বিবিসির বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের গৎবাঁধাভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির টেলিভিশন সিরিজ ‘বডিগার্ড’-এ মুসলিম নারীদের গৎবাঁধাভাবে উপস্থাপনের অভিযোগ উঠেছে। মুসলিম নারীরা দুর্বল হয়; সিরিজের একটা পর্যায় পর্যন্ত ছকবদ্ধ ধারণা ভাঙার উদ্যোগ দেখা যায়। তবে শেষপর্যন্ত তাদের শক্তির জায়গা চিহ্নিত করতে গিয়ে ওই সিরিজের মুসলিম নারীকে জিহাদি হিসেবে হাজির করা হয়। ইরানি বংশোদ্ভূত ইসলামী নারীবাদী চিন্তাবিদ জিবা মীর হোসেইনি মন্তব্য করেছেন, ওই সিরিজে মুসলিম নারীদের সম্পর্কে একটি ছকবদ্ধ ধারণা মোকাবেলা করতে গিয়ে আরেকটি ছকবদ্ধ ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সিরিজের প্রেক্ষাপটকে ‘গোলমেলে’ বলে উল্লেখ করেছেন জিবা।

বডিগার্ড সিরিজের একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নাদিয়া। শো এর প্রথম পর্বে দেখা যায়, একটি জনবহুল ট্রেনে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটানোর সময় নাদিয়াকে আটক করে নায়ক ডেভিড বুড। তাকে জিহাদি স্বামী কর্তৃক দমনের শিকার এক দুর্বল নারী হিসেবে দেখানো হয়। তবে সিরিজের চূড়ান্ত পর্বে গিয়ে দেখা যায়, নাদিয়া আসলে একজন সুদক্ষ প্রকৌশলী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জুলিয়া মন্টাগুয়েকে যে বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে সে বোমাটি তিনিই তৈরি করেছেন। শেষের দিকের দৃশ্যে দেখা যায় পুলিশকে নাদিয়া বলেন, ‘আপনারা আমাকে দরিদ্র, দমিত মুসলিম নারী হিসেবে দেখেছেন। আসলে আমি একজন প্রকৌশলী। আমি একজন জিহাদি।’

লেখক, পরিচালক ও আইন-নৃবিজ্ঞানী জিবা মীর হোসেইনি জানিয়েছেন, শুরুতে তার কাছে সিরিজটি ভালো লেগেছিল। তবে চূড়ান্ত পর্বের শেষ ভাগে এসে কাহিনী যেভাবে মোড় নিলো, তাতে তিনি অবাক হয়েছেন। শেলটেনহ্যাম সাহিত্য উৎসবে ইসলাম ও নারীবাদ বিষয়ে বক্তব্য দিতে গিয়ে জিবা প্রশ্ন তোলেন, ‘মুসলিম নারীদের নিয়ে যে গৎবাঁধা ধারণা প্রচলিত আছে, কেন তেমন করে ভীতি ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে নাদিয়াকে উপস্থাপন করতে হলো? তারপর হঠাৎ করে তার বৈশিষ্ট্য পাল্টে মুসলিম নারী সংক্রান্ত আরেকটি ছকবদ্ধ ধারণা দেখানো হলো। তা হলো-জিহাদি। এটা আমার কাছে সত্যিকার অর্থে গোলমেলে লেগেছে।’

ড. মীর হুসেইনি প্রশ্ন তুলেছেন, মুসলিমদের ভাবমূর্তি তৈরি ও ইতিবাচক উপস্থাপনের জন্য যে সিরিজ, সেখানে কেন এমন বাস্তবতা হাজির করা হয়? আক্ষেপ করে তিনি বলেন, বডিগার্ডের মতো শো গুলো বিশ্বজুড়ে মুসলিম নারীদের দৈনন্দিন যে সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয় তাকে প্রতিফলিত করতে পারে না। বিশ্ব পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ইসলামী নারীবাদীদের বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মুসলিম নারীবাদীদেরকে বিপুল প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়। পরিবারে সমতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গেলে পুরুষরা হুমকি বোধ করে। মনে হয়, এমন কিছু হয়েছে যে গোটা সমাজ ধসে যাচ্ছে। আপনাকে এমন অভিযোগেরও শিকার হতে হবে যে পশ্চিমারা আপনার মগজ ধোলাই করেছে। কারণ আপনি সমতা আর নারীবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। একই সময়ে আপনি এমন সব মুসলিম নারীদেরও প্রতিরোধের মুখে পড়বেন, যারা কিনা মনে করে ইসলামে সমতা ও নিরপেক্ষতার জন্য তর্ক করাটা বেঈমানি।’

ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত পাকিস্তানি নাগরিক আলিয়াহ সালিম মনে করেন, মুসলিম নারীদেরকে তাদের সম্পর্কে জারি থাকা নানা ছকবদ্ধ ধারণা দূর করতে হবে। তিনি বলেন, ‘মুসলিম নারীদেরকে নিয়ে একটি ছকবদ্ধ ধারণা প্রতিষ্ঠিত আছে যে তারা নিষ্ক্রিয়, কর্তৃত্বহীন আর মুসলিম পুরুষেরা রূঢ়। এটা বেশ সমস্যাপূর্ণ ও পুরনো ধারণা। এটি নতুন কিছু নয়। নাইন ইলেভেনের কারণে এমন হয়েছে।’

উল্লেখ্য, পশ্চিমা প্রচারণা মাধ্যমে মুসলমানের উপস্থাপন নিয়ে সাড়া জাগানো কাজ হাজির করেছিলেন প্রয়াত ফিলিস্তিনি-আমেরিকান লেখক এডওয়ার্ড সাঈদ। ‘প্রাচ্যবাদ’ নামের ডিসকোর্সের আওতায় পশ্চিমা বিশ্বে কী করে মুসলিমদের নিয়ে বিভিন্ন ধ্যান-ধারণা-বিশ্বাস-মনোভঙ্গী নির্মিত হয়; ‘ওরিয়েন্টালিজম’ নামের এক সাড়া জাগানো বইতে তা হাজির করেছিলেন তুলনামূলক সাহিত্যের প্রয়াত অধ্যাপক। ১৯৭৮ সালে রচিত এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে সাইদ হাজার বছর ধরে জারি থাকা এই প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেন। তবে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ার হামলার পর তার বইটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। সেই সময় থেকে মুসলমান মাত্রই ‘পশ্চাদপদ’ কিংবা ‘সন্ত্রাসী’ কিংবা ‘ভয়ঙ্কর’ কিংবা ‘নেকাবের আড়ালে থাকা ভয়াবহ প্রাণী’; এইসব নির্মিত ধারণা আরও বেশি করে প্রচারণামাধ্যমের জায়গা দখল করতে শুরু করে।


Spread the love

Leave a Reply