ছিলেন হোয়াইট হাউসের দৌড়ে একজন পরাজিত ব্যক্তি।
দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে হোয়াইট হাউসে যাবার যে স্বপ্ন জো বাইডেন বহুদিন থেকে লালন করে আসছেন, তা পূরণ হবার জন্য এটাই ছিল সম্ভবত তার শেষ চেষ্টা।
প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দলের পূর্ব-বাছাই প্রক্রিয়া – যাকে বলা হয় প্রাইমারি নির্বাচন – তার শুরুর পর্যায়ে প্রচারণার সময় মি.বাইডেনকে এবার দেখা গেছে আবেগপূর্ণ কথাবার্তা বলতে। তিনি প্রায় পাঁচ বছর আগে তার ছেলের মৃত্যুর কথা বলেছেন, বলেছেন তার ছেলেবেলার কথা, অভাব অনটনের পরিবারে তার বেড়ে ওঠার কথা। তবে জনগণকে তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন: “সবসময়ই আশা আছে।” এটাই তার বিশ্বাস।
বিভিন্ন পর্যায়ের প্রাইমারিতে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেও তাকে রীতিমত বেগ পেতে হয়েছে। তবে তার ব্যক্তিসত্ত্বার পরিচয় উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রচারণা সভায় তার আবেগপূর্ণ আবেদন থেকে। তার মনমানসিকতা, তার রাজনৈতিক জীবনে ব্যক্তিগত ও পেশাগত ক্ষেত্রে মানসিক আঘাতের জায়গাগুলো এবং যেসব রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছে তার একটা ছবি পরিষ্কার হয়েছে এসব প্রচারণায়।
২০২০র প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর দৌড়ে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনের উত্থান পতনের আবেগময় মুহূর্তের কথা তুলে ধরেছেন মি. বাইডেন
“আমি ভাগ্য মানি – ভাগ্যের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস,” মি. বাইডেন ১৯৮৯ সালে বলেছিলেন ন্যাশানাল জার্নাল নামে সরকারের একটি উপদেষ্টা সংস্থাকে। “আমার ব্যক্তিগত জীবন কখনই আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলেনি। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে আমি যেটা চেয়েছি, সেটা কীভাবে যেন হয়ে গেছে- একটা অদৃশ্য হাত সেটা ঘটিয়ে দিয়েছে।”
লড়াকু
ঘনিষ্ঠ প্রিয়জনদের অকালমৃত্যুর অভিজ্ঞতা হয়েছে মি. বাইডেনের জীবনে একাধিকবার। রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা অর্জনে উপরে ওঠার সিঁড়ি যখন তিনি তৈরি করেছেন, সেগুলো ভেঙে পড়েছে। আবার তাকে নতুন করে সেগুলো গড়তে হয়েছে।
বাকপটু হবার জন্য তাকে অনেক খাটতে হয়েছে। কারণ উল্টোপাল্টা ও অপ্রাসঙ্গিক শব্দ ব্যবহারের যে প্রবণতা একসময় তার ছিল, তার জন্য তাকে অনেক ব্যঙ্গবিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছে।
জো বাইডেন প্রায়ই একটা কথা বলেন, “বাবার একটা কথা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা – কে তোমাকে কতবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল, সেটা বড় কথা নয়, কত দ্রুত তুমি উঠে দাঁড়াতে পারলে, মানুষ হিসাবে সেটাই হবে তোমার সাফল্যের পরিচয়।”
প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াইয়ে হেরে গিয়েও লড়ে গেছেন মি. বাইডেন। প্রতিটা পরাজয়ের পর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন।
সিনেটার বব কেরি, ১৯৯০এর দশকে কংগ্রেসে মি. বাইডেনের সহকর্মী বলেছেন, “জো কখনও হাল ছাড়ে না। দরকার না হলেও তার কাজ সে করেই যায়।”
অনেকের মতে মি. বাইডেন অনেক প্রতিকূলতা কাটিয়ে টিকে থাকা একজন ব্যক্তি।
ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি
ডিসেম্বর ১৮, ১৯৭২ – মি. বাইডেন ছিলেন ওয়াশিংটনে। টেলিফোন বাজল, তার ভাই জিমি বাইডেন ডেলাওয়ার থেকে ফোন করেছেন। বোন ভ্যালেরির সাথে কথা বলতে চাইলেন।
বোন বললেন, “একটা ছোট দুঘর্টনা ঘটেছে। কিন্তু চিন্তা করার কিছু নেই।”
সেদিনই আরও পরের দিকে মি. বাইডেন জেনেছিলেন ওই দুর্ঘটনায় তার স্ত্রী নেইলিয়া এবং শিশুসন্তান নেওমি মারা গেছেন। তার স্ত্রী গাড়ি চালাচ্ছিলেন। একটা লরি গাড়িতে ধাক্কা মারে। গাড়িতে থাকা তার দুই ছেলে বোও আর হান্টারও গুরুতরভাবে আহত হয়েছে।
তারা ক্রিসমাস উৎসবের জন্য ক্রিসমাস ট্রি কিনতে গিয়েছিলেন। মি. বাইডেন তখন সবে সেনেটার নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি তার কংগ্রেস অফিসের কর্মী নিয়োগের জন্য সেদিন ইন্টারভিউ নিতে ব্যস্ত ছিলেন। এছাড়াও পরিবারের থাকার জন্য একটা বাসা কেনার বিষয়টি সেদিন তিনি চূড়ান্ত করতে গিয়েছিলেন।
ওই ঘটনায় তিনি একেবারেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন।
“আমি কথা বলতে পারতাম না, বুকের ভেতরে একটা বিশাল শূণ্যতা অনুভব করতাম, মনে হতো একটা কালো গহ্বর আমাকে ভেতরে টেনে নিচ্ছে,” তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন মি. বাইডেন।
তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেবার কথা ভেবেছিলেন, ঠিক করেছিলেন যাজক হবেন, দুই ছেলেকে মানুষ করবেন। তিনি লিখেছেন, যেসব এলাকায় খুব গুণ্ডামি হতো, সেসব এলাকায় তিনি সন্ধ্যেবেলা ঘুরে বেড়াতেন। মারপিট করতে তার ইচ্ছা হতো।
“আমার ভেতরে একটা বিরাট ক্রোধ তৈরি হয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল, ঈশ্বর আমার সাথে একটা নিষ্ঠুর খেলা খেলছেন। আমার রাগ হতো।”
কৈশোর ও যৌবন
জো বাইডেনের বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। মি. বাইডেনের জন্মের আগে তিনি ব্যবসায় সাফল্য পেয়েছিলেন। কিন্তু জো-র জন্মের পর তার ব্যবসা পড়ে যায়। জো বাইডেনের কৈশোর কেটেছে পারিবারিক অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে।
পেনসিলভেনিয়ায় খুবই সাদামাটা এক বাসায় যৌথ পরিবারে বড় হয়েছেন তিনি। তার পরিবার ছিল খুব ধার্মিক। ক্যাথলিক মূল্যবোধ ও তার ধর্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল পারিবারিক ধর্মচর্চ্চার সুবাদে।
ছেলেবেলায় তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল তোতলামি কাটিয়ে ওঠা। স্কুলের উঁচু ক্লাস পর্যন্ত এই সমস্যা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
পড়তে গিয়ে তার তোতলামির জন্য সহপাঠীরা তো বটেই, এমনকী শিক্ষকরাও তাকে নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করতেন।
“এখনও আমার মনে আছে সেই যন্ত্রণার কথা, লজ্জা রাগ আর অপমানের দিনগুলোর কথা,” মি. বাইডেন লিখেছেন তার স্মৃতিকথায়।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে কবিতা আবৃত্তি ও সংযতভাবে কথা বলা আয়ত্ত করতে করতে, হাই স্কুল পার হবার পর তোতলামো কাটিয়ে ওঠেন তিনি।
হাই স্কুল শেষ করে তিনি পড়তে যান ডেলাওয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখান থেকে সিরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তে।
রাজনৈতিক উত্থান
কলেজেই পরিচয় হয়েছিল নেইলিয়া হান্টারের সাথে। লেখাপড়া শেষে ফিরে যান ডেলাওয়ারের উইলমিংটন শহরে। বিয়ে করেন নেইলিয়াকে। উইলমিংটনেই শুরু হয় তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার।
একটি বড় আইনী প্রতিষ্ঠানে তিনি আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু ধনী ও ক্ষমতাশালীদের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে তিনি অল্পদিনেই হাঁপিয়ে ওঠেন।
সাধারণ মানুষের হয়ে বিবাদী পক্ষে আইন লড়ার কাজ নেন তিনি। নগর পরিষদের একটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জেতার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় রাজনীতিতে তার পথচলা।
এরপর আসে সিনেটে তার বিজয় ১৯৭২ সলে। অনেকদিন ওই আসনে থাকা রিপাবলিকান সিনেটারকে হারিয়ে তিনি সবার দৃষ্টি কাড়েন।
রাজনৈতিক জীবনে জো বাইডেন তখন সফল তরুণ। মাত্র ৩০ বছর বয়সে দুই মেয়াদে সিনেটার থাকা রিপাবলিকান প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি সিনেটে আসন জয় করেছেন। ওই নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটদের যেখানে ভরাডুবি হয়েছে, সেখানে তার এই অভাবনীয় জয়ের পর রাজনীতির অঙ্গনে তিনি তখন হয়ে উঠেছেন ডেমোক্র্যাটিক দলের সম্ভাবনাময় তরুণ।
আবার আঘাত
তিনি বড় ছেলে বো বাইডেনকে হারান ২০১৫ সালে। বো মারা যান মস্তিষ্কের ক্যান্সারে। বাবার মত তিনিও রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। ডেলাওয়ারের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসাবে কাজ করতেন।
দু’হাজার সতের সালে লেখা তার আত্মজীবনীতে মি. বাইডেন তার ছেলের অসুস্থতা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ২০১৬-র নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর লড়াইয়ে নামার ইচ্ছা ঘোষণার তোড়জোড় যখন তিনি নিচ্ছেন ২০১৫তে, তখন তার ছেলের অকালমৃত্যু আবার তাকে বিধ্বস্ত করে দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টান।
“মানসিকভাবে যথেষ্ট উৎসাহ পাবো কিনা আমি নিশ্চিত ছিলাম না। আগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি শোক এমন একটা মানসিক চাপ, যা কোন সময়সূচি বা কাজের সময়ের তোয়াক্কা করে না,” তিনি লিখেছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে শোক ও আঘাতের পাশাপাশি তিনি তার রাজনৈতিক জীবন গড়ে তুলেছেন।
হোয়াইট হাউসের দৌড়ে প্রথম হোঁচট
এক ঝাঁক সাংবাদিকের সামনে ১৯৮৭ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর জো বাইডেনকে ঘোষণা করতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পাবার দৌড় থেকে তিনি সরে দাঁড়াচ্ছেন। মাত্র তিন মাস আগে তিনি প্রার্থিতার লড়াইয়ে নেমেছিলেন।
“এর জন্য দায়ী আমি নিজে। নিজের ওপর রাগ আর হতাশায় ভুগছি। আমেরিকার মানুষকে আমি কীভাবে বোঝাবো এটাই জো বাইডেনের আসল পরিচয় নয়। এটা শুধু আমার মস্ত একটা ভুল,” লিখেছেন মি. বাইডেন।
সেটা ছিল ১৯৮৮র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য লড়াই। মি. বাইডেনের প্রথমবার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবার উদ্যোগ লজ্জাজনক ঘটনার কারণে হোঁচট খায়। তার বিরুদ্ধে অন্যের লেখা চুরির ও অসততার অভিযোগ আনা হলে তিনি প্রচারণা থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হন।
আইওয়ায় এক বিতর্কসভায় সমাপনী বিবৃতিতে মি. বাইডেন যে কথাগুলো বলেছিলেন তা ছিল ব্রিটিশ লেবার পার্টির নেতা নিল কিনকের একটি ভাষণের প্রতিটি শব্দের হুবহু উচ্চারণ। মি. কিনক তার শ্রমিক পরিবারে বড় হয়ে ওঠা নিয়ে তার ভাষণে যা বলেছিলেন তা প্রায় হুবহু আওড়ে যান মি. বাইডেন। এর আগের এক ভাষণে একই বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি মি. কিনকের নাম উল্লেখ করলেও আইওয়ার সভায় সে কথা বলেননি। তারই এক ডেমোক্র্যাট প্রতিপক্ষ বিষয়টি সামনে আনেন।
এই অভিযোগের সূত্র ধরে সামনে আনা হয় তার ছাত্র জীবনের একটি ঘটনা, যখন তিনি আইনের ছাত্র হিসাবে তার সাইটেশন পেপারে আরেকজনের লেখা হুবহু ব্যবহার করেছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন সেটা যে নিয়ম বহির্ভূত তা তিনি জানতেন না।
এই ঘটনা মি. বাইডেনের সততা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বড়রকমের ধাক্কা খায়।
পরে তার এক জীবনীকারকে মি. বাইডেন বলেছিলেন, ওই ঘটনা তাকে “কুরে কুরে খেয়েছে। নিজেকে আমি চিরকাল একজন সৎ মানুষ হিসাবে মনে করেছি। সেই জায়গাটা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে।”।
জাতীয় রাজনীতিতে
তার স্ত্রী ও শিশু কন্যার মৃত্যুর পর মি. বাইডেন তার জীবনে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করেন। তার দুই ছেলেকে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য ঘরে অনেক সময় দেন। প্রথম ১৪ বছর তিনি ডেলাওয়্যার থেকে ওয়াশিংটন দৈনন্দিন যাতায়াত করতেন।
পরে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন জিল জেকবস নামে এক স্কুল শিক্ষয়িত্রীকে। তাদের একটি ছেলে হয়- অ্যাশলি। মি. বাইডেন সিনেটের বিচার কমিটিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং জাতীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে নিজেকে আরও তুলে ধরতে শুরু করেন।
প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হবার জন্য তার প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবার পেছনে ওই লেখাচুরির কলঙ্ক তাকে অনেকদিন তাড়া করে বেড়িয়েছে।
তবে ১৯৮৮ সালের ওই নির্বাচন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেবার ঘটনা অনেকে বলেন তার জন্য শাপে বর হয়েছিল।
লড়াই থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষণার কয়েক মাসের মাথায় নিউ ইয়র্কে এক হোটেল ঘরে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন জো বাইডেন। মস্তিষ্কের রক্তনালী ফুলে ওঠার এক সম্ভাব্য প্রাণঘাতী অসুখে তিনি আক্রান্ত হন। এর পরের ছয় মাস তাকে বহুবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে আবার লড়াই
বিশ বছর পর আবার নতুন করে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবার লড়াইয়ে নেমেছিলেন মি. বাইডেন ২০০৮এর নির্বাচনের জন্য। তখন তিনি রাজনীতিতে আর নতুন মুখ নন, তিনি একজন প্রবীণ রাজনীতিক।
তিনি বলেন ১৯৮৭ সালে তার প্রচারণা ছিল বড় বড় বুলি আর ছবিতে ভরা। বিশ বছর পর তিনি তার প্রচারণার ভাষা বদলে ফেলেন।
“গত বিশ বছর আমার জীবনযাত্রা দেখে আপনাদের নিশ্চয়ই বিশ্বাস জন্মেছে যে আমি একজন বিশ্বাসযোগ্য মানুষ,” ২০০৮য়ে আইওয়ার প্রচারণা সমাবেশে তিনি একথা বলেন। “আর সে কারণেই আবার এই পদে প্রার্থী হবার লড়াইয়ে আমি ফিরে এসেছি।”
তবে সেই লড়াইয়ে তিনি সফল হননি। বারাক ওবামা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পান প্রেসিডেন্ট পদে লড়ার জন্য।
কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়ে বারাক ওবামা তার ভাইস প্রেসিডেন্ট রানিং মেট হিসাবে বেছে নেন জো বাইডেনকে।
“তারা দুজনে খুবই আলাদা প্রকৃতির মানুষ,” বলেছেন সাংবাদিক ও ভাইস-প্রেসিডেন্সি বইয়ের লেখিকা কেট অ্যান্ডারসন ব্রাওয়ার। “ওবামা খুব সতর্কতার সাথে কথা বলেন, খুব ভাবনা চিন্তা করে মন্তব্য করেন। কিন্তু বাইডেন একেবারে উল্টো। না ভেবেই হুটহাট কথা বলা তার স্বভাব, যে কারণে অনেকবার তাকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। বাইডেন ওবামাকে বলেছিলেন, তিনি বদলাবেন না ‘আমি যেমন আমি তেমনই থাকব’,” বলেছেন কেট অ্যান্ডারসন ব্রাওয়ার।
ওই নির্বাচনে মি.বাইডেনের একজন প্রতিদ্বন্দ্বী নিউ মেক্সিকোর সাবেক গভর্নর বিল রিচার্ডসন বলেন, ডেমাক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচন পর্বের প্রচারণার সময় ওবামা আর বাইডেনের মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
“ওবামা তার প্রশাসনে পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ে একজন ঝানু রাজনীতিককে চাইছিলেন,” তিনি বলেন।
ইলিনয়ের জন সমাবেশে মি. বাইডেনকে তার রানিং মেট ঘোষণা করে মি. ওবামা বলেছিলেন, “জো বাইডেন একজন বিরল মানুষ- কয়েক দশক ধরে তিনি ওয়াশিংটনে নানা পরিবর্তন এনেছেন, কিন্তু ওয়াশিংটন তার মধ্যে কোন পরিবর্তন আনতে পারেনি। আমি মনে করি আমার পার্টনার হিসাবে, দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা করতে তিনিই সবচেয়ে উপযুক্ত।”
ইরাক যুদ্ধ ও পররাষ্ট্র নীতি
মি. বাইডেন পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ক আমেরিকান সিনেট কমিটিতে কাজ করেছেন দীর্ঘ দিন।
সিনেটের এই কমিটির সভাপতি হিসাবে ২০১২ সালের অক্টোবরে আমেরিকার রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের ইরাক যুদ্ধে যাবার বিষয়টিকে অনুমোদন দেবার সিদ্ধান্ত ছিল তার ওপর।
এর ১১ বছর আগে উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রাক্কালে প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডাব্লিউ বুশকে সাদ্দাম হুসেনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অনুমোদনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন মি. বাইডেন ।
“কুয়েতের মুক্তির জন্য আমেরিকানদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবার আগে আমাদের উচিত দেখা কোনরকম বিকল্প পথ আমরা চেষ্টা করেছি কিনা, “সিনেট কমিটির শুনানিতে বলেছিলেন মি. বাইডেন। “আমরা করিনি।”
১৯৯০এ উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় জর্জ এইচ ডাব্লিউ বুশ সৌদি আরবে আমেরিকান নৌ সেনাদের সাথে
মি. বাইডেনের হুঁশিয়ারি স্বত্ত্বেও উপসাগরীয় যুদ্ধের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ওই যুদ্ধে আমেরিকান মারা যায় অল্প সংখ্যক।
এরপর থেকে বাইডেনকে পররাষ্ট্র ও জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলচিত্ত বলে তুলে ধরা শুরু হয়।
ওই ভোট নিয়ে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হবার পরবর্তী কয়েক বছর মি. বাইডেন আন্তর্জাতিক বিষয়ে কট্টর অবস্থান দেখাতে শুরু করেন, যেমন বলকান গৃহযুদ্ধে আমেরিকান অবস্থান, ইরাকে বোমা হামলা এবং আফগানিস্তানে দখলদারিত্ব কায়েমের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করে।
প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ইরাকের কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে এই অভিযোগে যখন ইরাকে নতুন করে যুদ্ধ শুরুর প্রস্তাব করেন, তখন মি. বাইডেন তাতে জোরালো সমর্থন দিয়েছিলেন।
“আমি মনে করি না এটা যুদ্ধ করার জন্য একটা হুজুগ, আমার বিশ্বাস এটা শান্তি ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে অভিযান,” তিনি বলেন।
বাইডেনের ইরাক যুদ্ধে সমর্থন নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাতা মার্ক ওয়েসব্রট বলেছেন, “যেসব ডেমোক্র্যাট এই যুদ্ধ সমর্থন করেছিলেন, তাদের মনে হয়েছিল এই যুদ্ধ সমর্থন না করার ঝুঁকিটা হল, যুদ্ধটা যদি সফল হয়ে যায়, তাহলে তার থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার ক্ষেত্রে তারা পেছিয়ে পড়বেন। ”
তবে তার ওই সমর্থনের কারণে অনেক ডেমোক্র্যাট সমর্থকের সমালোচনার মুখে তিনি পড়েন।
তার আত্মকথায় ২০০৭ সালে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে অধ্যায়ের শিরোনাম তিনি দেন – “আমার ভুল” । তিনি লেখেন: “তাদের আন্তরিকতা ও দক্ষতা আমি বুঝতে ভুল করেছিলাম।”
ইরাক যুদ্ধের পর তিনি বামপন্থার দিকে ঝোঁকেন। তিনি ইরাকে আমেরিকান সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধির বিরোধিতা করেন এবং সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।
ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী জোরদার করার এবং ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর বিপক্ষে পরামর্শ দেন।
আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হবার লড়াইয়ে নামার ঘোষণা দেবার পর তিনি ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের প্রতি আমেরিকার সমর্থন বন্ধ করার পক্ষে মত তুলে ধরেন।
ইরানের সাথে পরমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা, জলবায়ু নিয়ে প্যারিস চুক্তি সমর্থন, চীনে মার্কিন স্বার্থ বজায় রাখা এবং ইউক্রেনের গণতান্ত্রিক সংস্কার উৎসাহিত করা সহ নানা বিষয়ে তিনি গত কয়েক বছর কংগ্রেসের ওপর চাপ দিয়েছেন।
তবে চীন ও ইউক্রেন নিয়ে মি. বাইডেনের অবস্থানকে বিভিন্ন প্রচারণায় কড়া ভাষায় আঘাত করেছেন মি. ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, মি. বাইডেন চীনের বেশি ঘনিষ্ঠ এবং ইউক্রেন নিয়ে তার আগ্রহ মূলত ইউক্রেনে তার ছেলে হান্টারের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষার খাতিরে।
লড়াইয়ের চূড়ান্ত ধাপ
কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে শুরু হলেও, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলের মনোনীত প্রার্থী হবার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছেন জো বাইডেন। তার প্রতিপক্ষ বার্নি স্যান্ডার্সকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট পদের প্রার্থী হবার টিকেট পান মি. বাইডেন।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, তার এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ আট বছর বারাক ওবামার ডেপুটি হিসাবে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্বপালন। এর সুবাদে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ ডেমোক্র্যাটদের বিপুল সমর্থন পেয়েছেন।
একজন কৃষ্ণাঙ্গ-ভারতীয় বংশোদ্ভুত নারী কমালা হ্যারিসকে তিনি বেছে নিয়েছেন তার ভাইস প্রেসিডেন্ট রানিং মেট হিসাবে।
প্রায় ৫০ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য তার তৃতীয় প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘ ৪০ বছরের স্বপ্ন তার শেষ পর্যন্ত পূরণ হলো। আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক পপুলার ভোট আর ২৭৩ টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেন জো বাইডেন।
রিপোর্টঃ বিবিসি