পদ্ম পাতার জল: বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র
বাংলা সংলাপ ডেস্কঃ“পদ্ম পাতার জল”, বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র। তন্ময় তানসেন পরিচালিত এই সিনেমাটিতে তুলে ধরা হয়েছে একসাথে অনেক কিছুই। আর সবথেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে, সিনেমায় যখন যেটা প্রয়োজন ঠিক তখন সেটাই দেয়া হয়েছে; দর্শকের অভিযোগ করার কোনো সুযোগই রাখা হয় নি যে-“এসময়ে এটা দরকার ছিল, কিন্তু এটা তো পাই নি” কিংবা “Something is missing.” এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, দর্শক সিনেমা দেখতে এসে অতৃপ্তি নিয়ে অন্তত ফিরবেন না; বরং যে আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে তারা সিনেমাটি দেখতে আসবেন তার ষোলআনা পূর্ণ হতে বাধ্য(এক্ষেত্রে স্বীকার করতেই হবে যে তন্ময় তানসেন বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন)!
“পদ্ম পাতার জল” প্রকৃতপক্ষে একটি মহাকাব্যের চলচ্চিত্ররূপ। এই সিনেমায় দেখা যায় উনিশ শতকের একটি ঘটনা, যার মূল ভূমিকায় দেখা যায় একজন কবিকে, যে কিনা এক প্রভাবশালী জমিদারের একমাত্র সন্তান; বলতে গেলে বংশের বাতি। তাকে শহরে পাঠানো হয় উচ্চশিক্ষার জন্য। কিন্তু উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়েও তিনি তার কবিসত্ত্বা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। এরই মধ্যে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কবি যান এক বিখ্যাত বাঈজীর নাচ দেখতে। বাঈজীর রূপ ও গুণে তিনি এতটাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন যে তার কবিতা আস্তে আস্তে অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে, সেই বাঈজীকে কেন্দ্র করে কবির মাঝে জেগে উঠতে থাকে নতুন এক সত্ত্বা। বাঈজীর প্রতি এক গভীর টান অনুভব করতে শুরু করেন কবি। শুরু হয় কবি এবং বাঈজীর প্রেম। কিন্তু যেখানে ক্রিয়া বল থাকে, প্রতিক্রিয়া বল তো সেখানে থাকবেই। কবি যতই বাঈজীর জীবনের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকেন, ততই তার কবিহৃদয় ক্ষত বিক্ষত হতে থাকে। কেননা নৃত্যরত বাঈজীর নৃত্য চারিদিকে যে আলোর ফোয়াড়া বইয়ে দেয়, তার চাইতে বহুগুণে অন্ধকার ছেয়ে আছে বাঈজীর নিজের জীবনে! বাঈজীর জীবনে যে কষ্টের অন্ধকার ছেয়ে আছে তা বুঝতে পেরেই কবি সেই খাচায় বন্দী পাখিকে মুক্ত করতে চান, তাকে মুক্ত আকাশে ডানা মেলার অধিকার উপহার দিতে চান। আর তা করতে গিয়ে তিনি সম্মুখীন হতে থাকেন একের পর এক খলনায়কের। তিনি তার প্রেমের শক্তি দিয়ে সব খলনায়কদের দমন করতে পারলেও একজন খলনায়ককে তিনি কিছুতেই দমন করতে পারেন নি। কেননা সেই খলনায়কের জন্ম উপমহাদেশীয়দের সহজ সরল আবেগ থেকে, যাকে যুগ যুগ ধরে ব্যবহার করে উপমহাদেশে রাজত্ব করে এসেছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা! বৃটিশদের পন্থা অবলম্বন করে সেই খলনায়কের জন্ম দেয়া হয় কবির নিজের ভেতরেই। সেই ভয়ঙ্কর খলনায়কের এক ফুৎকারে নিমেষেই তছনছ হয়ে যায় সবকিছু। আর তারই পরিণতিতে কবির জীবনে নেমে আসে নিকশ কালো অন্ধকার। মূলত আজ অবধি এ পৃথিবীতে যত মহাকাব্য রচিত হয়েছে, তাদের সবগুলোর পটভূমিতেই রয়েছে কবির জীবনের কোনো বেদনাদায়ক স্মৃতি, যা কবির পুরো পৃথিবীকে জর্জরিত করে দিয়েছে।
এই ছবিটিতে শুধুমাত্র কবি-বাঈজীর প্রেমই মুখ্য নয়, বরং একই সাথে আরো অনেক কিছুই তুলে ধরা হয়েছে এখানে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার, শাসনের নামে শোষণ, নিপীড়ণ, সাম্রাজ্যবাদীদের Dark Politics সহ আরো অনেক কিছুরই চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই একটিমাত্র ছবিতেই। বলতেই হচ্ছে, এটি রীতিমত একটি Multipurpose Movie! আর চলচ্চিত্রের অন্যান্য উপাদানের কথাও যদি বলেন, তাহলে আমি বলব এই সিনেমাটিতে তার কোনোটিরই অপূর্ণতা রাখা হয় নি। যেই জায়গায় কমেডি দরকার সেই জায়গায় কমেডি, যেখানে উত্তেজণার প্রশ্ন সেখানে টান টান উত্তেজণা! আর ট্র্যাজিডি জিনিসটা বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। বলতেই হয় যে পরিচালক বাঙালির সাইকোলজি নিয়ে বেশ ভালোই রিসার্চ করেছেন এই সিনেমাটি বানানোর আগে। বাঙালি একটা সিনেমায় কী কী চায়, এবং সিনেমার ঠিক কোন মুহুর্তে কোন জিনিসটা তাদের তৃপ্তি মেটাতে পারবে, সেদিকে নজর রেখেই এই সিনেমাটি তৈরি করেছেন তিনি। আর তাই দর্শক যে অতৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন তার কোনো উপায়ই নেই!!!
এই সিনেমাটি দেখার পর যদি কেউ আমার মন্তব্য জানতে চান তবে অন্য দর্শকদের মত আমিও একটা কথাই বলব, এটা আমার জীবনে বিগত কয়েক বছরে দেখা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ একটি চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রটির প্রত্যেক শিল্পীই যে শতভাগ আন্তরিকতা ঢেলে দিয়েছেন, পরিশ্রমের যে তারা কোনো ত্রুটি রাখেন নি, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই চলচিত্রটি!