বাংলাদেশ : সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ?

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ জনপরিসরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আচরণে কেমন হবে? সম্প্রতি বিভিন্ন খাতের কয়েকজন কর্মকর্তার তুমুল বিতণ্ডা এবং অপরিশীলিত আচরণ সম্বলিত একটি ভিডিও ভাইরাল হবার পর এই প্রশ্নটি নতুন করে সামনে এসেছে।

প্রশাসনের সাবেক সিনিয়র কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সময় সরকারি কর্মকর্তাদের পরিশীলিত আচরণ নিশ্চিত করার বিষয়ে জানানো হলেও এ বিষয়ে বিধিমালা বা নিয়মকানুন তেমন কিছু নেই।

যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে, তাতে দেখা যায়, কয়েকজন পুলিশ ও একজন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে এক চিকিৎসক চরম বিতণ্ডায় জড়িয়েছেন। তারা পরষ্পর পরষ্পরকে অপরিশীলিত বাক্যবাণ করছেন এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষমতা জাহির করার চেষ্টা করছেন। তিনজনই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা।

ফেসবুকে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, দায়িত্বরত পুলিশের সঙ্গে ডাক্তারের এমন ব্যবহার কতটা সমীচীন? আবার কেউ কেউ লিখছেন, পুলিশের হয়রানি নিয়ে অনেকদিনের জমানো ক্ষোভ থেকেই হয়তো এমন প্রতিক্রিয়া!
১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা রয়েছে, যেখানে একজন সরকারি কর্মকর্তা নির্ধারিত কিছু বিষয়ে কিভাবে পদক্ষেপ নেবেন সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। তবে সেখানে জনগণের সাথে আচরণ কেমন হবে সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

তবে এই বিধিমালায় বলা হয়েছে:

সরকারি কর্মচারী কোন বিষয়ে তার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোন অনুরোধ বা প্রস্তাব নিয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোন সংসদ সদস্য বা অন্য কোন বেসরকারি ব্যক্তির দ্বারস্থ হতে পারবে না।
সরকারি কর্মচারী তার চাকরি সংক্রান্ত কোন দাবীর সমর্থনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকার বা কোন সরকারি কর্মচারীর উপর কোন রাজনৈতিক বা অন্য কোন বহিঃপ্রভাব খাটাতে পারবে না।
কোন সরকারি কর্মচারী মহিলা সহকর্মীর প্রতি কোন প্রকারে এমন কোন ভাষা ব্যবহার বা আচরণ করতে পারবেন না যা অনুচিত এবং অফিসিয়াল শিষ্টাচার ও মহিলা কর্মচারীদের মর্যাদার হানি ঘটায়।
তবে, এসব বিধিমালা প্রায় সময়ই মানা হয় না বলে নানা ধরণের অভিযোগও দেখা যায়।

তাহলে কর্মকর্তারা আচরণবিধি কীভাবে শেখেন?
মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) অনুজা মণ্ডল বিবিসি বাংলাকে বলেন, যদিও তারা চাকরিতে আসার পর যে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণটি পান সেখানেই আচরণবিধির অনেকটাই শেখেন। তবে মূল শিক্ষাটি পান কাজ করতে এসে সিনিয়রদের কাছ থেকে।

“যখন কালেক্টরেটে কাজ করতে এসেছি, তখনই বড়দের কাছে শিখেছি, কীভাবে জনগণের সাথে আচরণ করতে হবে। আমাদের সবসময় সহিষ্ণু আচরণ করতে শেখানো হয়েছে”।

আর সেবাগ্রহীতাদের প্রতি সেই আচরণ হতে হবে “অবশ্যই আন্তরিক এবং মানবিক”, বলেন মিসেস মণ্ডল।

মাঠ পর্যায়ে কর্মরত আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন, বিসিএস পরীক্ষার পর ক্যাডার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেয়ার পর যে প্রশিক্ষণগুলো হয়, সেখানে জনগণের প্রতি আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে পাঠ দেয়া হয়। তবে এ বিষয়ে আলাদা করে কোন প্রশিক্ষণের কথা জানাতে পারেননি তিনি।

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার লিখিত আচরনবিধি না থাকার উল্লেখ করেন, তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দপ্তর পরিপত্রের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণের বিষয়টি জানিয়ে দেয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

চেকপোস্টে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে এক চিকিৎসকের বিতণ্ডার চিত্র ভাইরাল হয়।

ভাইরাল ভিডিওর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় একটি নির্দেশনা দিয়ে বলেছে, লকডাউন চলাকালে সব চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরা যেন পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখেন।

মি. মজুমদার বলেন, “আশা করা হয় যে, সরকারি কর্মকর্তা যারা আছেন তাদের আচরণ হবে পরিশীলিত। এটা জনগণ তো বটেই, সহকর্মীদের সাথেও এমন আচরণ নিশ্চিত করতে হবে।”

সারা দেশের চিত্র নয়
যে ভিডিওটিকে কেন্দ্র করে সরকারি কর্মকর্তাদের আচরণ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত, সেটি সারা দেশের চিত্র নয় বলে বর্ণনা করছেন আলী ইমাম মজুমদার। আবার ভিডিওটিও ঘটনাপ্রবাহের পুরো চিত্র নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

“পুরো ঘটনার চিত্র ভিডিও আকারে আসেনি। মাঝামাঝি পর্যায় থেকে ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে। উত্তেজনা যখন তুঙ্গে থাকে তখনই ভিডিও করা হয়। এর আগে করা হয় না।” বলেন মি. মজুমদার।

তবে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, পুরো দেশেই লকডাউন চলছে। সেখানে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে যা বাস্তবায়নে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

“বিধিনিষেধ নিশ্চিত করতে গিয়ে দুয়েক জায়গায় কিছু ভুল-ভ্রান্তি হওয়াটা অযাচিত কিন্তু অস্বাভাবিক নয়,” তিনি বলেন।

তার মতে, গোটা কর্মকাণ্ডের তুলনায় এটাকে খুব বড় করে দেখার সুযোগ নেই। তবে এটা ‘দুঃখজনক এবং এটা হওয়াটা ঠিক হয়নি’। কারণ যারা রাস্তায় দায়িত্ব পালন করছেন তারা অন্য কারো সাথে অশোভন আচরণ করতে পারেন না।

“গতকাল ক্ষেত্র-বিশেষে সেটাই হয়েছে এবং এটা অযাচিত”।

তিনি বলেন, “একদিকে পুলিশের আচরণও পরিশীলিত ছিল না, আর অন্যদিকে চিকিৎসক যিনি ছিলেন, তিনিও যেসব কথা বলেছেন সেটাও কাঙ্ক্ষিত নয়। তার আচরণও অযাচিত”।

সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আকবর আলী খান বলেন, “বাংলাদেশে যে ক্যাডার সার্ভিসগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে এক ধরণের অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। এরা একে অপরকে সহ্য করতে পারে না”। এক্ষেত্রে সে বিষয়টি কাজ করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

একই সাথে যারা দায়িত্ব ছিলেন, তারাও হয়তো ভালভাবে প্রশিক্ষিত হননি – এসব কারণেই এ ধরণের ঘটনার উদ্ভব হয়।

তবে মি. খান একে সরকারি কর্মচারীদের আচরণ না বলে এই ঘটনাকে তাদের ব্যক্তিগত আচরণ হিসেবেই দেখতে চান।

মি. খান বলেন, জনগণের সাথে আচরণ কেমন হবে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হলে মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা দরকার। সেটি না হলে প্রশিক্ষণ ফলপ্রসূ হবে না। তবে এ ধরণের গবেষণাও বাংলাদেশে অপ্রতুল।


Spread the love

Leave a Reply