সাবিনা নেসা: চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহভাজন গ্রেফতার

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ লন্ডনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্কুল শিক্ষিকা সাবিনা নেসাকে হত্যার সন্দেহে পুলিশ ৩৮ বছর বয়সী এক পুরুষকে গ্রেফতার করেছে। লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ এই গ্রেফতারকে মামলার তদন্তে বড় ধরনের অগ্রগতি বলে বর্ণনা করছে।

সাবিনা নেসা গত ১৭ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের কিডব্রুক এলাকায় তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় হামলার শিকার হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার লাশ পরদিন শনিবার নিকটবর্তী পার্কে পাওয়া যায়।

এই হত্যাকান্ড নিয়ে ব্রিটেনে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয় এবং ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

পুলিশ বলছে, ইস্ট সাসেক্স থেকে রবিবার ভোরে এই সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এর আগে একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করে, যাতে এক ব্যক্তিকে পার্কে ঘটনাস্থলের কাছ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়। পুলিশ বলেছিল, এই ব্যক্তি হত্যার তদন্তের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ ঘটনায় এর আগেও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়, তবে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।

চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড
এক সপ্তাহেরও বেশি আগে গত ১৮ সেপ্টেম্বর, শনিবার বিকেলে দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের এক পার্কের ভেতর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল সাবিনা নেসার মৃতদেহ। পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পর এক ব্যক্তি লাশটি দেখতে পান। সাথে বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়। তখনো কেউ জানে না, এই নারীর নাম, কী তার পরিচয়।

সোমবার হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকায় ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে ছাপা হয়েছিল খবরটি।

পুলিশের তদন্তে এ পর্যন্ত যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে গত ১৭ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার সন্ধ্যায় কোন এক সময়ে সাবিনা নেসাকে হত্যা করা হয়েছিল। এরপর হত্যাকারী তার লাশটি ফেলে রেখেছিল পার্কে ঝোপঝাড়-ঘাসের আড়ালে। পরদিন বিকেলে পার্কের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক ব্যক্তির নজরে আসার আগে পর্যন্ত সেখানেই পড়ে ছিল লাশটি।

এই হত্যাকাণ্ডের মিডিয়া কভারেজ, রাস্তাঘাটে নারীর নিরাপত্তাহীনতা- এসব নিয়ে ব্রিটেনে এখন চলছে তুমুল বিতর্ক। ব্রিটেনে কোন শ্বেতাঙ্গ নারী যখন একই ধরণের ঘটনার শিকার হন, তখন ব্রিটিশ মিডিয়ায় সাথে সাথে সেটি নিয়ে যেভাবে ফলাও করে খবর প্রচার হয়, সাবিনা নেসা সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ হওয়ায় শুরুতে সেটি দেখা যায়নি বলে তীব্র সমালোচনা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

গত কয়েকদিন ধরে অবশ্য ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে আছে সাবিনা নেসার হত্যাকাণ্ড। তবে এই ঘটনার কভারেজ নিয়ে বিতর্ক এবং নারীর নিরাপত্তা-হীনতা নিয়ে ক্ষোভ এখনো থামেনি।

কে এই সাবিনা নেসা?
দক্ষিণ পূর্ব লন্ডনের এক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন সাবিনা নেসা। ২৮ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ-বাংলাদেশি পড়াশোনা করেছেন গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার স্কুলের প্রধান শিক্ষক সাবিনা নেসাকে একজন “মেধাবী, দয়ালু এবং নিবেদিতপ্রাণ” শিক্ষক বলে বর্ণনা করেছেন।

সাবিনা নেসার পৈতৃক বাড়ি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলায়। যুক্তরাজ্যের বেডফোর্ডশায়ারের একটি ছোট্ট শহরে স্যান্ডিতে থাকেন তার পরিবার। বাবা আবদুর রউফ কাজ করেন স্যান্ডির একটি রেস্টুরেন্টে।

হত্যাকারী কে?
এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য এখনো অনুদঘাটিত, তবে এ ঘটনায় পুলিশ রবিবার এমন একজনকে গ্রেফতার করেছে, যাকে মামলায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
পুলিশ এর আগেও দুজনকে গ্রেফতার করে, তবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হয়।
একজন সন্দেহভাজনকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছিল। লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ করে, যাতে এই টাক মাথার পুরুষকে হাতে কিছু একটা নিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে। পুলিশ মনে করছে সাবিনা নেসা হত্যা রহস্য উদঘাটনে লোকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে রবিবার গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি সেই একই ব্যক্তি কীনা, তা এখনো জানা যায়নি।

ভিডিও ফুটেজের এই লোকটির পরণে ধূসর রঙের জিন্স এবং কালো জ্যাকেট। ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাকে মাথায় হুড টেনে দিতে দেখা যায়।

পুলিশের তদন্ত যেভাবে আগাচ্ছে এবং যেসব তথ্য এখনো পর্যন্ত পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে কোন অপরিচিত ব্যক্তির হাতেই হয়তো খুন হয়েছেন সাবিনা নেসা।

মিডিয়া কভারেজ নিয়ে বিতর্ক

সারাহ এভারার্ডকে গত মার্চে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনার সঙ্গে সাবিনা নেসার হত্যাকাণ্ডের তুলনা করছেন অনেকে।

সাবিনা নেসা হত্যাকাণ্ডের খবর ব্রিটিশ মিডিয়ায় শুরুতে অতটা গুরুত্ব পায়নি বলে তীব্র সমালোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এক্ষেত্রে তার হত্যাকাণ্ডের খবরকে তুলনা করা হচ্ছে কয়েক মাস আগে লন্ডনে একই ধরণের ঘটনার শিকার হওয়া এক শ্বেতাঙ্গ নারী সারা এভারার্ডের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে।

সারা এভারার্ড নিহত হন এ বছরের মার্চে দক্ষিণ লন্ডনে। তিনিও সেদিন পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন রাতে, পথে তাকে অপহরণ করে এক পুলিশ, পরে তার লাশ পাওয়া যায় একটি পার্কে।

তার হত্যাকাণ্ড ব্রিটেনকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়, দিনের পর দিন এই হত্যাকাণ্ডের খবর ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনাম দখল করে রেখেছিল। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং ঘরের বাইরে নারীর নিরাপত্তার দাবিতে যে বড় বড় বিক্ষোভ হয়, তাতে এমনটি ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য ডাচেস অব কেমব্রিজ কেট মিডলটনও যোগ দিয়েছিলেন।

কিন্তু সাবিনা নেসার হত্যাকাণ্ডের পর অন্তত প্রথম কয়েকদিন সেধরণের কভারেজ দেখা যায়নি বলে অনেকে অভিযোগ করছেন।

লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের একজন কাউন্সিলর রাবিনা খান বিবিসি রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন অনেক পোস্ট তিনি দেখেছেন, যেখানে অনেকে প্রশ্ন করছেন, একজন অশ্বেতাঙ্গ নারী বা সংখ্যালঘু নারী যদি সারা এভারার্ডের মতো নিখোঁজ হয়ে যান, তিনি কি আসলে মিডিয়ায় একই ধরণের মনোযোগ পাবেন?

নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন
দক্ষিণ লন্ডনের যে জায়গায় সাবিনা নেসার দেহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, তার কাছেই শুক্রবার সন্ধ্যায় এক বিরাট প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন শত শত মানুষ। সেখানে তারা মোমবাতি জ্বালিয়ে সাবিনার প্রতি শ্রদ্ধা জানান, এই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার অবসান দাবি করেন।

সাবিনা নেসার বোন জেবিনা ইয়াসমিন ইসলাম সেখানে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।

তিনি বলেন, “আমাদের অনুভূতি এখন কী, তা কোন শব্দ দিয়ে আমরা প্রকাশ করতে পারবো না। মনে হচ্ছে আমরা একটা দুঃস্বপ্নের ঘোরে আটকে আছি। কোন পরিবারকে যেন এরকম ঘটনার শিকার হতে না হয়।”

লন্ডনের মতো একটি শহরেও ঘরের বাইরে নারীদের কীভাবে সারাক্ষণ নিরাপত্তা-হীনতায় ভুগতে হয়, তার উদাহরণ দিচ্ছিলেন রেডব্রিজ কাউন্সিলের একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর সৈয়দা সায়মা আহমেদ