হতাশা থেকে যুক্তরাজ্যে প্রতি বছর অর্ধশতাধিক নার্সের আত্মহত্যা

Spread the love

বাংলা সংলাপ ডেস্কঃবিগত ৭ বছরে যুক্তরাজ্যে আত্মহত্যা করেছে তিন শতাধিক নার্স। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ৫৪ জন নার্স আত্মহত্যায় লিপ্ত হয়েছে। পরিবারের দাবি, তারা ‘বিষাক্ত সংস্কৃতি’র বলি। অতিরিক্ত কাজের চাপ ও অপর্যাপ্ত বেতনসহ বিভিন্ন রকমের হতাশা থেকেই এমন ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণের প্রয়োজনের কথা সামনে এসেছে। আলোচনা ও মেন্টরিংয়ের মধ্য দিয়ে এই সংকট নিরসনের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, সাত বছরে ৩০৫ জন নার্স আত্মহত্যা করেছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ৩২ জন আত্মহত্যা করেছে। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫১। ২০১৪ সালে সর্বোচ্চ ৫৪ জন নার্স আত্মহত্যা করেছিল। সাম্প্রতিক আরেক গবেষণায় জানা গেছে, নারী নার্সদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি থাকে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন জানিয়েছে, পূর্ববর্তী রেকর্ডের সাপেক্ষে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে আত্মহত্যার পরিমাণ ২৩ শতাংশ বেশি। দ্য মিরর বলছে, কনজারভেটিভ পার্টি জাতীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের বাজেট কমানোর কারণে তার গভীর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে নার্সদের ওপর।

রয়্যাল কলেজ অব নার্সিংও (আরসিএন) মনে করছে কাজের সময় সহায়তার পরিবেশ যথেষ্ট ভালো নয়। এছাড়া দেশজুড়ে ৪০ হাজার কর্মীর স্বল্পতা থাকায় তাদেরকে অতিরিক্ত কাজ করতে হয়। তারা মনে করছে, নার্সদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ দরকার। আরসিএন প্রধান ডেম ডোনা কিনেইর বলেন, ‘নার্সরা সেখানে বিষন্নয়তায় ভোগে, তাদের পর্যাপ্ত সহকর্মী নেই ফলে অনেক সময় ধরে কাজ করতে হয়। আমাদের কর্মীরা বারবারই বলে আসছে যে তাদের ঊর্ধ্বতনরা তাদের এই মানসিক পরিস্থিতি এড়িয়ে যাচ্ছে কিংবা গুরুত্ব দিতে চাইছে না। তিনি আরও বলেন, ‘সরকার ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের সবগুলো সংস্থার উচিত বিষয়টাতে গুরুত্ব দেওয়া। পুরুষদের চেয়ে কেন নারী নার্সরা বেশি আত্মহত্যা করছে তা খুঁজে বের করা জরুরি।’

২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেন ২২ বছর বয়সী নার্স লুসি। তার মা লিজ অতিরিক্ত পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিকের প্রসঙ্গে বলেন, কর্মক্ষেত্রের ‘বিষাক্ত এক সংস্কৃতির’ বলি তার মেয়ে। তবে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে তা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দুর্বলতা আকারে নথিভূক্ত হওয়ার আশঙ্কায় কাউকে কিছু বলতেও পারত না লুসি। তার মা লিজের দাবি, ‘কাউকে এ নিয়ে বলতে গেলে সিনিয়ররা বলে বসত, ’১২ বছর ধরে আমি এভাবেই কাজ করে আসছি’। লিজ জানান, প্রশিক্ষণের সময় লুসিকে কোনও সম্মানি দেওয়া হয়নি। মাসে তাকে চলার জন্য জন্য ৬ পাউন্ড দেওয়া হতো। ১২ ঘণ্টা হাসপাতালে কাজ করার পর তাকে একটি পিজা রেস্টুরেন্ট ও কেয়ার হোমে কাজ করতে হতো উল্লেখ করে তার মা বলেন, আমি লুসিকে ফিরিয়ে আনতে পারবো না। তবে আমি চাই তার এই ত্যাগের পর পরিবর্তন আসুক।

২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেন রয়াল স্টোক ইউনিভার্সিটি হাসপতালের ৫১ বছর বয়সী নার্স অ্যান বারডেট। আগেও দুই বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। তার বাগদত্তা অ্যান্ড্রু ওয়ার্ড বলেন, তার কিছু পারিবারিক ঝামেলাও ছিলো। তবে কর্মক্ষেত্রে হতাশা নিয়ে সবার সতর্ক থাকা উচিত। তিনি বলেন, ‘এমন কোনও ওয়েবসাইট কিংবা ব্লগ থাকা উচিত যেখানে নার্সরা তাদের হতাশা ও কষ্টের কথা সবাইকে জানিয়ে হালকা হতে পারে এবং সমাধানের পরামর্শ নিতে পারে। এছাড়া মেন্টর নিয়োগের মাধ্যমেও একটা সমাধানে আসা যেতে পারে।’

আত্মহত্যা করা নার্স লুসি ডি অলিভেরার মা জানান, ‘তাদের প্রতিদিনের সামগ্রিক কর্মঘণ্টাই ব্যয় হয় সেই গুরুত্বপূর্ণ ঐশ্বরিক কাজের পেছনে। তবে একটা পর্যায়ে এসে মনে হয়, তারা বুঝি এই কাজ না করে ম্যাকডোনাল্ডসে কাজ করলে ভালো হতো। এটা যথাযথ নয়।’

২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট আত্মহত্যা ডেরিফোর্ড হাসপাতালের এ অ্যান্ডই নার্স লরা হাইড। তার পরিবারের দাবি, নার্সিং শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ ও ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন চালু করা দরকার। এই সংকট সমাধানে লরা হাইড ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছে তার আত্মীয় লিয়াম বার্নস। তিনি বলেন, ‘নার্সরা মানুষের সেবা করে। লরা সবার কথা ভাবতো। তবে নিজেই এক বিভীষিকার চক্রে পড়ে গিয়েছিল।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ছায়ামন্ত্রী জোনাথান অ্যাশওয়ার্থ এই ঘটনায় সরকারি তদন্তের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক জীবন হারানোই হৃদয়বিদারক। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মীদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার বিষয়টি জরুরি বলে উল্লেখ করেন তিনি। স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ দফতর জানিয়েছে, জাতীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর খুব শিগগিরই কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য সুপারিশ বাস্তবায়ন করবে। তাদের জন্য গোপন একটি হেল্পলাইন গড়ে তোলা হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আলিস কোল দ্য মিররকে বলেন, আত্মহত্যার প্রধানতম কারণ নার্সরা কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত থাকায় সুনির্দিষ্ট করে বেশি চাপ বেশি অনুভব করেন। তীব্র হতাশার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাদের। নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য, হতাশা ও আত্মহত্যা নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে চায় না। ডা. আলিস আরও বলেন, বাড়ির কাজেও নারী নার্সদের বড় ভূমিকা পালন করতে হয়। ফলে পরিবার ও রোগীদের যত্ন নিতে গিয়ে নিজেদের খেয়াল রাখা হয় না। অনবরত এই চাপে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। এছাড়া আর্থিক দুশ্চিন্ত ও ঋণের বোঝাও অনেক সময় আত্মহত্যার সিদ্ধান্তে প্ররোচিত করে তাদের।’

ড. আলিস পরামর্শ দিয়েছেন, হাসপাতালের চাপ সামলানোর পাশাপাশি নার্সিং শিক্ষার্থীদের শেখানো উচিত যে কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রেখে রোগীকে সেবা দিতে হবে। একইসঙ্গে নিজের যত্ন নেওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে হবে তাদের। সব নার্সদেরই একটা সুরক্ষা পরিকল্পনার ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে।’


Spread the love

Leave a Reply