কেন নেটোতে যোগ দেয়ার কথা ভাবছে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন?
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ সুইডেনসহ স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর জনগণের মধ্যে নেটোর সামরিক জোটে যোগদানের জন্য কখনোই খুব বেশি সমর্থন ছিল না।
কিন্তু যখন রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সম্প্রতি ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে স্পষ্টভাবে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, নেটোর সদস্য হওয়ার দিকে তাদের যেকোনো পদক্ষেপের পরিণতি হতে পারে সামরিক, তখন উভয় দেশের মানুষ গভীরভাবে মর্মাহত হয়।
তারপর থেকে, রুশ যুদ্ধবিমান নির্বিচারে সুইডিশ আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করেছে।
দুই হাজার চৌদ্দ সালে রাশিয়ার একটি সাবমেরিন প্রবেশ করেছিল স্টকহোমের সীমানায়।
নিরপেক্ষ থাকাই যদি রাশিয়ার কাছ থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য যথেষ্ট না হয়, তবে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের জনগণ বলছে, হয়তো নেটোতে যোগ দিলে দেশ দুটি প্রয়োজনীয় সুরক্ষা পেতে পারে।
ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট বৃহস্পতিবার বলেছেন, তার দেশের উচিৎ অবিলম্বে নেটো সদস্যপদের জন্য আবেদন করা।
রবিবার দেশটির পার্লামেন্টে অনুমোদনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে ঘোষণা আসতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাশিয়ার কাছে নিজেদের ১০ শতাংশ ভূমি হারালেও কোন জোটে যোগ দেয়া থেকে বিরত ছিল ফিনল্যান্ড।
কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড উত্তর ইউরোপের দেশগুলোকে আশঙ্কায় ফেলে দিয়েছে।
ফলে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলো নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে শুরু করেছে।
ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার স্টাব বলেছেন, ২৪শে ফেব্রুয়ারি যখন রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করেছে, সেদিনই ফিনল্যান্ডের নেটোয় যোগ দেয়া হয়ে গেছে।
সুইডেনের ক্ষমতাসীন দলও এই সপ্তাহেই নেটোতে যোগ দেয়ার বিষয়ে ঘোষণা দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত নভেম্বরেও সুইডেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার হলৎভিস্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে সুইডেন কখনো নেটোতে যোগ দেবে না।
কিন্তু এখন তিনি বলছেন, যদি তারা নেটোতে যোগ দেন, তাহলে নরডিক দেশগুলোর নিরাপত্তা আরও জোরদার হবে।
অনেকে ফিনিশ এবং সুইডিশ মনে করেন, ইউরোপে এখন যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, নেটোতে যোগ দিলে তা থেকে তারা সুরক্ষা পাবেন।
তবে কম হলেও নেটোয় যোগ দেয়ার বিপক্ষে মনোভাবও রয়েছে একটি অংশের।
সুইডিশ পিস অ্যান্ড আরবিট্রেশন সোসাইটির সদস্য ডেবোরা সলোমন বলছেন, নেটোয় যোগ দিলে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক উত্তেজনা আর ঝুঁকি বাড়বে।
সেই সঙ্গে বিশ্বে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ আন্দোলনে সুইডেনের যে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রয়েছে, তা হারাতে হবে।
নেটোয় যোগ দিলে বিশ্বে শান্তি রক্ষায় সুইডেনের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও আর থাকবে না।
ফিনল্যান্ডের দিক থেকে দেখতে গেলে, ইউক্রেন আক্রমণের সাথে ১৯৩৯ সালের ফিনল্যান্ড আক্রমণের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে- যা দেশটিতে শীতকালীন যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।
আত্মবিশ্বাসে পূর্ণ জোসেফ স্তালিন তার সেনাবাহিনীকে ফিনল্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন শুধুমাত্র এটা প্রমাণ করতে যে, জেনারেলরা তাকে যে ধারণা দিয়েছিলেন তার প্রতিরোধ ব্যবস্থা আসলে তার চেয়েও শক্তিশালী।
ফিনল্যান্ডের জনগণ তখন বিশাল এক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল।
ওই বাহিনীর মনোবল এক বছর বা তারও আগে গুরুতরভাবে ভেঙে পড়েছিল।
ওই বাহিনীর বেশিরভাগ শীর্ষ ব্যক্তিত্বের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে।
আলোচনা শুরু হওয়া এবং একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর আগে ‘শীতকালীন যুদ্ধ’ কয়েক মাস ধরে চলেছিল।
সেসময় রাশিয়া ফিনল্যান্ডের কাছ থেকে কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়।
কিন্তু ফিনিশরা তাদের স্বাধীনতা হারায়নি- এবং তখন থেকে তারা এটি এখনো ধরে রেখেছে।
রাশিয়া কী বলছে?
ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের নেটো যোগ দেয়ার আগ্রহে ক্ষুব্ধ মনোভাব প্রকাশ করেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়া বরাবরই নেটোর বিস্তার ঠেকানোর যুক্তি দিয়ে আসছে। ফলে ফিনল্যান্ড ও সুইডেন নেটোয় যোগ দেয়ার আবেদন করলে সেটা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উস্কানি হিসাবে দেখতে পারেন।
বৃহস্পতিবার ফিনল্যান্ড নেটোয় যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করার পর রাশিয়া হুমকি দিয়েছে, তারা প্রতিশোধমূলক পাল্টা পদক্ষেপ নেবে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতিতে বলেছে, ”নেটোয় ফিনল্যান্ড যোগ দিলে তা রাশিয়া-ফিনল্যান্ডের সম্পর্কে গুরুতর ক্ষতি করবে। সেই সঙ্গে উত্তর ইউরোপের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলবে।”
”এ থেকে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি তৈরি হওয়া হুমকি মোকাবেলা করতে রাশিয়া প্রতিশোধমূলক পাল্টা পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে, যার মধ্যে সামরিক-কৌশলগত এবং অন্যান্য ব্যবস্থা থাকতে পারে।” বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
কিন্তু কি পদক্ষেপ নেয়া হবে, তা পরিষ্কার করেনি রাশিয়া।
শনিবার থেকে ফিনল্যান্ডে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। তাদের দাবি, এর আগে সরবরাহ করা বিদ্যুতের দাম পরিশোধ না করায় তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের ১৩০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেছেন, এর ফলে কালিনিনগ্রাদে রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে পারে।
তবে সাবেক ফিনিশ প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার স্টাব বলছেন, সামরিক অভিযানের পরিবর্তনে রাশিয়া হয়তো সাইবার হামলা, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো আর মাঝে মাঝে আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো কাজ করতে পারে।