ব্রিটিশ ভিসা গণহারে প্রত্যাখ্যান
*৫০১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ
*তথ্য চলে যাচ্ছে ভারতে
*উদ্যোগ নেই ৩ বাংগালী এমপির
————————
ব্রিটিশ ভিসা প্রাপ্তদের সংখ্যা
২০১৩ সালে ৭১ শতাংশ
২০১৪ সালে ৬৭ শতাংশ
২০১৫ সালে ১৭ শতাংশ
————————
মোঃমশাহিদ আলী/নাজমিন আরাঃ
ঢাকা থেকে দিল্লিতে ব্রিটিশ ভিসা পেতে সীমাহীন ভোগান্তি আর বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে ভিসা প্রত্যাশিদের। ভিসা চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন কিংবা সময়মতো ভিসা পাননি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছেন দেশের একাধিক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সচিব, ব্যবসায়ী এবং খ্যাতিমান সাংবাদিকরাও। প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন একাধিকবার ব্রিটিশ ভিসা প্রাপ্ত ভিজিটররাও ।এক্ষেত্রে রেকর্ড সংখ্যক হারে কমে এসেছে ভিসা প্রাপ্তদের সংখ্যা । সেই সাথে নয়া দিল্লিতে ভিসা সেন্টার স্থানান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশিদের ব্যক্তিগত সকল তথ্য চলে যাচ্ছে ভারতে । যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের উপর মারাত্বক হমকি হতে পারে ।
আমাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০১৩ সালে ঢাকায় বৃটিশ হাইকমিশনে ৩০ হাজার ৪১৮ জন আবেদন করেন। এর মধ্যে সাধারণ ক্যাটাগরিতে ১৫ হাজার ২৯০ জনকে, ৭ হাজার ৬২৯ জনকে পারিবারিক ক্যাটাগরিতে এবং ২ হাজার ৬২৮ জনকে শিক্ষার্থী ক্যাটাগরিতে ভিসা দেওয়া হয়। ওই বছর মোট ভিসা দেয়া হয় ২৩১৮৭ জনকে । অর্থাৎ আবেদনকারীর ৭১ শতাংশই ভিসা পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালে প্রায় ৩২ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে প্রায় ২১ হাজার ভিসা পান। ওই বছরে ভিসা পেয়েছেন ৬৭ শতাংশ আবেদনকারি । অর্থাৎ বিগত বছরের তুলনায় ৪ শতাংশ কম । ( এখানে উল্লেখ্য ওই বছরই ১ অক্টোবর থেকে ভিসা সেন্টার নয়া দিল্লিতে স্থানার করা হয় ) চলতি বছরে এ পর্যš- প্রায় ১৯ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে ৯ হাজার আবেদনকারী ভিসা পেয়েছেন , যার শতকরা হিসাবে মাত্র ১৭ ভাগ । অর্থাৎ ২০১৩ সালে যখন ঢাকায় ভিসা সেন্টার ছিল তখন ৭১ শতাংশ আবেদনকারী ভিসা পেয়েছিলেন যা ২০১৫ সালে নয়া দিল্লিতে গিয়ে এই সংখ্যা ১৭ শতাংশে নেমে আসে ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকায় ভিসাকেন্দ্র থাকার সময়ে মোট আবেদনের ৬৯ শতাংশ আবেদনই গ্রহণ করা হতো। দিল্লিতে যাওয়ার পর ভিসা পাওয়ার সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। ভিসার আবেদনের পর সাধারণ ক্ষেত্রে ১৫ দিনের মধ্যে এবং বিশেষ ক্ষেত্রে (প্রিমিয়াম ভিসা) ৭ দিনের মধ্যে ভিসা ইস্যুর জন্য যুক্তরাজ্য সরকারের ঘোষিত নীতি হলেও দিল্লিতে ভিসাকেন্দ্র স্থাপনের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত দিতে এক মাস কিংবা তার বেশি সময় নেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সদ্য ঢাকা সফর করে যাওয়া যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়াইন জানিয়েছেন, শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এককভাবে ভিসাকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ব্যয় সংকোচনের কেন্দ্রীয় নীতি হিসেবে আরও অনেক দেশ থেকেই ভিসাকেন্দ্র সরিয়ে একটি কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। ভিসার আবেদন নিষ্পত্তিতে যেন দীর্ঘ সময় না লাগে সে জন্য ভিসাকেন্দ্রগুলোতে জনবল বাড়ানো হবে বলেও তিনি জানিয়েছেন। এখন ভিসাকেন্দ্র পুনরায় ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব নয় বলেও স্পষ্টই জানিয়ে দেন তিনি।
এ দিকে দিল্লিতে ভিসাকেন্দ্র স্থানান্তরের পর জটিলতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। এ ব্যাপারে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি পালনের জন্য প্রবাসী এবং দেশে থাকা তাদের স্বজনরা মিলে একটি সমন্বয় কমিটিও গঠন করেছেন। কমিটির আহ্বায়ক ফয়জুর রহমান বাংলা সংলাপকে জানিয়েছেন, তারা এ পর্যš- ভিসার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হওয়া এবং সময়মতো ভিসা না পাওয়ার ৫০১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সংগ্রহ করেছেন। এগুলো সমন্বিত করে যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
কার্যকর উদ্যোগ নেই ৩ বাংগালী এমপিরঃ
ব্রিটিশ ভিসা কার্যক্রম নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জোরালো ভূমিকা পালনের জন্য বিগত নির্বাচনে লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত ৩ বাংলাদেশী অরিজিন রোশনারা আলী এমপি, টিউলিপ সিদ্দিক এমপি ও রূপা হক এমপি বরাবরে নির্বাচনের পর পরই বাংলাদেশী কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ বিষয়টি উত্থাপন করেন। তারা সকলেই আশ্বাস দেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ বিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের কাছে উপস্থাপন করবেন এবং এ সমস্যা সমাধানে পার্লামেন্টে জোর তৎপরতা চালাবেন। তবে খুবই দুঃখজনক যে যাদেরকে গর্বের সহিত ভোট দিয়ে বাংলাদেশিরা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মেম্বার করেছেন সেই তিন বাংগালী কন্যার এ ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি । কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের মতে যদি তিন বাংগালী এমপি সম্মিলিতভাবে একটি উদ্যোগ গ্রহন করতেন তাহলে বিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের নজরে যেত এবং কার্যকর একটি রিজাল্ট পাওয়া সম্ভব হত ।
যুক্তরাজ্যের মন্ত্রী ও ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনারের বক্তব্য :
তিন দিনের ঢাকা সফরের শেষ দিনে গত ২৫ আগস্ট যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী ডেসমন্ড সোয়াইনের কাছে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, প্রথমেই পরিষ্কার হওয়া দরকার যে শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এককভাবে ভিসাকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। যুক্তরাজ্য সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যয় সংকোচনের নীতি নিয়েছে। এ কারণেই আরও কয়েকটি দেশ থেকে ভিসাকেন্দ্র সরিয়ে একটি কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি বলেন, ভিসাকেন্দ্র সরানো হলেও সাধারণ আবেদনের ক্ষেত্রে ১৫ দিন এবং বিশেষ ক্ষেত্রে (প্রিমিয়াম) ৭ দিনের মধ্যে ভিসা প্রদানে যুক্তরাজ্য সরকারের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। যেহেতু কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠছে সে কারণে আরও মসৃণভাবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভিসার আবেদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ভিসা কেন্দ্রগুলোতে জনবল বাড়ানো হবে। সংবাদ সম্মেলনে ঢাকায় যুক্তরাজ্য হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে এ বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময়মতোই ভিসা আবেদনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসছে। এখন পর্যন্ত জটিলতা কিংবা দীর্ঘসূত্রতার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ বরাবরে বিষয়টি উত্থাপন:
ইউকে ফরেন অফিস এর সিদ্ধান্তের আলোকে গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনের ভিসা প্রসেসিং কার্যক্রম নয়াদিল্লিতে স্থানান্তরের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশী ভিসা আবেদনকারীদের নানাবিধ ভোগান্তি, অহেতুক হয়রানি, দীর্ঘসুত্রিতা ও জটিলতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যথাযথভাবে ভিসা আবেদন বিচার-বিবেচনা ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র বিশ্লেষণ ছাড়াই গণহারে ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান আশঙ্কাজনক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এমনি প্রেক্ষাপটে জনগুরুত্বপূর্ণ এবিষয়টি ব্রিটিশ সরকারের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা হয় গত বছরের শেষ দিকে। ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে লন্ডনে ব্রিটিশ কারী এ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারী থেরেসা মে এমপি বরাবরে বিষয়টি উত্থাপন করেন বিলেতে বাংলাদেশী কমিউনিটির স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ও ব্রিটিশ কারী এ্যাওয়ার্ড-এর প্রবর্তক এনাম আলী। জবাবে ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারী খোঁজ-খবর নিয়ে এ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে প্রচেষ্টা চালাবেন বলে অশ্বাস দেন।
গত ২৭ জানুয়ারী এ বিষয়টি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্স-এ উত্থাপন করেন ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির এমপি ও কমনওয়েলথ এক্সচেঞ্জ এডভাইজারী বোর্ড মেম্বার মিঃ এন্ড্রু রসিনডেল এমপি বিষয়টি পার্লামেন্টে উত্থাপনের পর সরকার এবং বিরোধী দলীয় বেশ ক’জন এমপি এসংক্রান্ত বিতর্কে অংশ নেন। এর প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ হোম অফিস মিনিস্টার আশ্বস্ত করেন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে সরকার গ্রহণপূর্বক এ ব্যাপারে ব্যাপক খোঁজ-খবর নিয়ে পার্লামেন্টে পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি প্রদানের। কিন্তু বিগত ৭ মে অনুষ্ঠিত ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনের ঢামাঢোলে পতিত হয়ে এ বিষয়টি পরে অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যায়।
লন্ডনে তৎপরতা:
ব্রিটিশ ভিসা কার্যক্রম নয়াদিল্লি– থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে চলতি বছরের গোড়ার দিকে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন ও বিশিষ্টজনদের যৌথ প্রয়াসে আত্মপ্রকাশ ঘটে (ইৎরহম ইধপশ ঃযব টক ারংধ ঢ়ৎড়পবংংরহম ংবৎারপবং ভৎড়স হবি উবষযর ঃড় উযধশধ) নামে একটি ক্যাম্পেইন-এর। এই ক্যাম্পেইনের উদ্যোক্তা দি স্পাইস ম্যাগাজিন, ব্রিটিশ বাংলাদেশী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি, গ্রেটার সিলেট ডেভেলপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল ইউকে, সলিসিটর এসোসিয়েশন ইউকেসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। এই ক্যাম্পেইনের পক্ষ থেকে গত ২৩ ফেব্রুয়ারী লন্ডনে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে দিল্লিতে ব্রিটিশ ভিসা কার্যক্রম স্থানান্তরের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট জটিলতা, ভোগান্তি, অহেতুক হয়রানি, দীর্ঘসুত্রিতা এবং গণহারে ভিসা প্রত্যাখ্যানের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
তিক্ত অভিজ্ঞতা মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সচিবদেরঃ
মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি গত মে মাসে লন্ডনে একটি মেলা উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘ সময় পার হওয়ার পরও ভিসা না পাওয়ার কারণে নিজেই পাসপোর্ট ফেরত নেন। কারণ তার অন্য দেশে অনুষ্ঠান ছিল। সময়মতো ভিসা না পাওয়ার কারণে তিনি লন্ডনে ওই মেলা উদ্বোধনে আসতে পারেননি।
বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুস তিনিসহ চারজন চলতি বছরের শুরুর দিকে ব্রিটিশ ভিসার আবেদন করেছিলেন। আবেদনকারীদের মধ্যে সরকারের একজন সচিবও ছিলেন।এ দলের কাউকেই ভিসা দেওয়া হয়নি। ফলে লন্ডনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিতে পারেননি। সরকারের সেই সচিবের সঙ্গে আলাপ করলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সরকারের পূর্ণ মন্ত্রীসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভিসার আবেদন করে সময়মতো ভিসা পাননি, অনেকে প্রত্যাখ্যাতও হয়েছেন। এ কারণে তার একার ভিসা না পাওয়ার বিষয়টি তিনি ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন না।
গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সরকারের একজন পূর্ণ মন্ত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কয়েক মাস আগে তিনিসহ আরও পাঁচ-ছয়জন একসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ভিসার আবেদন করেছিলেন। যাদের লাল পাসপোর্ট ছিল তাদের ভিসা দেওয়া হয় এক মাস পর, আর যাদের সবুজ পাসপোর্ট ছিল তাদের দেওয়া হয় ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে বর্তমানে লাল পাসপোর্টের ক্ষেত্রেই জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে বেশি। এটা কেন, তার কারণ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
সমকাল পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে লন্ডনে সংহতি সাহিত্য পরিষদের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য গত ২৮ জুন ভিসার আবেদন করেন। তিনি জানান, তার বায়োমেট্রিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় গত ৯ জুলাই। তাকে ভিসাসহ পাসপোর্ট ফেরত নেওয়ার জন্য যুক্তরাজ্য হাইকমিশনের চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয় গত ১২ আগস্ট। তিনি পাসপোর্ট পাওয়ার পর দেখেন তার ভিসা ইস্যুর তারিখ ১৩ জুলাই। অথচ তিনি অগ্রগতি জানতে চেয়ে ই-মেইল করলে গত ২৮ জুলাই তার আবেদনের স্ট্যাটাস দেখানো হয় ‘ইন প্রগ্রেস’। তার অনুষ্ঠান হয়ে যায় ১ আগস্ট। ফলে তার যাওয়া হয়নি। এ ঘটনায় দিল্লি থেকে ভিসার আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত জটিলতা স্পষ্ট হয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যের ভিসা জটিলতা নিরসনে গঠিত সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব শামস উদ্দিন জানান, তাদের কাছে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। যেখানে সঠিকভাবে কাগজপত্র দেওয়ার পরও ভিসা দিতে অহেতুক বিলম্ব করা হয়েছে। তিনি বলেন, এটি কৌশল হতে পারে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত সময়ে আবেদনের পরও অনুষ্ঠান এবং ভ্রমণের নির্দিষ্ট তারিখের পর ভিসা দেওয়া হচ্ছে, যা কোনো কাজে আসছে না। তিনি জানান, এরই মধ্যে লন্ডনে এ বিষয়টি নিয়ে মানববন্ধন হয়েছে। সবার অভিজ্ঞতা ও অভিযোগ সমন্বিত করে বৃহত্তর পরিসরে কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি চলছে কমিটির পক্ষ থেকে।
লন্ডনে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের আয়োজক ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এনাম আলী এক সংবাদ সম্মেলনে একই ধরনের অভিযোগ করে বলেন, ২০১৪ সালের অক্টোবর মাসের পর থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সময়মতো ব্রিটিশ ভিসা দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অসংখ্য ব্যবসায়ী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি লন্ডনে বিভিন্ন আয়োজনে অংশ নিতে পারছেন না।
নয়াদিল্লি থেকে গণহারে ব্রিটিশ ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাতদের ক’জন:
গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশীদের জন্য ইউকে ভিসা প্রসেসিং স্থানান্তরের পর যুক্তিযুক্ত কারণ এবং যথাযথ যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকে গণহারে ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। বিগত প্রায় ১১ মাসে কত আবেদনকারীর ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কিংবা প্রত্যাখ্যানের হার কত শতাংশ-এর সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে যে, ভিসা আবেদনকারীদের ৮০ শতাংশের উপরে ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। নিম্নে ভিসা লাভের যোগ্য এবং ইতোপূর্বে বহুবার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন এমন কয়েকজন ভিসা প্রত্যাখ্যতদের তথ্য প্রদান করা হলো।
১। সিলেট নগরীর মিরাবাজার ৬০ মৌসুমী আবাসিক এলাকার অধিবাসী বয়োবৃদ্ধা পিয়ারা খাতুন ইতিপূর্বে ৫ বার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। এক মেয়ে ছাড়া তার সকল ছেলে মেয়েই যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। গত ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি ৬ষ্ঠ বার যুক্তরাজ্যের ভিসার জন্য আবেদন করলে তার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়।
২। বিপূল অর্থ-বিত্তের অধিকারী সিলেটের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী নগরীর রায়নগর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার অধিবাসী আবুল হোসেন ইতোপূর্বে তিনবার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। তিনি স্ত্রী এবং মেডিকেল ও অনার্স পড়–য়া ২ কন্যাকে নিয়ে এবার যুক্তরাজ্য সফরের জন্য ব্রিটিশ ভিসা আবেদন করেন গত জুন মাসের প্রথমার্ধে। দীর্ঘ প্রায় ২ মাস কাল ক্ষেপণের পর ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে সম্প্রতি তাদের পাসপোর্ট ফেরৎ দেয়া হয়।
৩। সিলেট নগরীর বন্ধন-৪, বাদাম বাগিচা, সিলেট এর অধিবাসী বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী রোটা: হারুনুর রশিদ-এর সহধর্মিনী মিসেস মনোয়ারা খাতুন ইতোপূর্বে ৩ বার যুক্তরাজ্য ও একাধিকবার সৌদি আরব সফর করেছেন। কিন্তু এবার ব্রিটিশ ভিসার জন্য আবেদন করলে তার ভিসা আবেদনও প্রত্যাখ্যাত হয়।
৪। সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার এরালিয়া বাজার এলাকাধীন সাচায়নী গ্রামের অধিবাসী মোঃ ফজলু মিয়া ইতোপূর্বে ৩ বার মাল্টিপল ব্রিটিশ ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্য সফর করেছেন ৩বার। কিš‘ এ বছর তিনি ৪র্থ বার যুক্তরাজ্য সফরের জন্য ভিসা আবেদন করলেও দু’বারই তা প্রত্যাখ্যাত হয়।
৫। সিলেট নগরীর নবারুন-৩৯৯, সোনারপাড়া, শিবগঞ্জ এলাকার অধিবাসী গিয়াস উদ্দিন ও লিলা খানম যুক্তরাজ্য সফর করেছেন ইতিপূর্বে ২ বার। কিন্তু গত জুলাই মাসে ব্রিটিশ ভিসার জন্য আবেদন করলে তাদের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়।
৬। সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার রামধা বাজার এলাকাধীন মোহাম্মদপুর নিবাসী নুসরাত ইকবাল চৌধুরী ব্রিটিশ ভিসার জন্য গত মে মাসে আবেদন করেন। কিন্তু তার ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করে দিল্লিস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনের ভিসা সেকশন। অথচ তিনি ইতিপূর্বে ২ বার যুক্তরাজ্য সফর করেন।
৭। সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ ভাদেশ্বর পশ্চিমভাগ নিবাসী মোহাম্মদ ওলীদ আহমদ ইতিপূর্বে ২ বার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ ভিসার জন্য আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়।
৮। সিলেটের বিশ্বনাথ নতুন বাজার নিবাসী আলী আহমদ শুয়েব গত মার্চে ব্রিটিশ ভিসার জন্য আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। অথচ ইতিপূর্বে তিনি একাধিকবার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন।
৯। সিলেটের জনৈক সিনিয়র সাংবাদিক ইতিপূর্বে সপরিবারে ৫ বার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। কিন্তু এবার স্ত্রী ও সন্তানসহ ব্রিটিশ ভিসার জন্য আবেদন করলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয় অত্যন্ত অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে।
১০। সিলেট নগরীর জালালাবাদ আবাসিক এলাকার অধিবাসী নাম প্রকাশে অনি”ছুক জনৈক সঙ্গীত শিল্পী ইতোপূর্বে তার সন্তানসহ ৪/৫বার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। এবছর ব্রিটিশ ভিসার জন্য তিনি আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন।
১১। রাজধানী ঢাকার উত্তরা নং ১৩ সেক্টরের অধিবাসী বুলবুল আহমেদ । সুপ্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী । তার অফিস বনানীতে কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ । গুলশান, বনানী ও উত্তরায় তার ৩ টি বাড়ি । ১৯৯৯ থেকে ৪০ বারের অধিক যুক্তরাজ্য সফর করেছেন ব্যবসায়িক কাজে । প্রতি বছর গড়ে ৩ থেকে ৬ বার বিলেত সফর করেন তিনি । টঝঅ সহ ইউরোপ আমেরিকা, এশিয়ার বহু দেশ তিনি সফর করেছেন বহুবার । অসবৎরপধ’ৎ ৫ ুৎং সঁষঃরঢ়ষব ারংধ ধংব ঃধৎ একাধিক বার । গত ১৪ জুন তিনি টক নতুন ভিসার জন্য আবেদন করেন , কিš‘ ১ জুলাই তার ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয় ।
১২ । মারুফ আকিদ ,সিনেমা আর্টিস্ট বাংলাদেশ টেলেইভিশন । ৩ বার ইউকে ভিজিট করার পর গত ৩০ জুলাই ব্রিটিশ ভিসার আবেদন করলে ১৫ আগস্ট রিফুইজ করা হয় । তিনি বাসা ৬৯৫/ডি বড় মগবাজার , ঢাকা অধিবাসী ।
‘ক্যাম্পেইন ফর ব্রিংগিং ব্যাক ইউকে ভিসা প্রসেসিং ফ্রম নিউ দিল্লি টু ঢাকা’র বক্তব্য:
বিশিষ্ট সাংবাদিক- লেখক ও প্রবাসী বিষয়ক গবেষক, ‘ব্রিটেনে বাংলাদেশী’ গ্রন্থের রচয়িতা এবং ক্যাম্পেইন ফর ব্রিংগিং ব্যাক ইউকে ভিসা প্রসেসিং ফ্রম নিউ দিল্লি টু ঢাকা-এর আহবায়ক মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান বলেন, যুক্তরাজ্যের সাথে আমাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক দু’শ বছরের অধিক কাল থেকে। আজ থেকে ২শ’৬ বছর আগে প্রথম বাঙ্গালী তথা সিলেটের অধিবাসী সৈদ আলী ১৮০৯ সালে বিলেতের মাটিতে পদার্পণের মাধ্যমে সেখানে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর অভিবাসনের যে গোড়াপত্তন হয়েছিল, দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বর্তমানে যুক্তরাজ্যে প্রায় ৭ লক্ষ বাংলাদেশীর বসবাস।
গত বছরের অক্টোবর থেকে ঢাকাস্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনের ভিসা প্রসেসিং কার্যক্রম নয়াদিল্লিতে স্থানান্তরের ফলে বাংলাদেশী ভিসা আবেদনকারীরা নানাভাবে হয়রানি, অহেতুক ঝামেলা, ভিসা প্রসেসিং-এ অনাকাঙ্খিত দীর্ঘসুত্রিতা এবং যুক্তিযুক্ত কারণ ছাড়াই গণহারে ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। এতে ব্রিটিশ ভিসা আবেদনকারীদের মাঝে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা এবং ভীতিকর পরি¯ি’তির সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালের পর থেকে এ দেশের মানুষ ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকশিন থেকে ভিসা লাভ করে আসছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীনতার ৪২ বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ব্রিটিশ ভিসা প্রসেসিং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে হচ্ছে। এটি নি:সন্দেহে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং এর জনগণের জন্য নিতান্তই অবমাননাকর। ঢাকা থেকে নয়াদিল্লিতে ব্রিটিশ ভিসা প্রসেসিং স্থানান্তরের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র, সরকার, দেশের রাজনৈতিক দল কিংবা সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। এটিও পীড়াদায়ক। আমাদের দেশ ও জাতির আত্ম মর্যাদা এবং জনভোগান্তি সংশ্লিষ্ট এ বিষয়টির প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের সরকার ও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কুটনৈতিক পর্যায়ে প্রচেষ্টার মাধ্যমে এর সুরাহা করা একান্ত প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
এখানে উল্লেখ্য গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনের ভিসা প্রসেসিং নয়াদিল্লিতে স্থানান্তরের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশী ভিসা প্রার্থীদের অহেতুক হয়রানি, সীমাহীন দুর্ভোগ এবং ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যানের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত বছরের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশীদের জন্য ব্রিটিশ ভিসা প্রসেসিং কার্যক্রম ঢাকা থেকে নয়াদিল্লিতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত এবং এসংক্রান্ত উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিবাদে প্রথম থেকেই নানা কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। বিপূল সংখ্যক প্রবাসী অধ্যুষিত বিভাগীয় নগরী সিলেটে গত বছরের ২৮ আগস্ট সিটি কর্পোরেশনের সম্মেলন কক্ষে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বৃহত্তম বাংলাদেশী কমিউনটি সংগঠন ‘গ্রেটার সিলেট ডেভেলপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল’ (জিএসসি) ইউকে’র বাংলাদেশ চাপ্টারের উদ্যোগে এক নাগরিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সংগঠনের বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটর ও দৈনিক সিলেট সংলাপ সম্পাদক জনাব মুহাম্মদ ফয়জুর রহমানের ঐকান্তিক উদ্যোগ ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে ঢাকা থেকে ব্রিটিশ ভিসা অফিস ন্থানান্তরের ব্রিটেন সরকারের গ্রহীত এই সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। সমাবেশে সিলেট বিভাগের ৪ জেলার বিপূল সংখ্যক সূধীবৃন্দ এবং প্রবাসী নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশীদের জন্য ব্রিটিশ ভিসা কার্যক্রম স্থানান্তরের উদ্যোগ বাতিলের দাবিতে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক বাংলাদেশী কমিউনটি সংগঠন ‘গ্রেটার সিলেট ডেভেলপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল’ (জিএসসি) ইউকে’র বাংলাদেশ চাপ্টারের উদ্যোগে সর্বস্তরের নাগরিকবৃন্দের অংশগ্রহণে সিলেট বিভাগের ৪ জেলায় একই সাথে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয় গত বছরের ৭ ও ১৬ সেপ্টেম্বর। এসব মানববন্ধন থেকে ব্রিটিশ ভিসা অফিস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বাতিলের জোর দাবি জানানো হয়। এদিকে, ব্রিটিশ ভিসা কার্যক্রম নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে আজ ২৮ আগস্ট বিভাগীয় নগরী সিলেটে ‘গ্রেটার সিলেট ডেভেলপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল’ (জিএসসি) ইউকে’র সিলেট জেলা শাখার উদ্যোগে সর্বস্তরের নাগরিকবৃন্দের অংশগ্রহণে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকা থেকে ব্রিটিশ ভিসা প্রসেসিং নয়াদিল্লিতে স্থানান্তর না করার দাবিতে যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনসহ বিভিন্ন নগরীতে বাংলাদেশী কমিউনিটির উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে সভা-সমাবেশ অনুষ্ঠিত এবং সংবাদপত্রে বক্তৃতা বিবৃতি প্রকাশিত হয়। কিন্তু এসব দাবির প্রতি তোয়াক্কা না করে ব্রিটিশ সরকার তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত বছরের ১ অক্টোবর থেকে ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনের ভিসা প্রসেসিং কার্যক্রম নয়াদিল্লিতে স্থানান্তর করা হয়। আর তখন থেকেই ব্রিটিশ ভিসার জন্য বাংলাদেশী আবেদনকারীদের দৃর্ভোগ, বিড়ম্বনা এবং যুক্তিযুক্ত কোন কারণ ছাড়াই গণহারে ভিসা প্রত্যাখ্যান শুরু হয়। গত অক্টোবরের পর থেকে বিগত মাস গুলোতে নয়াদিল্লিস্থ ব্রিটিশ ভিসা অফিস থেকে বাংলাদেশী ভিসা আবেদনকারীদের প্রতি অহেতুক হয়রানি ও ঝক্কি-ঝামেলা চরমে পৌঁছে। সেইসাথে ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান হতে থাকে আশঙ্কাজনক হারে।
উদ্ভুত এ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ ভিসাপ্রার্থী বাংলাদেশী আবেদনকারীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠার সৃষ্টি হয়। এমনি প্রেক্ষাপটে চলতি বছরের মার্চের গোড়ার দিকে প্রবাসী বিষয়ক গবেষক ও ব্রিটেনে বাংলাদেশী গ্রšে’র লেখক, জিএসসি ইউকে’র বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটর ও দৈনিক সিলেট সংলাপ সম্পাদক মুহাম্মদ ফয়জুর রহমান-এর আহবানে এবং সভাপতিত্বে গত মার্চে সিলেট প্রেসক্লাব, সিলেট জেলা বার এসোসিয়েশন, সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি, এসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস্ অব বাংলাদেশ (আটাব), ওভারসীজ করেসপন্ডেন্ট এসোসিয়েশন সিলেট (ওকাস) সহ নেতৃস্থানীয় পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে সিলেটে এক নাগরিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় গত ১৪ মার্চ সিলেট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এর সম্মেলন কক্ষে সিলেটের সর্বস্থরের নাগরিকবৃন্দ ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘ক্যাম্পেইন ফর ব্রিংগিং ব্যাক ইউকে ভিসা প্রসেসিং ফ্রম নিউ দিল্লি টু ঢাকা’। ক্যাম্পেইনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়। এতে জিএসসি ইউকে’র বাংলাদেশ কো-অর্ডিনেটর ও দৈনিক সিলেট সংলাপ সম্পাদক মুহাম্মদ ফয়জুর রহমানকে আহবায়ক, সিলেট প্রেসক্লাব, জেলা বার এসোসিয়েশন ও সিলেট চেম্বান অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সভাপতি এবং বাংলাদেশ ওভারসীজ সেন্টার সিলেট-এর নির্বাহী কর্মকর্তা কে যুগ্ম আহবায়ক, গেইট ট্রাস্ট বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালককে সদস্য-সচিব ও ওকাস এর সাধারণ সম্পাদক কে যুগ্ম সদস্য-সচিব করা হয়।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাস্থ ব্রিটিশ হাইকমিশনে বাংলাদেশী আবেদনকারীদের জন্য ব্রিটিশ ভিসা প্রসেসিং কার্যক্রম ফিরিয়ে আনা এবং ব্রিটিশ ভিসা প্রাপ্তি জটিলতা নিরসন, অহেতুক হয়রানি ও গণহারে ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান বন্ধের দাবিতে গঠিত ‘ক্যাম্পেইন ফর ব্রিংগিং ব্যাক ইউকে ভিসা প্রসেসিং ফ্রম নিউ দিল্লি টু ঢাকা’ শীর্ষক এ গ্লোবাল ক্যাম্পেইন-এর উদ্যোগে ইতোমধ্যে নানা কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। গত বছরের অক্টোবর থেকে বিগত মাসগুলোতে যাদের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান হয়েছে এদের মধ্যে যারা বহুবার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন তাদের ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যান সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ, বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়, এব্যাপারে জনমত সৃষ্টি সংক্রান্ত বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হয়েছে ইতোমধ্যে। গত জুন ও জুলাই মাসে ক্যাম্পেইন-এর আহবায়ক যুক্তরাজ্য সফর করেন এবং এ ক্যাম্পেইনের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন নগরীতে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন।
এদিকে, ব্রিটিশ ভিসা কার্যক্রম নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে অচিরেই ‘ক্যাম্পেইন ফর ব্রিংগিং ব্যাক ইউকে ভিসা প্রসেসিং ফ্রম নিউ দিল্লি টু ঢাকা’ এর পক্ষ থেকে বড় আকারের কর্মসূচী পালনের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
ব্রিটিশ ভিসা কার্যক্রম নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে সিলেট ছাত্র ও যুবকল্যাণ ফেডারেশন গত ৩১ মার্চ বিভাগীয় নগরী সিলেটের কোর্ট পয়েন্টে মানববন্ধন, ৬ এপ্রিল গণস্বাক্ষর সংগ্রহ এবং ১৮ এপ্রিল সিলেট নগর ভবনে সূধী সমাবেশের আয়োজন করে।
সিলেট কল্যাণ সংস্থা ও সিলেট জনস্বার্থ সংরক্ষণ পরিষদ ব্রিটিশ ভিসা কার্যক্রম নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে সিলেট নগরির চৌহাট্টা পয়েন্টে চলতি বছরের গোড়ার দিকে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে।
জালালাবাদ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদ গত জানুয়ারীতে সিলেট নগরীর কোর্ট পয়েন্টে বাংলা*ে+//ান্তরের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশের আয়োজন করে।
জ///ালালাবাদ প্রবাসী কল্যাণ পরিষদ যুক্তরাজ্য শাখা গত ২৪ জুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দাপ্তরিক বাসভবন লন্ডনের ১০ ডাউনিং স্ট্রিট এর সম্মুখে বাংলাদেশী আবেদনকারীদের ভোগান্তি লাঘবের জন্য ব্রিটিশ ভিসা প্রসেসিং নয়াদিল্লি থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচী, সমাবেশ এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করে। তারা ব্রিটিশ ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ অফিস বরাবরে এ ব্যাপারে একটি ই-পিটিশনও দাখিল করে। এছাড়ও সংগঠনের কর্মকর্তারা ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বেশ ক’জন এমপি’র সাথে লবিং অব্যাহত রেখেছেন যাতে করে এসব এমপি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এ বিষয়টি উত্থাপন করে সমস্যাটির সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন।
ব্রিটিশ ভিসাকেন্দ্র ঢাকায় ফিরিয়ে আনার দাবিতে লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক
এদিকে বাংলাদেশীদের জন্য ব্রিটেনের ভিসা ইস্যুকেন্দ্র ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার দাবিতে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হলো গোলটেবিল বৈঠক।
গত মঙ্গলবার রাতে পুর্ব লন্ডনের মন্টিফোর সেন্টারে বাংলাদেশ ষ্টুডেন্ট ইউনিয়নের চেয়ারপারসন আতাউল্লাহ ফারুকের সঞ্চালনায় বৈঠকে বক্তারা বলেন-বাংলাদেশীদের জন্য ব্রিটিশ ভিসার ইস্যুকেন্দ্র ভারতে স্থানান্তরের কারনে অন্তহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশী ব্রিটিশ ভিসাপ্রার্থীরা।
গত আট মাসে বাংলাদেশীদের আবেদনের বিপরীতে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভিসা ইস্যুর হার নেমে এসেছে প্রায় শুন্যের কোঠায়। সভায় ভিসা ইস্যুকেন্দ্র পুনরায় বাংলাদেশে স্থানান্তরের দাবি বাস্তবায়নে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির উদ্যোগে দাবি বাস্তবায়নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনার লক্ষে ১ লাখ মানুষের সাক্ষর গ্রহণের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয় সভায়।
সভায় বক্তব্য রাখেন কেএম আবু তাহের চৌধুরী, ইউকে বাংলা প্রেসক্লাবের আহবায়ক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সোয়েব, এনটিভি ইউরোপের সিইও সাবরিনা হোসেন,সাবেক ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমদ, বিএনপির কুটনৈতিক উইং এর কর্মকর্তা মুশফিকুল ফজল আনসারী, কাউন্সিলার মতিনুজ্জামান, এস বি ফারুক, এম এ গনি, জাকির খান, মোরাদ কোরেশী মুনির হোসেন, এসএইচ সোহাগ প্রমুখ।
ভারতের নেতিবাচক দৃষ্টিভংগিঃ
গণহারে ভিসা প্রত্যাখাত হওয়ায় ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সর্বত্র। অভিযোগের তীর ছোঁড়া হয়েছে নয়াদিল্লিস্থ ব্রিটিশ এ্যাম্বেসিতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। মূলত, এসব কর্মী ভারতীয় হওয়ায় বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নীতি অবলম্বন করছেন বলে ভুক্তভোগীরা মনে করেন। একাধিকবার ব্রিটেন সফর করার পরও ভিসা না দেয়া, এমনকি ভিআইপিরাও ভিসা পাচ্ছেন না, যা রীতিমতো উদ্বেগজনক ব্যাপার। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আশু প্রয়োজন বলে বাংলাদেশী ভুক্তভোগী মানুষ দাবী জানিয়েছেন।